বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ ॥ হত্যাচেষ্টার মামলা

স্টাফ রিপোর্টার : ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাবন্দী লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় বিক্ষোভ-মিছিলে পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদ এবং এই আইনটি বাতিলের দাবিতে গতকাল শনিবারও উত্তাল ছিল রাজধানীর  শাহবাগ এলাকা। এদিকে বিক্ষোভের সময় শুক্রবার রাতে আটক সাতজনের বিরুদ্ধে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলায় পুলিশ সদস্যদের ‘হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। গ্রেফতার সাতজনকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড চেয়ে আদালতে পাঠানো হলে তাদের জেল গেটে জিজ্ঞাসাবাদের অনুমতি দিয়েছেন আদালত। এদিকে আগামী ১ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেন প্রগতিশীল ছাত্রজোট।  
ছয় মাসের বেশি সময় আগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারে বন্দি অবস্থায় বুধবার মারা যান লেখক মুশতাক আহমেদ। এর প্রতিবাদে শুক্রবার দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ করেন বিভিন্ন সংগঠনের নেতাকর্মীরা। বামধারার ছাত্র সংগঠনগুলোর নেতাকর্মীরা সন্ধ্যায় টিএসসি থেকে মশাল মিছিল নিয়ে শাহবাগে এলে তাদের বাধা দেয় পুলিশ। এক পর্যায়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ বেঁধে যায়। এ সময় পুলিশের লাঠিপেটায় তাদের ৩০ জন আহত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন আন্দোলনকারীরা। তাদের অভিযোগ, রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্ট বন্ধ করে পুলিশ লাঠিপেটা করে। অপরদিকে আন্দোলনকারীদের ‘হামলায়’ ১৫ জন পুলিশ সদস্য আহত হয় বলে দাবি করা হয়।
সংঘর্ষের বিষয়ে পুলিশের রমনা জোনের উপ-কমিশনার সাজ্জাদুর রহমান সাংবাদিকদের বলেছিলেন, ‘সন্ধ্যার দিকে একদল টিএসসি থেকে মশাল মিছিল নিয়ে জাদুঘরের সামনে আসলে আমরা তাদেরকে ইউ টার্ন নিতে বলি। পরে তারা মশালের লাঠি দিয়ে পুলিশের উপর হামলা করে। তখন পুলিশ আত্মরক্ষার্থে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়। এদের একটা গ্রুপ বামপাশ দিয়ে চলে যায়, আরেকটা গ্রুপ পিছনে ফিরে পুলিশের উপর অসংখ্য ইটপাটকেল ছুঁড়ে। এতে আমাদের ১২-১৪ জন পুলিশ সদস্য আহত হয়েছে। আমার নিজেরও পায়ে আঘাত লেগে ব্লিডিং হয়েছে’। আহত বিক্ষোভকারীদের বিষয়ে তিনি বলেন, আমরা জানি না তারা কীভাবে আহত হয়েছে। কিন্তু তারা যেভাবে ইটপাটকেল মেরেছে, তাদের ইটপাটকেলেই তারা আহত হয়ে থাকতে পারে। পুলিশ শুধু তাদের ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিয়েছে। তারা যখন ইটপাটকেল মারছে, তখন পুলিশ ৪-৫টি টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেছে। তবে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ওই ঘটনার আলোকচিত্রে পুলিশ সদস্যদের লাঠিপেটা করতে দেখা গেছে। মামলার বরাত দিয়ে শাহবাগ থানার পরিদর্শক মাহবুব গতকাল শনিবার বলেন, অনুমতি ছাড়া এক থেকে দেড়শ জন মশাল নিয়ে বিক্ষোভ করার সময় তাদের আশপাশের হাসপাতালগুলোর কথা মনে করিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু তারা না শুনে পুলিশের উপর উল্টো হামলা চালায়। তাদের মশালের আগুনে একজন কনস্টেবলের শরীরে আগুন ধরে যায়। পরে মশালের লাঠি দিয়ে পুলিশকে মারধরও করে এবং ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। পরে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করা হয় জানিয়ে এজাহারে বলা হয়েছে, ঘটনার সময় সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তাররা হলেন- আমজিন হায়দার (২২), নজিব আমিন চৌধুরী (২৭), তানজিমুর রহমান (২২), আকিব আহমেদ (২২), আরাফাত (২৬), নাজিদা জান্নাত (২৪) ও জয়তী চক্রবর্তী (২৩)।
পুলিশ কর্মকর্তা মাহবুব বলেন, আহত পুলিশ সদস্যদের প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে। ওই ঘটনায় পুলিশের করা মামলায় আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে পুলিশ সদস্যদের ‘হত্যাচেষ্টার’ অভিযোগ আনা হয়েছে। আর গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে পুলিশকে হত্যার চেষ্টা, রক্তাক্ত জখম করা এবং সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগ আনা হয়েছে। এই ঘটনায় আর কারা জড়িত, সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তিনি।
শাহবাগে মিছিল: গতকাল শনিবারও শাহবাগে বিক্ষোভ করেছে প্রগতিশীল ছাত্রজোট। মিছিল নিয়ে এসে বেলা সাড়ে ১২টা থেকে আধা ঘণ্টার মতো শাহবাগ মোড়ে অবস্থান নেন তারা। এ সময় ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ এই মোড় দিয়ে যান চলাচল ব্যাহত হয়। বেলা ১টা ৫ মিনিট দিকে সেখান থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে টিএসসি অভিমুখে যাত্রা করেন তারা। আগামী ১ মার্চ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কার্যালয় অভিমুখে বিক্ষোভ মিছিলের ঘোষণা দেন প্রগতিশীল ছাত্রজোটের সমন্বয়ক আল কাদেরী জয়। নেতাকর্মীদের উপর পুলিশের লাঠিপেটার প্রতিবাদ জানান তিনি। আল কাদরী জয় বলেন, পুলিশের হামলা দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন দিয়ে সরকার এদেশের জনগণের মুখ বন্ধ করবে ভেবেছেন?  তিনি সরকারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘দেখেন নাই কীভাবে ছাত্র সমাজ স্বৈরাচারী এরশাদকে ক্ষমতা থেকে নামিয়েছে? সেই ছাত্রসমাজ ২০২১ সালে সরকারকে স্বৈরাচার বলছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বাতিলের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা লেখক মুশতাকের নির্মম হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই। সাথে সাথে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- যার মাধ্যমে লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের মুখ বন্ধ করে রাখা হয়েছে তার বিলুপ্তি দাবি করছি, এই আইন বাতিল করার দাবি জানাচ্ছি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন তিনি।
প্রতীকী খাটিয়া মিছিল: লেখক মুশতাকের মৃত্যুর প্রতিবাদে প্রতীকী খাটিয়া মিছিল হয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়। ‘বাংলাদেশের জনগণ’ ব্যানারে বিভিন্ন লেখক, ব্লগার ও রাজনৈতিক অ্যাক্টিভিস্টরা এই মিছিলে অংশ নেন। গতকাল বিকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্য প্রাঙ্গণে এই প্রতিবাদ মিছিল হয়। পরে মিছিলটি শাহবাগ অতিক্রম করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনের মোড় ঘুরে আবার শাহবাগ হয়ে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে এসে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। মিছিলটির আয়োজনে ছিলেন পলিটিকাল অ্যাক্টিভিস্ট কবি শ্মশান ঠাকুর ও লেখক রাহাতুল মোহাম্মদ। সমাবেশে লেখক আবু মুস্তাফিজ বলেন, দেশে যদি গণতন্ত্র না থাকে, তাহলে একটি রাষ্ট্র হিসেবে সেটি আর চলে না। আমরা বলতে চাই, এদেশে সব মত এরই কথা বলার স্বাধীনতা থাকতে হবে। মুশতাক আহমেদ তার মত প্রকাশ করেছেন বলে তাকে জেলে নিয়ে হত্যা করা হলো। সেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমরা মুশতাক হত্যার বিচার দাবি করছি। তিনি আরও বলেন, আমরা প্রতিবাদী হতে পারছি না, নানা কালো আইনের কারণে। তাই সবাই সাহস করে কিছু বলে না। আমরা তাই ভয় ভেঙে আজ এই মিছিল বের করেছি।
৭ জনকে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ: লেখক মুশতাক আহমেদের মৃত্যুর তদন্ত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে শুক্রবার রাতে শাহবাগে মশাল মিছিলের সময় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলা গ্রেফতার সাতজনকে একদিনের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দিয়েছেন আদালত। গতকাল তাদের ঢাকা মহানগর হাকিম আদালতে হাজির করা হয়। এসময় শাহবাগ থানায় পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় করা মামলার সুষ্ঠু তদন্তের জন্য তাদের সাত দিনের রিমান্ডে নিতে আবেদন করেন পুলিশ। অপরদিকে তাদের আইনজীবীরা রিমান্ড বাতিল চেয়ে জামিনের আবেদন করেন। উভয় পক্ষের শুনানি শেষে ঢাকা মহানগর হাকিম মোর্শেদ আল মামুন ভূইয়া রিমান্ড আবেদন নামঞ্জুর করে তিন কার্যদিবসের মধ্যে একদিনের জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের নির্দেশ দেন। অপরদিকে তাদের জামিন শুনানির জন্য ৩ মার্চ দিন ধার্য করেন আদালত। এর আগে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মামুনুর রশীদ বলেন, শাহবাগে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনায় শুক্রবার রাতে ৭ জনকে আসামি করে শাহবাগ থানায় মামলা করা হয়েছে। মামলায় অজ্ঞাতানামা আরও ১০০-১৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ