শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বছরে ১ হাজার কোটি টাকার শুঁটকি রফতানি করা সম্ভব

মুহাম্মদ নূরে আলম : শুঁটকি ভোজনরসিকদের কাছে খুবই মজার ও আকর্ষণীয় একটি খাবার। বাঙালিরা তো বটেই, বিদেশিরাও শুঁটকি খাচ্ছে আগ্রহভরে। তাই দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও শুঁটকি রপ্তানি হচ্ছে। দেশে সামুদ্রিক মাছের শুঁটকির অভ্যন্তরীণ বাজার বাদ দিলেও শুধু রফতানি বাজারই আছে অন্তত ৫০০ কোটি টাকার। সঠিক পরিকল্পনা ও প্রশিক্ষণ পেলে বছরে প্রায় ১ হাজার কোটি টাকার শুঁটকি মাছ রফতানি করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেন এইখাত সংশ্লিষ্টরা। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে উচ্ছিষ্ট মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণির শুঁটকির বাণিজ্য। জেলেরা জানান, প্রতি বছর শুঁটকির মৌসুমে অবাঞ্ছিত মাছ ও সামুদ্রিক প্রাণির শুঁটকি বিক্রি হয় প্রায় ৩০০ কোটি টাকার। দেশের রপ্তানি পণ্য তালিকায় শুঁটকি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। দেশে উৎপাদিত বিভিন্ন জাতের শুঁটকি মধ্যপ্রাচ্য, পাকিস্তান, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, হংকং, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইয়, শ্রীলংকা, নেপাল, ভুটান, বার্মাসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হচ্ছে। বিদেশে শুঁটকি রফতানি করে  দেশের শুঁটকি ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। শুঁটকি রপ্তানি শুরু হয় কয়েক দশক আগে থেকে। প্রাথমিক অবস্থায় স্বল্প পরিমাণে রপ্তানি হলেও সম্প্রতি তা বেড়েছে এবং তা বেসরকারি উদ্যোগে। শুঁটকি এখন মাছের বিকল্প খাবার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। শুধু সুস্বাদু খাবার হিসেবে নয়, দেশের পোলট্রি এবং মৎস্য খামারে শুঁটকি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ব্যবসায়ীদের দাবি, মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার ও প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকানো এই শুটকি মানসম্মত হওয়ায় চাহিদা রয়েছে ব্যাপক। বিদেশেও রফতানি হচ্ছে। রপ্তানিকারকরা জানিয়েছেন, বিদেশের বাজারে যে পরিমাণ শুঁটকির চাহিদা রয়েছে সেই পরিমাণ রপ্তানি করা সম্ভব হচ্ছে না। বিদেশে শুঁটকি রপ্তানিতে সরাসরি সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে রফতানি আরো বৃদ্ধি পেতো বলে ব্যবসায়ীরা জানান। তবে বিভিন্ন সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও শুঁটকি রফতানি বাড়ছে।
বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে শুঁটকি তৈরি হয় ১০ হাজার থেকে ১২ হাজার টন। এর অধিকাংশ প্রাকৃতিক উপায়ে অর্থাৎ রৌদ্রে শুকিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। শুঁটকি তৈরিতে ১৬টি কারখানা ইতোমধ্যে গড়ে উঠেছে যেখানে রোদের পরিবর্তে বিদ্যুতের তাপে মাছ শুকানো হয়।
শীত মৌসুমের শুরুতে দেশের ১৫টি উপকূলীয় জেলার উপকূলে পুরোদমে চলছে শুঁটকি তৈরি। শীত মৌসুম তাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে কক্সবাজার, বাগেরহাট, বরগুনা, চট্রগ্রামের উপকূলের শুটকি পল্লীগুলো। পুরোদমে চলছে দেশের সর্ববৃহৎ শুটকি মহাল নাজিরারটেকে সামুদ্রিক মাছ শুকানোর কাজ। সাগর থেকে ট্রলারে আনা ছুরি, কোরাল, সুরমা, লইট্ট্যাসহ নানা প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ ধুয়ে বাঁশের মাচায় বা খুঁটিতে রোদে দিচ্ছেন শ্রমিকরা। ৩ থেকে ৭ দিনের মধ্যে এসব মাছ শুকিয়ে তৈরি হচ্ছে শুটকি। শুটকি তৈরির কাজে কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ২০ লাখ নারী-পুরুষের। সামুদ্রিক মাছের শুঁটকির মধ্যে ছুরি, লইট্যা, সুন্দরী,  রূপচান্দা, টেকচান্দা, কোরাল, লাক্ষ্যা, সুরমা, পোপা, মাটিয়া, চিংড়ি, ফাইস্যা, ফাতরা, রিস্যা, হাঙর, রিঠা, বাচা, রুপালী ইলিশসহ বিভিন্ন প্রজাতির শুঁটকি তৈরিতে ব্যস্ত মহালগুলোর শ্রমিকেরা।
দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা কক্সবাজারের নুনিয়াছড়া এবং নাজিরারটেকে বর্তমানে প্রায় ৩০টির মত রপ্তানিমুখী শুঁটকির কারখানা রয়েছে। এসব কারখানায় শুঁটকি ডিহাইড্রেড করে রফতানি উপযোগী করা হয়। বাংলাদেশ ডিহাইড্রেড সী ফুডস রপ্তানিকারক সমিতি ২০০৬ সাল থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর ডিহাইড্রেড শুঁটকি রফতানি করে গড়ে প্রায় দুইশ’ কোটি টাকা আয় করেছে। আমাদের দেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা কক্সবাজার, টেকনাফ, কুতুবদিয়া, রাঙ্গাদিয়া, মহেশখালী, সোনাদিয়া, খুরুশকূল, ঘোরকঘাটা, চকরিয়া, সেন্টমার্টিন, বাংলাবাজার, কক্সবাজার এয়ারপোর্ট বিচসহ খুলনার বিভিন্ন এলাকায় শুঁটকি তৈরি ও প্রক্রিয়াজাত হয়ে থাকে। সমুদ্র্র উপকূলবর্তী এলাকার মানুষের অন্যতম পেশা হচ্ছে সমুদ্র থেকে মাছ আহরণ করে শুঁটকি উৎপাদন করা।     
তথ্যানুযায়ী, সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকার প্রায় ২০ লাখ লোক শুঁটকি সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কর্মকান্ডের সাথে সম্পৃক্ত রয়েছে। প্রাকৃতিকভাবে উৎপাদিত শুঁটকির মানের চেয়ে বৈজ্ঞানিক উপায়ে উৎপাদিত শুঁটকির গুণগত মান ভালো। এটি স্বাস্থ্যসম্মতও। অপরদিকে মিঠাপানির মাছের শুঁটকির মধ্যে রয়েছে পাবদা, টেংরা, শোল, গজার, পুঁটি ইত্যাদি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাপকভিত্তিতে শুঁটকি রফতানির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়া হলে প্রতিবছর প্রচুর পরিমাণে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের সাথে সাথে দেশের শুঁটকি শিল্পে বিপুলসংখ্যক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হতে পারে। মেকানিক্যাল ফিশ ড্রায়ার ও প্রচলিত পদ্ধতিতে শুকিয়ে তৈরি করা হচ্ছে শুটকি। যা নিরাপদ ও মানসম্মত হওয়ায় ব্যাপক চাহিদা রয়েছে বলে জানালেন ব্যবসায়ীরা। আর মৎস্য ব্যবসায়ী নেতা জানালেন, সরকারি সহযোগিতা পেলে শতভাগ মানসম্মত শুটকি বিদেশে আরও বেশি রফতানি সম্ভব।
কক্সবাজারের নাজিরারটেক মৎস্য ব্যবসায়ী বহুমুখী সমবায় সমিতির নেতা আতাউর রহমান কায়সার গণমাধ্যমকে বলেন, এ বছর আমরা ১ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ লাখ ৭০ হাজার টন শুটকি রফতানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি। গেল বছর নাজিরারটেকে উৎপাদন হয় ১ লাখ ৩০ হাজার মেট্রিক টন শুটকি। এবার লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৭০ হাজার মেট্রিক টন। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেঁষে জেগে ওঠা সুন্দরবনের দুবলার চরের শুঁটকিপল্লীতে প্রতি মৌসুমে ২০ হাজার মণ গুঁড়া শুঁটকি উৎপাদিত হয় বলে জানান জেলেরা। অন্যদিকে কক্সবাজারের নাজিরারটেক থেকে প্রতি সপ্তাহে ১৫-২০ ট্রাক শুঁটকির গুঁড়া বিক্রি হয়। প্রতি ট্রাকে ২০-২৫ টন করে গুঁড়া পরিবহন করা যায়। নভেম্বর থেকে মৌসুম শুরু হয়ে টানা নয় মাস চলে এ ব্যবসা।  
ঢাকার ব্যবসায়ী আসলাম উদ্দিন গণমাধ্যমকে জানান, দেশে মাছ ও গবাদি পশুর খাবার তৈরির প্রায় ৬০ শতাংশ শুঁটকির গুঁড়া নাজিরারটেকসহ যেসব এলাকায় শুঁটকির গুঁড়া উৎপাদন হয়, সেখান থেকে আসে। তবে নাজিরারটেক থেকেই সবচেয়ে বেশি জোগান হয়। বাকি প্রায় ৪০ শতাংশ গুঁড়া আমদানি করতে হয়।  
শুঁটকি উৎপাদকরা জানান, বঙ্গোপসাগরে পাতানো ভাসমান ও টং জালে আহরিত সামুদ্রিক বিভিন্ন প্রজাতির মাছ জেলেদের নৌকা থেকে উঠানো হচ্ছে। সেখানে জেলেদের কাছ থেকে পছন্দের মাছগুলো কিনে মহালে নিয়ে যাচ্ছে ব্যবসায়ীরা। এসব মাছ প্রথমে মহালে সংরক্ষণ করা হয়। সেখানে চিংড়ি ও ফাইস্যা জাতীয় মাছগুলো বিছানো পলিথিনে ছিটিয়ে শুকানো হয়। রায়পুর ইউনিয়নের গলাঘাটার ঘাট থেকে বার আউলিয়া পর্যন্ত দুই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে চলছে শুটকি শুকানোর কাজ। এতে শতাধিক নারী-পুরুষ শুটকি শুকানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন।
তবে, সাগরে মাছ ধরা পড়ছে কম, তাই এবার জেলেদের কাছ থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছ। এমনটা জানিয়ে পেকুয়ার রাজাখালীর ব্যবসায়ী মোহাম্মদ রিদোয়ান গণমাধ্যমকে বলেন, এখানকার উৎপাদিত শুটকি স্বাদে ও মানে প্রসিদ্ধ হওয়ায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিক্রির জন্য নেয়া হয়। শুঁটকির মৌসুমে মহেশখালী থেকে সপ্তাহে ৮০ থেকে ৯০ টন শুঁটকি মাছ ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন এলাকায় পাঠানো হয়। খুচরা বাজারে প্রতি কেজি লইট্যা ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা, ফাইস্যা ৩৫০ থেকে ৪৫০ টাকা, ছুরি ৭০০ থেকে ৯৫০ টাকা, ছোট চিংড়ি ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা, ছোট পোয়া ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা, রইস্যা ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা, রূপচাঁদা ১৫০০ থেকে ১৮০০ টাকা, লাক্ষা ১৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা, মাইট্যা ৫০০ থেকে ৭০০, বড় চিংড়ি (চাগাইচা) ১৩০০ থেকে ১৫০০ টাকা। এ ছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ বিভিন্ন দামে বিক্রি হয়ে থাকে।
সূত্রে জানা গেছে বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর প্রায় ৬২৩ মেট্রিক টন শুঁটকি বিদেশে রফতানি করা হয় (২০১৭-১৮ অর্থবছরে হিসাব)। দেশে ৮-১০ প্রজাতির সামুদ্রিক মাছ বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি করা হয়। সচেতন মহলের অভিমত, সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে, জেলেদের দাদনমুক্ত করা গেলে এবং শুঁটকি বাজারজাতকরণের সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে উপকূলের শুঁটকি বিরাট সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিতে পারে।
কক্সবাজার জেলার মৎস্য অফিস সূত্রে জানাযায়, অন্যান্য বছরের মতো এবারও শুটকির উৎপাদন শুরু হয়েছে। এ কাজে স্থানীয় লোকজন ও বিভিন্ন উপজেলার শ্রমিক ব্যবসায়ীরা মাছ ধরা থেকে শুরু করে শুকানো কাজে ব্যস্ত সময় পার করছে। জেলে ও ব্যবসায়ীরা যাতে নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে পারে সে জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। উপকূলে প্রায় বিভিন্ন শুঁটকি মহালে প্রচলিত নিয়মে শুটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। বিষমুক্ত শুটকি উৎপাদনের ক্ষেত্রে জেলেদের সচেতনতামূলক পরামর্শ দেয়া হয়েছে। ডিডিটি পাউডার বা কীটনাশক না মেশালে শুটকির প্রকৃত স্বাদ পাওয়া যাবে। এখানকার শুঁটকি দেশের বাইরে রফতানি হচ্ছে। প্রকৃত স্বাদ ধরে রাখতে যাতে কোনো ধরণের ডিডিটি পাউডার বা কীটনাশক না মেশাতে না পারে দিকেও নজর রয়েছে।
মহেশখালীর নিবন্ধিত অনিবন্ধিত প্রায় ১০ হাজার জেলে দুর্যোগসহ বিভিন্ন ঝুঁকি নিয়ে শুঁটকি উৎপাদন করেন। এ খাত থেকে সরকার কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করে। এ ব্যাপারে মহেশখালী উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে জানান, মাছের প্রজনন সময়ে মাছ আহরণ বিরত রাখার কারণে বর্তমান সময়ে সাগর থেকে প্রচুর মাছ আহরণ করতে পারছেন জেলেরা। ফলে চলতি মৌসুমে শুঁটকি তৈরির জন্য পর্যাপ্ত মাছের জোগান পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন সংশ্লিষ্টরা; যা থেকে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব হবে বলে আশা করছেন তারা।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ