শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

দন্ড থেকে ট্রাম্পের অব্যাহতিঅভিশংসন বিচার থেকে কী পাওয়া গেল

১৪ ফেব্রুয়ারি এএফপি, বিবিসি : যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পকে অভিশংসন আদালতে দন্ড দেওয়া যায়নি। দলীয় ভাবাদর্শ নিয়ে মার্কিন সিনেটে চরমভাবে বিভক্ত আইনপ্রণেতাদের কাছ থেকে এমন সিদ্ধান্ত ছিল অনেকটাই প্রত্যাশিত। স্বাভাবিকভাবে মানুষের মধ্যে প্রশ্ন জেগেছে, প্রেসিডেন্ট হিসেবে জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই ট্রাম্পের অভিশংসন নিয়ে মেতে ওঠার মধ্য দিয়ে কী অর্জিত হলো?

মার্কিন সংবিধানে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রেসিডেন্টকে সর্বোচ্চ ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে মাত্র চারজন প্রেসিডেন্টকে অভিশংসনের মুখে পড়তে হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো প্রেসিডেন্টের বেলায় অভিশংসন দন্ড কার্যকর করা যায়নি।

ডোনাল্ড ট্রাম্পই ইতিহাসের একমাত্র মার্কিন প্রেসিডেন্ট, যিনি কংগ্রেসে দুই দফা অভিশংসনের শিকার হয়েছেন। ক্ষমতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে থেকে একজন বেপরোয়া প্রেসিডেন্টের পরিণতির কথা ইতিহাস এভাবেই স্মরণ করবে। এ ছাড়া ইতিহাসে এবারেই প্রথম মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় সিনেট অভিশংসন আদালতের কাজ শেষ করেছে। অভিযোগ উপস্থাপন করা হয়েছে নাটকীয় দ্রুততার সঙ্গে। অভিযোগের খন্ডন ও বিচারপ্রক্রিয়া নিয়ে ডেমোক্র্যাট ও রিপাবলিকানদের একধরনের সমঝোতাও ছিল নজিরবিহীন।

রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতা সিনেটর মিচ ম্যাককনেলকে নিয়ে এর মধ্যেই আলোচনার শেষ নেই। ৬ জানুয়ারির সহিংসতার পর ম্যাককনেল ট্রাম্পের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। বলেছিলেন, ক্যাপিটল হিলে হামলার দায়দায়িত্ব রয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। অথচ অভিশংসন আদালতে ভোট দেওয়ার সময় ট্রাম্পের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন তিনি। তার এ ভূমিকা আহত করেছে লোকজনকে।

সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টকে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেওয়ার পরও যে অভিশংসন আদালত বসানো যায়, তা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এর আগে সাংবিধানিক বিতর্কে বলা হয়েছে, মার্কিন সংবিধানে ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর কোনো প্রেসিডেন্টের নামে অভিশংসন আদালত বসানোর বিধান নেই।

ডোনাল্ড ট্রাম্প নিজে ও তার কট্টর সমর্থকেরা অভিশংসন আদালতের রায়ের মধ্যে তাদের বিজয় দেখছেন। দ্রুত দেওয়া এক বিবৃতিতে ট্রাম্প ডেমোক্র্যাটদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছেন নিজের মতো করে। তিনি বলেছেন, ‘মেক আমেরিকা গ্রেট’ আন্দোলন সবে শুরু হচ্ছে। শিগগিরই তা ব্যাপকভাবে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে বলেও আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।

প্রতিনিধি পরিষদের ১০ জন ও সিনেটের ৭ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ছাড়া ট্রাম্পের বিপক্ষে দলের আর কেউ দাঁড়াননি। ফলে, ধরে নেওয়া হচ্ছে, ট্রাম্পই নিকট ভবিষ্যতে রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতা হিসেবে থাকছেন। যদি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অন্য কোনো ঝামেলা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে, তবে তার প্রভাব থেকে এখনই দল বেরিয়ে আসতে পারছে না।

ইতোমধ্যে উদারনৈতিক ধারার সমর্থকদের পক্ষ থেকে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রতি একজন ভালো অ্যাটর্নি জেনারেল নিয়োগ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে, যিনি ট্রাম্পের বিষয়ে তদন্ত শুরু করতে পারবেন এবং তাকে বিচারের সম্মুখীন করতে পারবেন।

ট্রাম্প আগেই বলেছেন, ২০২৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে তিনি আবার প্রার্থী হতে চান। অভিশংসন আদালতের রায় তার বিপক্ষে না যাওয়ায় ওই নির্বাচনের জন্য ট্রাম্প অযোগ্য ঘোষিত হননি। তিনি তার সমর্থকদের উজ্জীবিত করে সে লক্ষ্যেই এখন থেকে কাজ শুরু করবেন বলে মনে করা হচ্ছে।

অভিশংসন আদালতে উপস্থাপন করা অনেক ভিডিওচিত্র ও আগে থেকে অজানা অনেক তথ্য ট্রাম্পের কট্টর সমর্থকদের হয়তো নিজেদের বর্তমান অবস্থান থেকে সরাবে না। যুক্তরাষ্ট্রের উদার রক্ষণশীল ও স্বতন্ত্র চিন্তার লোকজন বিষয়টিকে নজরে রেখে তাদের ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। মার্কিন নির্বাচনে জেতার জন্য স্বতন্ত্র ও স্বাধীন চিন্তার ভোটাররাই এখনো নিয়ামক শক্তি হয়ে আছেন। অভিশংসন আদালতের রায়ে অব্যাহতি পেলেও এসব ভোটারের মনে ট্রাম্পের যে ভাবমূর্তি গেঁথে গেছে, সেখান থেকে উত্তরণ খুব সহজ হবে বলে মনে করার কারণ নেই।

প্রতিনিধি পরিষদের ১০ জন ও সিনেটের ৭ জন রিপাবলিকান আইনপ্রণেতা ছাড়া ট্রাম্পের বিপক্ষে দলের আর কেউ দাঁড়াননি। ফলে, ধরে নেওয়া হচ্ছে, ট্রাম্পই নিকট ভবিষ্যতে রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতা হিসেবে থাকছেন। যদি ট্রাম্পের বিরুদ্ধে অন্য কোনো ঝামেলা মাথাচাড়া দিয়ে না ওঠে, তবে তার প্রভাব থেকে এখনই দল বেরিয়ে আসতে পারছে না।

রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করেন, রিপাবলিকান পার্টির কাছে ২০২২ সালের মধ্যবর্তী নির্বাচন বেশ জটিল হয়ে উঠবে। ট্রাম্পের সমর্থনের পেছনে ছুটবেন কেউ কেউ। কোনো কোনো নির্বাচনী এলাকায় এই সমর্থন প্রার্থীর জন্য বৈরী হয়ে দাঁড়াবে। রিপাবলিকান পার্টির শীর্ষ নেতা সিনেটর মিচ ম্যাককনেলকে নিয়ে এর মধ্যেই আলোচনার শেষ নেই। ৬ জানুয়ারির সহিংসতার পর ম্যাককনেল ট্রাম্পের বিরুদ্ধেই কথা বলেছেন। বলেছিলেন, ক্যাপিটল হিলে হামলার দায়দায়িত্ব রয়েছে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের। অথচ অভিশংসন আদালতে ভোট দেওয়ার সময় ট্রাম্পের পক্ষেই ভোট দিয়েছেন তিনি। তার এ ভূমিকা আহত করেছে লোকজনকে। শীর্ষ নেতা হয়েও দলীয় টানাপোড়েনে পড়েছেন মিচ ম্যাককনেল। ভোট দিয়েছেন ট্রাম্পের দ-ের বিপক্ষে। ইতিহাস মিচ ম্যাককনেলের কথা, না ভোটকে বিবেচনা করে তাকে স্মরণ করবে, তা নিয়ে কথা উঠেছে।

অভিশংসন প্রস্তাব গ্রহণ করা থেকে সিনেটে বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক পার্টির কি অন্য কিছু করার সুযোগ ছিল? সম্ভবত না। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো ডেমোক্রেটিক পার্টিনিয়ন্ত্রিত প্রতিনিধি পরিষদে ১০ জন রিপাবলিকান সদস্যের সমর্থন আদায় করা সাফল্য হিসেবে দেখা হচ্ছে।

স্পিকার ন্যান্সি পেলোসি দ্রুততার সঙ্গে অভিশংসন প্রস্তাব অনুমোদন করাতে পেরেছেন। নয়জন অভিশংসন ব্যবস্থাপকের উপস্থাপনা ও দক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন করতে দেখা যাচ্ছে না কোনো মহলকে। এর মধ্যে প্রধান অভিশংসন ব্যবস্থাপক হিসেবে কংগ্রেসম্যান জ্যামি রাস্কিন অনেকটাই তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন। তার যুক্তি ও আবেগের উপস্থাপন ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের বার্তা যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ববাসীর কাছে ভিন্নমাত্রায় উপস্থাপিত হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। আইনের সাবেক অধ্যাপক জ্যামি রাস্কিনকে আগামী দিনে ডেমোক্রেটিক পার্টির কোনো শীর্ষ পদে দেখা যাবে বলে এখনই আলোচনা শুরু হয়ে গেছে। যদিও ডেমোক্রেটিক পার্টির কোনো কোনো মহল মনে করে, অভিশংসন আদালতে সাক্ষীদের উপস্থাপন করলে ভালো হতো। কিন্তু জ্যামি মনে করেছেন, এতে আদালতের রায়ে কোনো প্রভাব পড়বে না। ফলে, এ নিয়ে সময়ক্ষেপণ করতে চায়নি কোনো পক্ষ।

ট্রাম্পের অভিশংসন বিচার নিয়ে কার্যত নীরব থেকেছেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন। তিনি নীরব থাকলেও অভিশংসন আদালতের কার্যক্রমকে তার হাতের নাগাল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযোগ দেননি। রাজনীতিতে অভিজ্ঞ বাইডেন আগে থেকেই অভিশংসন আদালতের রায়ের বিষয়ে অনুমান করতে পেরেছিলেন। তার ঐক্যের আহ্বান ও সমঝোতার সম্পর্কে যাতে ধস না নামে, সে ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন তিনি। এ ক্ষেত্রে সফল হয়েছেন। ট্রাম্পের অভিশংসন বিচারকাজ দ্রুততার সঙ্গে শেষ করার কথাও বলেছেন বাইডেন।

এখন ট্রাম্প শাসনামলের ব্যর্থতা ও নিজ সাফল্যের কথা উল্লেখ করে যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের কাছে নিজেকে উপস্থাপন করার কাজটা শুরু করতে পারবেন প্রেসিডেন্ট বাইডেন।

ট্রাম্পের আইনজীবী দলে যুক্ত হয়েছিলেন ব্রুস ক্যাস্টর, ডেভিড স্কোহেন ও মাইকেল ভিন। কোনো মামলায় মক্কেলের জয়ই আইনজীবীদের সাফল্য হিসেবে দেখা হয়। অভিশংসন মামলার শেষ দিকে যোগ দেওয়া ভিন ভালো উপস্থাপন করেছেন; ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের যুক্তি খ-ন করেছেন। মার্কিন ইতিহাসে এসব আইনজীবীও তারকাখ্যাতি নিয়ে টিকে থাকবেন। অভিশংসনপ্রক্রিয়ার এও এক পাওয়া।

বাইডেন ও ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া: সিনেটে অভিশংসন আদালতের বিচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পৃথক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। বিবিসি অনলাইনের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।

বিচারে ডোনাল্ড ট্রাম্প খালাস পাওয়ার প্রতিক্রিয়ায় জো বাইডেন বলেছেন, এ ঘটনা স্মরণ করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র ভঙ্গুর।

অন্যদিকে, ডোনাল্ড ট্রাম্প এই বিচারকে ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ‘উইচ হান্ট’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।

ট্রাম্পের বিচারে গত শনিবার সিনেটের অভিশংসন আদালতে চূড়ান্ত ভোট হয়। ভোটে ট্রাম্পকে দ- দেওয়ার পক্ষে পড়ে ৫৭ ভোট, বিপক্ষে ৪৩ ভোট।

সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য ট্রাম্পের দ-ের পক্ষে ভোট দিলেও তিনি সাংবিধানিক আইনে রেহাই পেয়ে যান। কেননা, দ- আরোপের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সিনেট সদস্যের সমর্থন দরকার ছিল। কিন্তু তা পাওয়া যায়নি।

১০০ সদস্যের সিনেটের এই বিচারে ট্রাম্পের দ- কার্যকর করতে অন্তত ১৭ জন রিপাবলিকান সিনেটরের সমর্থন দরকার ছিল। কিন্তু মাত্র সাতজন রিপাবলিকান সিনেটর ট্রাম্পের দ-ের পক্ষে ভোট দেন।

অবশ্য বিচারের এই ফলাফল মোটেই অপ্রত্যাশিত ছিল না। আগেই ধারণা করা যাচ্ছিল, এবারও ট্রাম্পের দ- কার্যকর করা যাবে না। সিনেটে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা অভিশংসন বিচারে ভোটাভুটির পর বাইডেন প্রতিক্রিয়া জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন।  বিবৃতিতে বাইডেন উল্লেখ করেন, ৬ জানুয়ারি ক্যাপিটল হিলে হামলার অভিযোগের বিষয় নিয়ে বিতর্ক না থাকলেও চূড়ান্ত ভোটে ট্রাম্পের দ-াদেশ আসেনি।

এ প্রসঙ্গে বাইডেন বলেন, ‘ইতিহাসের এই দুঃখজনক অধ্যায় আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে গণতন্ত্র ভঙ্গুর।’

বাইডেন আরও বলেন, গণতন্ত্রকে সর্বদা রক্ষা করা দরকার। এ জন্য অবশ্যই সবাইকে সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রে সহিংসতা ও উগ্রবাদের কোনো স্থান নেই বলে উল্লেখ করেন বাইডেন। তিনি বলেন, আমেরিকান হিসেবে, বিশেষ করে আমেরিকার নেতা হিসেবে প্রত্যেকের দায়িত্ব সত্যকে সমুন্নত রাখা। মিথ্যাকে পরাজিত করা।

সিনেটে অভিশংসন আদালতের বিচারে ট্রাম্প খালাস পাওয়ার পরপরই বিবৃতি দিয়ে প্রতিক্রিয়া জানান। ট্রাম্প এই বিচারের নিন্দা জানান। সিনেটের যেসব সদস্য ট্রাম্পের পক্ষে ভোট দিয়েছেন, তিনি তাদের ধন্যবাদ জানান।

ট্রাম্প বলেন, তার ‘মেক আমেরিকা গ্রেট’ আন্দোলন সবে শুরু হয়েছে। ট্রাম্প বলেন, ‘আমরা একটি উজ্জ্বল, দীপ্ত ও অসীম আমেরিকান ভবিষ্যতের লক্ষ্য নিয়ে উদ্ভাসিত হব।’ ট্রাম্প বলেন, ‘আমাদের সামনে অনেক কাজ।’

যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে ট্রাম্পই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি দুই দফা অভিশংসন বিচারের মুখোমুখি হয়েছেন। তবে তাকে দ-িত করা যায়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ