শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

খুলনায় পানির জন্য হাহাকার!

খুলনা অফিস : বাসাবাড়িতে খাবার পানি নেই, রান্নার পানি নেই, নেই গোসলের পানি। পানির জন্য অনেকেরই প্রাণ এখন ওষ্ঠাগত। ওয়াসার পানি নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজে ব্যবহার করা হয়। এ পানি পান করা যায় না। এতোদিন নলকূপের পানি পান করেছি। এখন নলকূপে পানি উঠছে না। প্রতিবেশীদের নলকূপ (সাবমার্সিবল পাম্প) থেকে পানি আনতে হচ্ছে। কিন্তু সাবমার্সিবল পাম্পে পানি উঠাতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে হওয়ায় অনেকে পানি দিতে চান না। বৃষ্টি না হলে পানির স্তর আরও নিচে নামবে এবং তাতে নগরীর ৯০ শতাংশ নলকূপ দিয়ে পানি না ওঠার পরিস্থিতি তৈরি হবে বলে জানা গেছে।
খুলনায় টিউবওয়েলের হ্যান্ডেল চাপতে চাপতে ঘাম ঝড়ে যায় কিন্তু পানি উঠছে না। পানির জন্য অনেক পরিশ্রম করতে হয়। পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় টিউবওয়েলেও পানি পাওয়া যাচ্ছে না। আক্ষেপ করে এভাবেই কথাগুলো বলেন খুলনা মহানগরীর ছোট মির্জাপুরের বাসিন্দা শওকত আলী। মহানগরীর আলী ক্লাব সংলগ্ন এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা নাসির উদ্দিন বলেন, মার্চ মাসের শুরু থেকেই সকালে বাসা থেকে বের হওয়ার সময় পানি পাই না। মাঝে মধ্যে বাসার লোকজন পানির অভাবে গোসলও করতে পারেন না।
বাইতিপাড়া এলাকার বাসিন্দা হরে কৃষ্ণ বলেন, গরম শুরুর পর থেকেই হস্তচালিত নলকূপে আগের মতো পানি উঠছে না। রাতে অথবা ভোরে সামান্য পানি ওঠে। পানি নিয়ে সীমাহীন কষ্টে আছি। যা দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।
আক্ষেপ করে অনেকে বলেন, অধিকাংশ এলাকায় পাইপলাইনে মধুমতি নদীর পরিশোধিত পানি সরবরাহ করছে খুলনা ওয়াসা। কিন্তু সে পানি খাওয়ার যোগ্য নয়। ওয়াসা নতুন প্রকল্প বাস্তবায়ন করলেও খাবার পানির কষ্ট আগের মতোই থেকে গেছে।
খুলনা ওয়াসার উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রকৌশলী মো. কামাল উদ্দিন আহমেদ বলেন, মহানগরীর ৩৮ হাজার বাড়িতে ওয়াসা পাইপলাইনে পানি দিচ্ছে। গ্রীষ্ম এলেই ভূগর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় অনেক এলাকার নলকূপে পানি পাওয়া যাচ্ছে না। ওয়াসার নিজস্ব নলকূপেও পানি উত্তোলনের পরিমাণ কমেছে। এতে পানির জন্য নগরবাসীকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
এদিকে নগরী ছাড়াও সুপেয় পানির তীব্র সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শহর থেকে গ্রাম সবখানেই রয়েছে সুপেয় পানির সঙ্কট। পুকুর ও জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ায় জেলার বিভিন্ন গ্রামে পানির জন্য হাহাকার শুরু হয়েছে। এতে চৈত্রের খরতাপে হাঁপিয়ে উঠছে মানুষ ও প্রাণীকূল। বিশুদ্ধ পানির অভাবে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন ধরনের রোগের প্রাদুর্ভাব শুরু হয়েছে দাকোপ, বটিয়াঘাটা, কয়রা ও পাইকগাছায়। এসব এলাকার অগভীর নলকূপগুলো অধিকাংশই অকেজো। যে কয়েকটি সচল রয়েছে সেগুলোর পানি লবণাক্ত ও আর্সেনিকে ভরা। যার কারণে খাবার পানি আনতে দেড়-দুই কিলোমিটার দূরে যেতে হচ্ছে নারীদের।
ভুক্তভোগীরা পানির জন্য আকাশের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন বলে জানান। পানি সংরক্ষণ ও নিরাপদ পানি সরবরাহে জেলা পরিষদের পুকুর/দীঘি ও জলাশয় পুনঃখনন/সংস্কারের দাবি জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
তবে পানির অভাবে চৈত্রের কাঠফাটা রোদে মাঠ, ঘাট, পথ, খাল, বিল ও প্রান্তর ফেটে চৌচির। দিনভর সূর্যতাপে নুইয়ে পড়ছে গাছের পাতাও। নেতিয়ে পড়েছে সবজি। ফসলি ক্ষেত বৃষ্টির অভাবে ক্ষতির সম্মুখীন। সেচের অভাবে বাদামী রং ধারণ করছে ইরি ধানক্ষেত। দাকোপ, বটিয়াঘাটার মহাসঙ্কটে পড়েছেন তরমুজ চাষিরা।
অপরদিকে পানির অভাবে খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার গংগারামপুর এলাকার ১হাজার ২শ’ বিঘা জমিতে রোপণকৃত তরমুজ ক্ষেতে নষ্ট হয়ে যাবার উপক্রম হয়েছে। চাষিরা তাদের উৎপাদিত ফসল তরমুজ বাঁচাতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। সেচ দিতে না পাড়লে লোকসানের মুখে পড়বে তারা। কৃষকরা যখন দিশেহারা তখন তাদের ফসল বাঁচাতে এগিয়ে এসেছে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জিকেবিএসপি।
সূত্র জানায়, বটিয়াঘাটার গংগারামপুর এলাকায় মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্র। লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের অন্যতম উদ্যেশ্য হলো প্রয়োগিক গবেষণার মাধ্যমে লবণাক্ত মাটির ব্যবস্থাপনা প্রযুক্তির উদ্ভাবন এবং লবণাক্ত পানির যথোপযুক্ত ব্যবহারের জন্য টেকসই প্রযুক্তির উদ্ভাবন।। এসএমআরসির বেশ কিছু উদ্ভাবিত প্রযুক্তি রয়েছে, যা উপকূলীয় লবণাক্ত এলাকায় ফসল চাষের জন্য উপযোগী।
মৃত্তিকা সম্পদ উন্নয়ন ইনস্টিটিউটের চলমান প্রকল্প জিকেবিএসপি (এসআরডিআই অংগ) এর অর্থায়নে এসএমআরসি’র উদ্ভাবিত প্রযুক্তি যেন কৃষকেরা ব্যবহার করতে পারে সে লক্ষ্যে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কৃষকদেরকে লবণাক্ত জমিতে ফসল উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করা হয়। পূর্বে গংগারামপুর ইউনিয়নে শুধুমাত্র রোপা আমন ধান উৎপাদন হতো । আর বছরের অন্য সময় জমি পতিত থাকত। জিকেবিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে ২০১৯ সালে প্রথমবারের মত ২৫ বিঘা জমিতে ভূট্টা ও তরমুজের আবাদ হয় এবং কৃষকেরা লাভবান হয়। যার ধারাবাহিকতায় এবং প্রকল্পের ২য় বছর ২০২০ সালে বটিয়াঘাটা উপজেলার গংগারামপুর ইউনিয়নের ওই এলাকার প্রায় ৬০০ বিঘা জমিতে তরমুজ, ভূট্টা, সবব্জি, বোরো ধান আবাদ করা হয় এবং কৃষক লাভবান হন। ফলে এ বছর প্রায় ১২শ’ বিঘা জমিতে তরমুজ, ভুট্টা, বোরো ধান ও বিভিন্ন রকমের ফসল ও সবব্জি আবাদ করেন কৃষকরা।
এদিকে, জমিতে সেচ দেওয়ার একমাত্র উৎস পাশ্ববর্তী ভরাখালী খালের পানি সম্পূর্ণরূপে শুকিয়ে যাওয়া এবং দীর্ঘদিন বৃষ্টি না হওয়ায় কৃষকের ফসল উৎপাদন হুমকির মুখে পড়ে। এমতাবস্থায় জিকেবিএসপি প্রকল্পের সহায়তায় এলাকায় একটি গভীর নলকূপের ব্যবস্থা করেন প্রকল্পের পরিচালক কৃষিবিদ শচীন্দ্র নাথ বিশ্বাস। এতে এলাকার শতাধিক কৃষক উপকৃত হয়েছেন। কৃষকের জমির ফসল উৎপাদন সফলতার মুখ দেখবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বটিয়াঘাটা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. রবিউল ইসলাম, লবণাক্ততা ব্যবস্থাপনা ও গবেষণা কেন্দ্রের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা অমরেন্দ্রনাথ বিশ্বাস ও জিকেবিএসপি প্রকল্পের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা শামসুর নাহার রত্না বলেন, জিকেবিএসপি প্রকল্পের মাধ্যমে এলাকার কৃষকদের মাঝে প্রশিক্ষণ উপকরণ ও প্রযুক্তি প্রদানের ফলে লবণাক্ত এলাকায় আবাদ দিন দিন বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু এ বছর দীর্ঘদিন অনাবৃষ্টির ফলে কৃষকদের ফসল আবাদ হুমকির মধ্যে পড়ে। ক্ষেতের ফসল প্রায় ক্ষেতেই শুকিয়ে মারা যাচ্ছে। এ অবস্থায় শুস্ক মওসুমে লবনাণাক্ত এলাকায় সেচ কার্যক্রম সম্প্রসারণে গভীর নলকূয়প স্থাপনের মাধমে সেচ সমস্যার সমাধান করা হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ