শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সংকট মেটাতে উচ্চমূল্যের এলএনজি আমদানি করছে সরকার

স্টাফ রিপোর্টার : গ্যাসের চাহিদা ক্রমবর্ধমান মেটাতে উচ্চমূল্যের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি করছে সরকার। গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী, প্রতি বছরই ক্রমান্বয়ে এলএনজির আমদানি বাড়ানোর লক্ষ্য রয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে ঊর্ধ্বমুখী আমদানিনির্ভর এ পণ্যটির দাম। এতে এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ও বাড়ছে। চলতি ২০২০-২১ অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে ব্যয় হবে সাড়ে ১৭ হাজার কোটি টাকা। জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগ সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
চলতি অর্থবছর দেশে এলএনজিবাহী ৭৬টি কার্গো আমদানি করা হবে। এরই মধ্যে দেশে এসে পৌঁছেছে ৩৫টি কার্গো। এখনো ৪১টি কার্গো আমদানির অপেক্ষায়। এসব কার্গো আমদানি ব্যয়, রি-গ্যাসিফিকেশন ব্যয়, ভ্যাট, এআইটি ও পোর্ট চার্জসহ মোট ১৭ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা খরচ হবে। এছাড়া এলএনজি সরবরাহ করতে টার্মিনালের অপারেশন চার্জ বাবদ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষকে আরো ১৪০ কোটি টাকা দিতে হবে। সব মিলিয়ে চলতি বছর এলএনজি আমদানিতে ব্যয়ের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১৭ হাজার ৬৯২ কোটি টাকা।
অন্যদিকে উচ্চমূল্যে আমদানীকৃত এলএনজি বিক্রি বাবদ আয় ধরা হয়েছে ১৪ হাজার ৮৮০ কোটি টাকা। ব্যয়ের বিপরীতে ঘাটতি থাকবে ২ হাজার ৮১২ কোটি টাকা। দেশে কম মূল্যে এলএনজি বিক্রিতে এ অর্থ ভর্তুকি দেবে সরকার। এরই মধ্যে পেট্রোবাংলার অনুকূলে জরুরি ভিত্তিতে ভর্তুকির অর্থ ছাড়ের জন্য অর্থ বিভাগকে অনুরোধ করেছে জ্বালানি বিভাগ।
জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান  বলেন, ইউরোপ অঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম বেড়ে গেছে। শুরুতে স্পট মার্কেট থেকে কম দামে এলএনজি কেনা গিয়েছিল। বর্তমানে বাজারমূল্য বেশ চড়া। তবে এলএনজির দাম আন্তর্জাতিক বাজারে মে থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কম থাকে। ওই সময় স্পট থেকে কিনে রাখা হবে।
বিইআরসি আদেশ অনুযায়ী চলতি অর্থবছর গ্যাস উৎপাদন ও এলএনজি আমদানিসহ গ্যাস সরবরাহের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৭৯  কোটি ঘনমিটার। প্রতি ঘনমিটারে ৫ টাকা ৪৮ পয়সা আয়ের পরও আমদানি ব্যয় মেটাতে ২ টাকা ২১ পয়সা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সরকারকে।  সে হিসেবে মোট সরবরাহকৃত গ্যাসে ভর্তুকির পরিমাণ দাঁড়ায় ৬ হাজার ৮০৬ কোটি টাকা। ২০১৯-২০ অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে আড়াই হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছিল। তবে চলতি অর্থবছর ভর্তুকির পরিমাণ ৩১২ কোটি টাকা বাড়ানো হয়েছে।
ভর্তুকির বিষয়ে জানতে চাইলে পেট্রোবাংলার ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতি অর্থবছর গ্যাস খাতে যে পরিমাণ ভর্তুকি চাওয়া হয় তার অর্ধেক অর্থ মেলে। ফলে ভর্তুকির দায় টেনে বেড়াতে হয় পেট্রোবাংলাকে। এবার এলএনজির বাজার অস্থির।
দেশে এলএনজি আমদানি শুরু হওয়ায় ২০১৮-১৯ অর্থবছর প্রথমবারের মতো এ খাতে ১ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয় সরকার। কিন্তু ওই অর্থবছর ৫ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ভর্তুকি চেয়ে চিঠি দেয় পেট্রোবাংলা। পরের অর্থবছর এলএনজি আমদানিতে ভর্তুকি দেয় প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
এদিকে জ্বালানি বিভাগের ওই চিঠিতে দ্রুত অর্থছাড়ের বিষয়টি বলা হয়েছে। কারণ আমদানীকৃত এলএনজির বিল পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে পরিশোধ ও নির্দিষ্ট সময়ে এলএনজি আমদানির বিল পরিশোধে ব্যর্থ হলে বিলম্ব বিল ও লেবার চার্জ ৪-৫ শতাংশ হারে জরিমানা দিতে
আন্তর্জাতিক বাজারে দফায় দফায় এলএনজির দাম বাড়ার ফলে জ্বালানি এ পণ্যটি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এলএনজি-নির্ভরতা না বাড়িয়ে এ বিপুল অর্থ দেশের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে কাজে লাগানো গেলে আমদানি-নির্ভরতা কমিয়ে আনা যেত।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক বদরুল ইমাম বলেন, প্রতি বছর এলএনজি আমদানিতে সরকারকে যে পরিমাণ ভর্তুকি দিতে হচ্ছে, সেই অর্থে দেশের অভ্যন্তরে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালালে নতুন গ্যাস পাওয়ার সুযোগ তৈরি হতো। আমাদের এলএনজি আমদানির প্রয়োজন রয়েছে। তবে যে জ্বালানির মূল্য আমাদের হাতে নেই, সেটা নিয়ে মহাপরিকল্পনা করা অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
গ্যাস সংকটের কারণে গত কয়েক বছর বাসাবাড়ির পাশাপাশি শিল্পেও নতুন সংযোগ বন্ধ রাখে সরকার। এলএনজি আমদানি করে শিল্পে নতুন করে সংযোগ দেয়া শুরুর পর গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেয় কোম্পানিগুলো। এ নিয়ে শুনানিও হয়। গ্যাসের দাম বাড়ানোর এ উদ্যোগকে চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে রিট করে কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।
 আদালত গ্যাস কোম্পানিগুলোর অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধের ওপর গুরুত্ব দেয়ার নির্দেশনা দেয়। তার পর থেকেই গ্যাসের দাম বাড়ানোর বিষয়টি ঝুলে আছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চড়া দামে আমদানি করা এলএনজি সরবরাহে বাড়তি ভর্তুকি রাখা হচ্ছে বাজেটে।
প্রাকৃতিক গ্যাসের সংকট বিবেচনায় ২০১৮ সালের ২৫ এপ্রিল এলএনজি আমদানি শুরু করে সরকার। সামিট এলএনজি ও যুক্তরাষ্ট্রের এক্সেলারেট এনার্জির স্থাপন করা ভাসমান টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে আমদানীকৃত এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। প্রতিটি এফএসআরইউর সক্ষমতা দৈনিক ৫০ কোটি ঘনফুট। তিন-চার বছরের মধ্যে প্রতিদিন ৪০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি আমদানির পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। বর্তমানে জাতীয় গ্যাস সঞ্চালন লাইনে প্রতিদিন ৬০০ মিলিয়ন ঘনফুট এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ