শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অন্ধকারের আলো বেগম রোকেয়া

ড. শারমিন ইসলাম : শিয়ালদহ স্টেশনের প্লাটফরমে ভরা সন্ধ্যার সময় এক ভদ্রলোক ট্রেনের অপেক্ষায় পায়চারি করিতেছিলেন। কিছু দূরে আর একজন ভদ্রলোক দাঁড়াইয়া ছিলেন। তাঁহার পার্শ্বে বিছানা ইত্যাদি ছিল। পূর্বোক্ত ভদ্রলোক কিঞ্চিত ক্লান্তি বোধ করায় উক্ত গাদার উপর বসিতে গেলেন, তিনি বসিবা মাত্র বিছানা নড়িয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ সভয়ে লাফাইয়া উঠিলেন। এমন সময় সেই দ-ায়মান ভদ্রলোক দৌড়াইয়া আসিয়া সক্রোধে বলিলেন ‘মশায় করেন কি? আপনি স্ত্রীলোকদের মাথার উপর বসিতে গেলেন কেন? বেচারা হতভম্ব হইয়া বলিলেন, মাপ করবেন মশায়! সন্ধ্যায় আঁধারে ভালোমত দেখিতে পারি নাই, তাই বিছানার গাদা মনে করিয়া বসিয়াছিলাম। বিছানা নড়িয়া উঠায় আমি ভয় পাইয়াছিলাম যে, একি ব্যাপার।১

এটি উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের একটি সত্য ঘটনা। সময়টা ছিল বাঙ্গালী মুসলিম সমাজ তথা সমগ্র ভারতীয় মুসলিম সমাজের জন্য এক চরম ক্রান্তিলগ্ন। বৃটিশ শাসকের অধীনে মুসলিম সমাজ আর্থ-সামাজিকভাবেও ছিল বিপর্যস্ত। তাছাড়া ইসলামের মূল আদর্শ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কারণে মুসলিম সমাজে নানাবিধ কুসংস্কারের প্রভাবও লক্ষণীয় যার ফলশ্রুতিতে পর্দার দোহাই দিয়ে উপরোক্ত ঘটনায় বর্ণিত মেয়েটিকে এভাবে নাস্তানাবুদ করা হয়েছে। মেয়েরা তখন পণ্যদ্রব্যের মত ব্যবহৃত হত। তারা তাদের ব্যক্তিগত, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় অধিকার হতে ছিল নিদারুণ বঞ্চিত। যুগসন্ধির এ রকম এক কঠিন ক্ষণে জন্মগ্রহণ করেন বাংলার কিংবদন্তী নারী, মহান সমাজ সংস্কারক নারী জাগরণের পথিকৃত বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)।

মানুষের চিন্তাচেতনা, আবেগ-অনুভূতি, আচার-আচরণ ইত্যাদি সাজিক পারিপার্শ্বিকতার নির্মাতা নাকি পারিপার্শ্বিক সমাজ কাঠামোই মানুষের চালিকাশক্তি এ নিয়ে দার্শনিকদের মধ্যে বিতর্ক আছে। আমরা সে বিতর্কে যাব না। বস্তুত: এ জগতে একশ্রেণির মানুষ জন্ম নেয় এবং গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে জীবনপাত করে একদিন পরপারে চলে যায়। আরেক শ্রেণির মানুষ আছে যারা তাদের সময়ের তুলনায় অনেক বেশি অগ্রসর এবং পুরাতন ঘুণেধরা সমাজের যা কিছু অসংগতি আছে তা তাদেরকে নাড়া দেয় প্রবলভাবে। মানুষের ক্লান্ত অবদমিত আত্মচেতনাকে আলোকস্পর্শে জাগিয়ে তোলাই যেন এদের জীবনের মূল উদ্দেশ্য। বেগম রোকেয়া তাঁদেরই একজন।

১৮৮০ সালে রংপুর জেলার অন্তর্গত পায়রাবন্দ গ্রামে বেগম রোকেয়ার জন্ম। তাঁর পিতা জহীর মোহাম্মদ আবু আলী সাবের সম্ভ্রান্ত ভূ-স্বামী ছিলেন। তাঁর দুই পুত্র আবুল আসাদ ইব্রাহীম সাবের ও খলীল সাবের এবং তিন কন্যা করিমুন্নেসা, রোকেয়া ও হোমেরা। রোকেয়ার দুই ভাই ছিলেন ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত এবং জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা ইব্রাহীম সাবেরের ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে করিমুন্নেসা ও রোকেয়া ইংরেজি শিক্ষায় যথেষ্ঠ ব্যুৎপত্তি লাভ করেন। আনুমানিক ১৩ বৎসর বয়সে বিহারের অর্šÍগত ভাগলপুরের সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের সাথে তিনি পরিণয় সূত্রে আবদ্ধ হন। তিনি ছিলেন পেশায় ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট। পরবর্তীতে রোকেয়ার জ্ঞানচক্ষু দিনে দিনে আরও বেশি উন্মোচিত হয় অত্যন্ত উদারচেতা ও মননশীল স্বামীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টা ও সহযোগিতার কারণে।

প্রকৃতপক্ষে, উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের কিংবদন্তী মহীয়সী নারী বেগম রোকেয়ার পরিচয় আমাদের সামনে দু’ভাবে প্রতিভাত হয়। কিছু ধর্মনিরপেক্ষ বুদ্ধিজীবীর(?) রচনায় রোকেয়ার যে ভাবমূর্তি ফুটে ওঠে তাতে মনে হয় তিনি অত্যন্ত টিপিক্যাল অর্থে নারীবাদী, পুরুষ বিদ্বেষী পাশ্চাত্যবাদী ও ইসলাম বিদ্বেষী ছিলেন। আবার, কুরআন হাদীসের যথার্থ জ্ঞানবর্জিত বিছু ইসলামপন্থী তার লেখার বিরোধিতা করেছেন। আসলে দু’টো দৃষ্টিভঙ্গিই একপেশে। সত্যিকার অর্থে তিনি একজন বড় ইসলামী চিন্তাবিদ, শিক্ষানুরাগী ও সর্বোপরি সমাজ সংস্কারক ছিলেন। যুগসন্ধির এক কঠিন সময়ে আত্মপরিচয় উদ্ধারের মহান ব্রত মনেপ্রাণে গ্রহণ করেছিলেন বেগম রোকেয়া। তিনি তৎকালীন সমাজ ব্যবস্থার নানা অসংগতি, নর-নারীর বৈষম্য, অবরোধ প্রথা, অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটি, কৃষক ও কৃষি ব্যবস্থার সংস্কার, কুটির শিল্পের অবক্ষয় প্রভৃতি বিষয়ে অত্যন্ত সুগভীর আলোচনা করেছেন। এছাড়া সম্ভাব্য প্রতিকার ও সংশোধনের উপায় ও নির্দেশ করেছেন।

 শিক্ষা মানুষের অন্তর্নিহিত শক্তি ও সম্ভাবনাকে জাগ্রত করে। এর মাধ্যমেই মানুষের সৃজনশীলতা ও চিন্তাশক্তি বিকশিত হয় এবং বুদ্ধিবৃত্তি শাণিত হয়। অথচ তৎকালীন বাংলার মুসলিম নারীদেরকে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত রাখা হয়েছিল যা রোকেয়াকে করেছিল দারুণভাবে বিচলিত। মুসলমানদের কাছে তাঁর প্রশ্ন, ‘মুসলমান যাঁহারা স্বীয় পয়গম্বরের নামে কিংবা ভগ্ন মসজিদের একখন্ড ইস্টকের অবমানায় প্রাণদানে প্রস্তুত হন, তাঁহারা পয়গাম্বরের সত্য আদেশ পালনে বিমুখ কেন? কন্যাকে শিক্ষা দেয়া আমাদের প্রিয় নবী ফরয (অবশ্য পালনীয় কর্তব্য) বলিয়াছেন, তবু কেন তাহারা কন্যার শিক্ষায় উদাসীন?”২

অত্যন্ত বিচক্ষণ, আত্মপ্রত্যয়শীল ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন রোকেয়া মনেপ্রাণে অনুধাবন করেছিলেন যে, শিক্ষার বিমল জ্যোতির প্রভাবে নারী মনে সচেতনতা ও আত্মসম্মানবোধ জাগ্রত হয়ে উঠতে পারে এবং সমাজে নারী তার নিজ অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হয়। তাঁর মতে, অনেকে মনে করেন, নারীদের উচ্চ শিক্ষার প্রয়োজন নাই, তারা শুধু অন্ত:পুরে থেকে রান্নাবান্না, সেলাইকর্ম ও দুই চারটা উপন্যাস পাঠ করতে পারলেই যথেষ্ট। কিন্তু ডাক্তাররা বলেন, যেহেতু মাতার দোষ গুণ নিয়ে সন্তান জন্ম নেয়, কাজেই মাতা সুশিক্ষিত হওয়া অত্যাবশ্যকীয়।

নারী শিক্ষা বিস্তারের পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করার উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল। এটিই কলিকাতার বুকে প্রথম মুসলিম বালিকা বিদ্যালয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ যেটা সেটা রোকেয়া সেখানে কুরআন শিক্ষা বাধ্যতামূলক করেছিলেন। সাথে ইংরেজি শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থাও এতে ছিল। কুরআন শিক্ষা বলতে তিনি শুধু টিয়া পাখির মতো আরবী শব্দ আবৃত্তি বুঝাননি, কুরআনের অর্থ অনুধাবন করে তা নিজেদের জীবন পরিচালনার কাজে লাগানোর কথা বুঝিয়েছিলেন। এ জন্য তিনি সরকারকে বাধ্যতামূলক আইন পাশের পরামর্শ দেন। একটি সুন্দর উপমার সাহায্যে তিনি কুরআনের অর্থ হৃদয়ঙ্গমের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন এভাবে,

“যদি কেউ অসুখ হলে ডাক্তার দেখিয়ে তাঁর কাছ থেকে Prescription নেয় কিন্তু সেই Prescription  অনুযায়ী ওষুধ না খেয়ে বরং সেটা মাদুলী রূপে গলায় ঝুলিয়ে রাখে আর রোজ ৩ বার পাঠ করে, তাতে তার কি কোন উপকার হবে?

তেমনি আমরা যদি কুরআন শরীফের অর্থ না বুঝে অনর্গল পড়ি আর অতি যতেœর সাথে কাপড়ের থলিতে উচ্চস্থানে তুলে রাখি তাতে আমাদের কি কোন কাজে আসবে? ............প্রকৃত কথা এই যে, প্রাথমিক শিক্ষা বলিতে যাহা কিছু শিক্ষা দেওয়া হয়, সেই সমস্ত ব্যবস্থাই কুরআনে পাওয়া যায়। আমাদের ধর্ম ও সমাজ অক্ষুন্ন রাখিবার জন্য কুরআন শিক্ষা একান্ত প্রয়োজন।

নারীর উপর পুরুষের অন্যায় প্রভুত্ব রোকেয়াকে পীড়িত করেছিল এবং সামাজিক কুপ্রথার আশু পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে তিনি নারী জাতিকে নতুন করে জেগে উঠার আহ্বান জানিয়েছেন। মূলত: ইসলামে নারী-পুরুষের মধ্যে প্রভু বলে কেউ নেই। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তা’আলা বলেন,

“হে মানব জাতি আমরা তোমাদেরকে সৃষ্টি করেছি মাত্র এক জোড়া নারী-পুরুষ থেকে। পরে তোমাদেরকে বিভক্ত করে দিয়েছি বিভিন্ন জাতি ও গোত্রে যেন তোমরা পরস্পরকে চিনতে পার (এজন্য নয় যে, তোমরা পরস্পরকে অবজ্ঞা করবে)। নিঃসন্দেহে তোমাদের মধ্যে সেই ব্যক্তি আল্লাহর নিকট সর্বাধিক সম্মানিত যে তোমাদের মধ্যে সর্বাধিক ন্যায়পরায়ণ। অবশ্যই আল্লাহ সকল ব্যাপারে পূর্ণজ্ঞানী এবং উত্তমরূপে অবহিত।”৪

প্রকৃতপক্ষে রাসূলুল্লাহ (সা:) ১৫০০ বছর পূর্বে মদীনার বুঝে যে ইসলামী রাষ্ট্র গঠন করেছিলেন সেখানে নারী-পুরুষ সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাজে সমভাবে অংশ নিয়েছিল। “কিন্তু শত শত বছরের আবর্তনে মুসলিম নারীর এই ঐতিহ্যময় কর্মকান্ড তার উন্নত নীতিমালা ও বিধিবিধানগুলো আস্তে আস্তে নানাবিধ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন হয়ে জরাজীর্ণ ও নিস্তেজ হয়ে পড়ে। কালক্রমে ১৪০০ হিজরীর প্রথম দিকে এসে তা’কিম্ভূত-কিমাকার রূপ ধারণ করে। (চলবে)

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ