বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

২১ বছরে ৭শ’ লঞ্চ ডুবিতে মারা গেছে ২০ হাজার মানুষ

নাছির উদ্দিন শোয়েব : দেশে একের পর এক ঘটেই চলেছে ভয়াবহ লঞ্চডুবির ঘটনা। এসব দুর্ঘটনায় শত শত প্রাণহানি হলেও লঞ্চডুবি রোধে নেয়া হয়না কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। ফিটনেস না থাকা, ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই, ট্রাফিক সিগন্যাল অমান্য করাসহ কোনো ঘটনাতেই বিচার না হওয়ায় একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতেই থাকে। লঞ্চডুবির পর তদন্ত কমিটি গঠিত হয়। তবে এসব কমিটির সুপারিশ কখনো বাস্তবায়িত হয় না।
বেসরকারি সংস্থা কোস্ট বিডির গবেষণা অনুযায়ী, গত ২০ বছরে বাংলাদেশের নৌপথে বড় ১২টি দুর্ঘটনা ঘটেছে, এতে দেড় হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছেন। এ ছাড়াও আরও বহু নৌ দুর্ঘটনা ঘটেছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, গত ২১  বছরে ছোট-বড় প্রায় ৭শ’ লঞ্চডুবিতে মারা গেছেন ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন নকশায় ত্রুটি, অদক্ষ ইঞ্জিন অপারেটর, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালামাল বহন ছাড়াও বিচারহীনতার কারণে বন্ধ হয় না লঞ্চ দুর্ঘটনা। ফায়ার সার্ভিস সাবেক একজন মহাপরিচালক বলেন, বাংলাদেশে নৌ দুর্ঘটনা অহরহ ঘটছেই। অপরাধ কে করছে আর অপরাধীদের যদি শাস্তি না হয় যার জন্য অনেকেই অনৈতিক কাজ করেই যায়। শুধু তাই নয় এক্ষেত্র কর্তৃপক্ষগুলোও থাকেন উদাসীন। এ ছাড়াও যান চালনায় নিয়ম না মানা এবং অদক্ষ শ্রমিকদের দিয়ে লঞ্চ বা ফেরি পরিচালনা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্য পরিবহনের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় এবং যান্ত্রিক ত্রুটি এমন নানা কারণে নৌপথে বড় বড় দুর্ঘটনাও ঘটে।
২০২০ সালের ২৯ জুন সকাল সাড়ে ৯টায় বুড়িগঙ্গার শ্যামবাজার উল্টিগঞ্জ পয়েন্টে ঢাকা-চাঁদপুর রুটের ময়ূর-২ লঞ্চের ধাক্কায় ঢাকা-মুন্সীগঞ্জ রুটের এমবি মর্নিং বার্ড লঞ্চ ডুবে যায়। এ ঘটনায় মঙ্গলবার বিকাল পর্যন্ত ৮ জন নারী, ৩ জন শিশুসহ ৩৪ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। মর্নিং বার্ড লঞ্চডুবির ঘটনায়  গত বছরের ৭ জুলাই সচিবালয়ে সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির সুপারিশের বিস্তারিত তুলে ধরে নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়। তাতে সদরঘাট টার্মিনালের আশেপাশে খেয়াঘাট না রাখাসহ ২০ দফা সুপারিশ করা হয়। নৌ আইনে শাস্তির মেয়াদ ও জরিমানার পরিমাণ যুযোপযোগী করে আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিতে বলা হয়। কিন্তু দায়িদের বিষয়ে কিছুই প্রকাশ করা হয়নি। এতে বলা হয় সদরঘাটের ভাটিতে ৭/৮ কিলোমিটার ও উজানে ৩/৪ কিলোমিটার বার্দি উঠিয়ে দিতে হবে। এ অংশে পল্টুন ছাড়া নৌযান নোঙ্গর করা যাবে না। পর্যায়ক্রমে সেখান থেকে শিপইয়ার্ড ও ডকইয়ার্ড উঠিয়ে দিতে হবে। যান ঘাট ছাড়ার পূর্বে ভয়েজ ডিক্লেরেশন দিতে হবে। এছাড়া সদরঘাটে পল্টুনের সংখ্যা বৃদ্ধি, ফিটনেসবিহীন লঞ্চ বন্ধ, নৌযানের গতি নির্ধারণ করে কন্ট্রোল টাওয়ার স্থাপন করার সুপারিশ করা হয় প্রতিবেদনে।
এদিকে ২০১৪ সালের ৪ অগাস্ট আড়াইশোর বেশি যাত্রী নিয়ে পদ্মা নদীতে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের একটি লঞ্চ। নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষ বিআইডব্লিউটিএ জানিয়েছে, ওই লঞ্চটি তোলা সম্ভব হয়নি, এবং এর ধ্বংসাবশেষও কখনো খুঁজে পাওয়া যায়নি। ডুবে যাওয়া লঞ্চ থেকে ৪৯ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছিল, আর ৫০ জন যাত্রীর খোঁজ পাওয়া যায়নি। বাকীরা সাঁতরে এবং জেলেদের সহায়তায় তীরে উঠতে পেরেছিলেন।
২০০৩ সালের ৮ জুলাই ঢাকা থেকে ভোলার লালমোহনগামী এমভি নাসরিন-১ নামের লঞ্চটি চাঁদপুরের মেঘনা ও ডাকাতিয়া নদীর মোহনায় ডুবে যায়। বি আইডব্লিউটিএ বলছে, অতিরিক্ত যাত্রী ও মালবোঝাইয়ের কারণে লঞ্চটির তলা ফেটে গিয়েছিল। ডুবে যাওয়ার সময় লঞ্চটিতে কত যাত্রী ছিলেন সে বিষয়ে ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য রয়েছে। তবে ওই দুর্ঘটনায় সরকারি হিসাবে প্রায় সাড়ে ছয়শো লাশ উদ্ধার করা হয়েছিল। যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলছিলেন, মৃত্যুর হিসাবে এই লঞ্চডুবিকে দেশের সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা বলা হয়।
২০০২ সালের ৩ মে চাঁদপুরের ষাটনল সংলগ্ন মেঘনা নদীতে ডুবে যায় সালাহউদ্দিন-২ নামের যাত্রীবাহী লঞ্চ। এতে ভোলা এবং পটুয়াখালীর প্রায় চারশো যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। ওই দুর্ঘটনার পর নৌ পরিবহন মন্ত্রণালয়ের করা একটি তদন্ত কমিটি নকশামতো লঞ্চ নির্মাণ না করায় মালিককে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহনের জন্য মাস্টারকে অভিযুক্ত করে। এতে ওই লঞ্চের মালিককে জরিমানা এবং মাস্টারকে চাকরিচ্যুত করা হলেও অন্যদের শাস্তি হয়নি।
২০০০ সালের ২৯ ডিসেম্বর ঈদুল আযহার রাতে চাঁদপুরের মতলব উপজেলার ষাটনল এলাকায় মেঘনা নদীতে এমভি জলকপোত এবং এমভি রাজহংসী নামের দুটি যাত্রীবাহী লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে রাজহংসী লঞ্চটি পানিতে তলিয়ে যায়, সে সময় ওই লঞ্চের ১৬২ জন যাত্রী নিহত হয়েছিলেন। এদিকে ১৯৮৬ সালে অ্যাটলাস স্টার নামে একটি লঞ্চ ডুবে ২০০ জন যাত্রী মারা গিয়েছিলেন। লঞ্চটি ধারণক্ষমতার চেয়ে অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন এবং খারাপ আবহাওয়ার কারণে ডুবে গিয়েছিল বলে জানিয়েছে বিআইডব্লিউটিএ। এছাড়া ২০০৫ সালে একটি ফেরী ডুবে গিয়ে ১১৮জন যাত্রী নিহত হন, এবং ২০০৫ সালে এমএল মিতালি ও এমএল মজলিশ নামে দুইটি ছোট লঞ্চের মুখোমুখি সংঘর্ষের পর ডুবে গিয়ে প্রায় ৩০০ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছিল।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ