শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিচারক নিজেও কাঁদেন যে বিচারে

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : ইসলামের বিধান অনুসারে চুরির অপরাধে সংশ্লিষ্টের হাত কেটে নেবার হুকুম আছে। সৌদি আরবে এ বিধান চালু থাকায় দেশটিতে চৌর্যবৃত্তির ঘটনা প্রায় ঘটেই না বলা যায়। এরপরও কারুর অপরাধ প্রমাণিত হলে সংশ্লিষ্ট পুরুষ বা নারী কেন চুরি করলো তা খতিয়ে দেখা হয়। ওদের কেউ একান্ত জীবন বাঁচাতে এমন অপকর্ম করেছে, নাকি অভ্যাসের কারণে তা ভালোভাবে খোঁজ-খবর নেয়া হয়। যদি ক্ষুধার জ্বালায় চুরি করে থাকে তাহলে তাদের অভাব দূরীকরণের উদ্যোগ নেয়া হয়। এরপরও যদি কেউ একই অপরাধ করে তাহলে তার হাত কাটার সাজা কার্যকর করা হয়। চোর ধরা পড়লেই তার হাত কাটতে হবে এমন কিন্তু নয়। অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে থাকা, মসজিদ বা কোনও প্রতিষ্ঠান থেকে কোনও জিনিস অলক্ষ্যে মেরে দিলে কিংবা মাঠের ফসল কেউ নিয়ে গেলেও চুরি হিসেবে গণ্য হবে না। কেউ প্রকৃত চোর বা চুন্নি কিনা তা নির্ধারণে বোর্ড থাকে। এ বোর্ডের রায় অনুসারে সাজা দেয়া হয়। উল্লেখ্য, ডাকাতি কিংবা কারুর পকেট মেরে দিলেও তা চুরি নয়। তবে এমন অপরাধের দেশের প্রচলিত আইনে শাস্তি কার্যকর হবে। এর অর্থ হচ্ছে, সবচুরি চুরি নয়। চুরির প্রকারভেদ আছে। যেমন ধরা যাক, ক্লাসের এক বন্ধু তার অন্য বন্ধুর কলম কিংবা বই না বলে নিয়েছে বা মেরে দিয়েছে এ জন্য কি বন্ধুর হাত কাটা যাবে? না, তা যাবে না। তবে স্কুল কর্তৃপক্ষ বা ক্লাসটিচার অভিযুক্তদের অন্য শাস্তি দিতে পারেন। আর নির্ধারিত বোর্ডের রায় অনুসারে সরকারের লোক চোর-চুন্নির সাজা কার্যকর করে। চুরির মতো অপরাধ করে কেউ ধরা পড়লেই যেকেউ তার হাত কেটে নেবেন বা সাজা দেবেন এমন কিন্তু নয়। এ কথা আমাদের সবার মনে রাখা জরুরি।
পৃথিবীর অন্যতম উন্নত দেশ বলে খ্যাত আমেরিকার একটি চুরির ঘটনার কথা জানা গেছে। ঘটনা সত্য না কাল্পনিক তা জানি না। তবে যথেষ্ট শিক্ষণীয় বলে মনে হয়েছে। তাই উল্লেখ করছি।
পনেরো বছরের একটি ছেলে দোকান থেকে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়লো। প্রহরীর হাত থেকে পালানোর চেষ্টা করবার সময় একটা শেলফ গেল ভেঙে।
বিচারক অপরাধের কাহিনী শুনে ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলেন: তোমার নাম কী?
ছেলে উত্তর দিল: জন মার্ক।
বিচারক আবারও জিজ্ঞেস করলেন: তুমি কি সত্যিই কিছু চুরি করেছিলে? রুটি-চিজের কোনও প্যাকেট?
মাথা নিচু করে ছেলেটি উত্তর দিলো: হ্যাঁ।
বিচারক: কেন চুরি করলে?
জন মার্ক: আমার খুব প্রয়োজন ছিল।
বিচারক: কিনে নিতে পারতে?
জন মার্ক: আমার কাছে টাকা ছিল না।
বিচারক: পরিবার থেকে নিলেই হতো?
জন মার্ক: আমাদের বাড়িতে শুধু মা আছেন। মা অসুস্থ। কর্মহীন। মায়ের জন্যই রুটি চিজ চুরি করেছিলাম।
বিচারক: তুমি কোনও কাজ করো না?
জন মার্ক: গাড়ি ধোয়ার কাজ করতাম। মা অসুস্থ হলে তাঁর সেবা করবার জন্য একদিন ছুটি নিয়েছিলাম। তাই আমার কাজ চলে গেল।
বিচারক: কারও কাছে সাহায্য চাওনি?
জন মার্ক: সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছি। একটা কাজের জন্য প্রায় পঞ্চাশ জনের কাছে গিয়েছি। কিন্তু নিরাশ হয়েছি। পরিশেষে এ চূড়ান্ত পথটাই বেছে নিতে হলো।
ছেলেটির সঙ্গে কথাবার্তার শেষে বিচারক রায় ঘোষণা করতে গিয়ে বললেন: চুরি, বিশেষ করে রুটি চুরি একটি অত্যন্ত লজ্জাজনক অপরাধ। আর এ অপরাধের জন্য আমাদের সবারই সাজা হওয়া উচিত। এ আদালতে উপস্থিত প্রত্যেকে, আপনাদের মধ্যে আমিও আছি এ অপরাধের সঙ্গে যুক্ত। তাই এখানে উপস্থিত প্রত্যেককে দশ ডলার করে জরিমানা করা হলো। দশ ডলার করে এখানে জমা না দিয়ে কেউ কোথাও যেতে পারবেন না।
এ বলে বিচারক তাঁর পকেট থেকে দশ ডলার বের করলেন এবং কলম তুলে নিয়ে লেখতে শুরু করলেন। এ ছাড়াও যে দোকানদার ক্ষুধার্ত জন মার্ককে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন তাঁকেও আমি এক হাজার ডলার জরিমানা দিতে আদেশ করছি। জরিমানার টাকা যদি চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে জমা দেয়া না হয়, আদালত তাঁর দোকানটি সিল করে দিতে নির্দেশ দেবে। জরিমানার সমস্ত টাকা জন মার্কের হাতে তুলে দিয়ে আদালত তার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে।
বিচারকের রায় শোনার পর আদালতে উপস্থিত সবার অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। জন মার্কও বাকরুদ্ধ। আদালতচত্বরে পিনপতন নিস্তব্ধতা। জন মার্ক বিচারককে বারবার দেখছিল।
অশ্রু লুকিয়ে বিচারক আদালত ত্যাগ করলেন।
বর্তমান সমাজ, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং আদালত এমন সিদ্ধান্ত নিতে কি প্রস্তুত?
চাণক্য পণ্ডিত বলেছেন: রুটি চুরি করতে গিয়ে যদি কেউ ধরা পড়ে, সেদেশের জনগণের লজ্জিত হওয়া উচিত। [উদ্ধৃত গল্পটি ইন্টারনেট থেকে নেয়া।]
সমাজের অনেক অসহায় মানুষ, শিশু, কিশোর, অনাথ, এতিম পেটেভাতে মানুষের বাসাবাড়িতে, কারখানায় শ্রম দেয়। সামান্য ভুল হলে মালিক অথবা মালিকপক্ষের লোকদের বকা খেতে হয়। অনেকের অমানবিক পিটুনিও জোটে। কেউ কেউ সামান্য মাসোহারা পায়। কেউ কেউ তাও পায় না। অথচ অনেক দেশেই শিশুশ্রম নিষিদ্ধ। তবু শিশুদের কাজ করতে হয়। অনেক অসহায় শিশু কাজ পায় না। পেটের জ্বালায় বাধ্য হয়ে দোকান থেকে তারা আমেরিকার জন মার্কের মতো  চুরি করে রুটি। খাবার।
উল্লেখ্য, কোনও কোনও দেশে মহামারি করোনাকালেও যুদ্ধবিগ্রহ চলছে। অনেক মানুষ মারা যাচ্ছে। এতিম ও অনাথ হচ্ছে অসংখ্য শিশুকিশোর। ফিলিস্তিনি শিশুরাও অনেকে এতিম হয়ে ভিক্ষে করতে বাধ্য হচ্ছে যুগ যুগ ধরে। মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত রোহিঙ্গা শরণার্থী শিশুরা অসহায় জীবনযাপন করছে কক্সবাজারের কুতুপালংসহ বিভিন্ন শিবিরে। দেশটির জান্তাবাহিনী সম্প্রতি বিক্ষোভরত শত শত মানুষকে হত্যা করছে। অসহায় হয়ে পড়ছে তাঁদের এতিম শিশুকিশোররা। এদের প্রতি বিশ্বসমাজ সদয় না হলে, এরা জন মার্কের মতো জীবন বাঁচাতে খাবারের অভাবে দোকান থেকে রুটি চুরি করবে। অন্যের খাবার কেড়ে খেতে চেষ্টা করবে।
মার্কিন মুল্লুকের বিচারক ক্ষুৎপিপাসায় কাতর কিশোর জন মার্কের প্রতি যেবিচার করেছেন তেমন করতে সামর্থবানদের কে বাধা দেয়? দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আমাদের দেশেও সামান্য রুটি কিংবা পান্তাভাত চুরি করে খেয়ে ফেলবার অপরাধে শিশুকিশোর-কিশোরীদের অমানবিক নির্যাতন করা হয়। অনেক সময় নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে কোনও কোনও শিশুকিশোর দুঃখজনকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। অথচ সামান্য অপরাধে শিশুকিশোরসহ যেকোনও বয়সের কাউকে মেরে ফেলা মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে সমর্থনযোগ্য নয়। এমনকি শ্রেষ্ঠ জীবনাদর্শ ইসলামসহ কোনও ধর্মাদর্শই শিশুকিশোরসহ কোনও মানুষের প্রতি নিষ্ঠুর-নির্দয় আচরণ করতে অনুমতি কাউকে দেয়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ