কবি নজরুল এক অনন্য স্রষ্টার নাম
সৈয়দ আলী হাকিম: প্রত্যেক মানুষ জন্মগতভাবে পৃথিবীর আর সব মানুষ থেকে অতুলনীয়, অনন্য ও অসাধারণ। হযরত আদম (আ.) থেকে আজ পর্যন্ত যতো মানুষ জন্ম নিয়েছেন এবং আগামীতে যতো মানুষ জন্ম নেবেন প্রত্যেক মানুষ অন্য মানুষ থেকে অতুলনীয়, অনন্য ও অসাধারণ। একজনের আঙুলের ছাপ পৃথিবীর আর কারোও সাথে যেমন মিলবে না, তেমনি একজনের চোখের মনি রেখার সাথে পৃথিবীর আর কারোও মনি রেখার মিল হবে না। একজনের ডিএনএ-র সাথে আর কারোও ডিএনএ-র মিল হয় না-এমনিভাবে দেখা যায় প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই রয়েছে অনন্য-অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। এ-সব অনন্য, অসাধারণত্ব প্রকৃতিগত এবং জন্মগত। কিন্তু এ নিবন্ধে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে মানুষের কর্ম, সৃষ্টি, যোগ্যতা, খ্যাতি, সুনাম প্রভৃতির উপর নির্ভর অর্জিত অনন্য ও অসাধারণ দিক নিয়ে। বাংলাদেশের জাতীয় কবি, বিশ্ব কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ব সাহিত্যের এক বিস্ময়কর প্রতিভার নাম। তাঁর প্রতিভার স্ফূরণ, অনন্য, অসাধারণ কর্ম ও সৃষ্টি এ পৃথিবী দেখতে শুরু করে যখন তাঁর বয়স আট-নয় বছর তখন থেকে। আলোচ্য প্রবন্ধে কবি নজরুলের সেই সব দিক সমূহ তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে।
‘নজরুল’ নামটাই বিশ্বে প্রথম
কবি নজরুল ইসলাম এর ‘নজরুল’ নাম বিশ্বে প্রথম। তার আগে কোনো মুসলমান এমনকি অন্য ধর্মাবলম্বী কোনো মানুষের নাম ‘নজরুল’ ছিল বলে জানা যায় না। তার পারিবারিক নাম ছিল ‘নজর আলি’। নজরুলের আম্মা নজরুলকে ‘নজর আলি’ বলেই ডাকতেন। গ্রামের অনেকে তাকে সংক্ষেপে ‘নুরু’ বলে ডাকতেন। কেউ কেউ আবার তাকে ‘তারা খ্যাপা’ ডাকতো। (সুত্র-মুজাফফর আহমদের গ্রন্থের ৬৩-৬৪ পৃষ্ঠা)। কবি নিজেই তার নাম ‘কাজী নজরুল এসলাম’ পরে ‘কাজী নজরুল ইসলাম’ লিখতেন। সওগাত পত্রিকায় একবার তার নাম ‘মৌ. কাজি নাজিরুল ইসলাম’ লেখে। আবার ১৯২৬ সালের নির্বাচনের সময়ও কবির নাম ‘কাজি নাজিরুল ইসলাম’ লিখতে দেখা গেছে। এটা ভুল মুদ্রণ কি-না সন্দেহ রয়েছে। (সূত্র -বিদ্রোহী রণক্লান্ত-গোলাম মুর্শিদ, পৃষ্ঠা ২৩-২৪)
১৯৪২ সালের পরে কবি নজরুল অন্তত দু’বার নিজের নাম সই করেন ’সৈয়দ নজরুল ইসলাম’ বলে। (সূত্র-গোলাম মুরশিদের,‘বিদ্রোহী রণক্লান্ত, পৃষ্ঠা -১০২) ২৩ মে ১৯২৬ সালে ‘দ্য বেঙ্গলি’ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে নজরুলের নাম ইংরেজিতে লেখা হয়, যার বাংলা উচ্চারণ হয় নজর উল বা নাজারুল। এ ভাবে কাজী নজরুল ইসলাম নামের অনেক রূপান্তর, পরিবর্তন, পরিমার্জন ও বিকৃতিও দেখা যায়।
উপাধি পাওয়ার ক্ষেত্রেও কবি নজরুলের রয়েছে অসাধারণ রেকর্ড
কবি নজরুলের নিজের নামের যেমন রয়েছে বৈচিত্র ও বিবর্তন তেমনি উপাধি পাওয়ার ক্ষেত্রেও তার রয়েছে বিশাল সংখ্যা। সেই শিশুকালে পেয়েছিলেন ‘দুখু মিয়া’। তারপর-ওস্তাদ, বাউন্ডেলে, ডানপিঠে, ব্যঙাচী, গোদা কবি প্রভৃতি। বিদ্রোহী কবিতায় কবি নিজেই নিজের উপাধি দিয়েছেন শতাধিক। তারপর বিভিন্ন জনের ভালো-মন্দ মিলিয়ে আরও এক শতাধিক। যেমন বিদ্রোহী, সাম্যের কবি, মানবতার কবি, যুগ¯্রষ্টার কবি, জাতীয় কবি। রবীন্দ্রনাথ তাকে ‘উন্মাদ’ যেমন বলেছেন তেমনি ‘জগৎ খ্যাত’ বা ‘বিশ্ব খ্যাত’ বলেছেন। বাংলাদেশের উচ্চ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ বিভিন্ন সময় বক্তৃতাকালে তাকে ‘বাঙালির জাতীয় কবি’ বাংলাদেশের ‘জাতীয় কবি’ প্রভৃতি বলার পাশাপাশি ‘বিশ্ব কবি’ ও বলেন। বলবেন নাই বা কেনো? পৃথিবীতে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দেশতো একটা-ই বাংলাদেশ। সেই দেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। পৃথিবীর যত দেশে বাংলাদেশের ভাষা ও সাহিত্যকে যখনই তুলে ধরা হয় তখনই জাতীয় কবি হিসাবে কবি নজরুলকে আগে তুলে ধরা হয়। তাছাড়া কবি নজরুলের কিছু বক্তব্য আছে যা বিশ্বজনীন গুরুত্ব বহন করে। যেমন-(১) মিথ্যা শুনিনি ভাই, /এ হৃদয়ের চেয়ে বড় কোনো মন্দির-কাবা নাই। (২) বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণ কর/অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর। (৩) গাহি সাম্যের গান/মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহিয়ান। প্রভৃতি বিশ্ব জনীন মানবতাবাদী, নারীবাদী ও অসাম্প্রদায়িক বক্তব্য কবি নজরুলকে বিশ্বকবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছে। এ প্রসঙ্গে আর একটি তথ্য দেয়া আবশ্যিক মনে করছি যে, ২০০৩ সালে কবি নজরুলের জন্মদিন উপলক্ষে খুলনা মহানগরীর ডি আলী ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রাঙ্গণে দিনব্যাপী নজরুল মেলা অনুষ্ঠিত হয়। মেলার প্রতিবেদনে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘বিশ্বকবি’ উপাধিতে অভিষিক্ত করা হয়। এমনিভাবে বিভিন্ন গুণীজন কবি নজরুলকে বিভিন্ন উপাধি দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন। আমি নিজে এর একটা তালিকা করেছি, তাতে দেখা গেছে কবি নজরুলের দুর্নাম-সুনাম উপাধির সংখ্যা দুই শতাধিক।
শিশু-কিশোর বয়সে ওস্তাদ ও ইমামতির দায়িত্ব পাওয়া
নজরুল তাঁর চাচা বজলুল করিমের কাছে বাংলা, ইংরেজি ও ফার্সি এবং মক্তবে আরবী ভাষা শিক্ষা অর্জন করতে থাকেন। মক্তবে নজরুল তার প্রতিভার গুণে ওস্তাদের মর্যাদা পান, পাশের মসজিদের ইমামের দায়িত্ব পান। গ্রামে মোল্লাগীরির (মিলাদ মাহফিলের কাজ, কোরআন পাঠ শিক্ষা দেয়া প্রভৃতি), এতো অল্প বয়সে এ ধরনের যোগ্যতা অর্জন খুব বেশি সাধারণ ঘটনা নয়। অনেকে প্রশ্ন করেন নজরুল কিভাবে এতো অল্প বয়সে ইমামতির মতো গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পেয়েছিলেন ? এর কারণ হিসাবে গবেষকগণ বলেন, কবি নজরুলের জন্মস্থান বর্ধমানের চুরুলিয়া গ্রাম এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা যেমন কম ছিল তেমনি তারা শিক্ষাদীক্ষায় অনগ্রসর ছিলেন। স্থানীয় মসজিদে ইমামতি করার মতো ইসলামী জ্ঞান সম্পন্ন লোকের অভাব ছিল। শিশু-কিশোর বয়সী নজরুল স্থানীয় মক্তবের সেরা মেধাবী তালবে এলেম (ছাত্র) হওয়ার কারণে স্থানীয় মসজিদের প্রধান ইমাম কোনো কারণে ছুটিতে গেলে কিশোর নজরুলকে ইমামতি করার দায়িত্ব দিয়ে যেতেন।
‘গোদাকবি’ (বড়ো কবি) উপাধী পাওয়া
কিশোর বয়সে কবি নজরুল স্থানীয় লেটো দলে (কবিতা, পালা গানের দল) যোগদান করেন। রচনা করেন অনেক কবিতা, গান, পালা গান। নিজেও গান গাইতে শুরু করেন, অভিনয় করতে শুরু করেন। প্রতিভার গুণে ‘গোদাকবি’ (বড়ো কবি) হিসাবে হয়ে ওঠেন। কিশোর বয়সে কবি হিসেবে এ রকম খেতাব পাওয়ার নজির সাহিত্য জগতে খুবই কমই আছে।
বাংলা ভাষায় প্রথম কাব্যে দরখাস্ত লেখা
কবি নজরুল রানীগঞ্জের শিয়ারশোল রাজ হাইস্কুলে যখন প্রথম ভর্তি হতে যান তখন তাকে প্রধান শিক্ষক ভর্তি করতে চাননি। কবি নজরুল তখন ভর্তির পুনর্বিবেচনার জন্য কাব্যের ভাষায় দরখাস্ত করেন। ৬ষ্ঠ শ্রেণির একটি ছাত্রের এই অভিনব দরখাস্তের রূপ ও ভাষার শব্দ মাধুর্যে প্রধান শিক্ষক এবং স্কুলের শিক্ষকমন্ডলী এতটাই মুগ্ধ হলেন যে নজরুলকে ভর্তি তো করে নিলেনই পাশাপাশি তার জন্য বিনা বেতনে পড়ার ব্যবস্থা করে দেন। বিনামূল্যে স্কুলের হোস্টেলেই থাকা খাওয়ার ব্যবস্থাও করে দেন। বাংলা ভাষার ইতিহাসে কাব্যে দরখাস্ত লেখার নজির ঐ প্রথম। (সূত্র-বিদ্রোহী রণক্লান্ত-গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা-৩৭-৩৮)
কাব্যে পত্রিকার সম্পাদকীয় লেখা
১৯৪১ সালের অক্টোবর মাসে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক সকালের দৈনিক হিসাবে ‘নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশ করতে উদ্যোগ নেন। কবি নজরুলকে সম্পাদক বানালে পত্রিকা বেশি জনপ্রিয়তা পাবে এটা বুঝে তিনি কবি নজরুলকে সম্পাদক হিসাবে নিয়োগ দেন। কবি নজরুল ঐ পত্রিকার প্রথম সম্পাদকীয় লেখেন কবিতা দিয়ে। কোনো সংবাদ পত্রিকার সম্পাদকীয় কবিতায় লেখার নজির কবি নজরুলই প্রথম স্থাপন করেন। (সূত্র-বিদ্রোহী রণক্লান্ত-পৃষ্ঠা-৪৩১)
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী কবি
কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র বাঙালি খ্যাতিমান সৈনিক কবি (হয়তো বা একমাত্র প্রথম বিশ্ব যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী কবি)। কবি নজরুল প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের সৈনিক হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায়ও সাহিত্যচর্চা করতে থাকেন।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ কবিতার (বিদ্রোহী) কবি
সাহিত্যের প্রতিটি সৃষ্টি অনন্য। কিন্তু সব সৃষ্টি অতুলনীয় ও অসাধারণ নয়। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘বিদ্রোহী’ কবিতাটি কেবল হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাংলা কবিতা নয়, বিশ্ব সাহিত্যেরও শ্রেষ্ঠ কবিতা। আমেরিকান অধ্যাপক (সাহিত্যের) উইলিয়াম হ্যাস্ লি বলেন, ‘বিশ্ব সাহিত্যে দু’টি শ্রেষ্ঠ কবিতা আছে, একটির নাম ‘বিদ্রোহী’ অন্যটির নাম আমি জানি না। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্মুখে কবি নজরুলের কন্ঠে বিদ্রোহী কবিতা শুনে বলেছিলেন-‘সত্যিই তুই আমারে হত্যা করেছিস, তুই একদিন জগৎখ্যাত কবি হবি।’
প্রথম আল কোরআন এর (আমপারার) কাব্য অনুবাদ
কবি নজরুল ইসলাম বাংলা ভাষায় প্রথম আল কোরআন এর ৩০ তম পারা যা আমপারা নামে পরিচিত তার কাব্য অনুবাদ করেন। এই অনুবাদ যথার্থ হয়েছে কিনা তা যাচাই করার জন্য কলকাতা আলিয়া মাদরাসার কয়েকজন আলেমের সম্মুখে তিন দিন ধরে আবৃত্তি করে কবি নজরুল শোনান। উক্ত আলেমগণ কর্তৃক অনুবাদের যথার্থতায় সম্মতি পাওয়ার পর কবি নজরুল কাব্যে আমপারা গ্রন্থাকারে প্রকাশ করেন। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে কবি নজরুল সম্পূর্ণ কোরআন শরিফ কাব্যে অনুবাদ করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। কিন্তু ৪২ বছর বয়সে নজরুল বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দূর্ভাগ্যবশত তা আর হয়ে ওঠেনি। কবি নজরুলের এটিও একটি অনন্য, অসাধারণ সৃষ্টি।
বেতারে প্রথম আজান প্রদানকারী ব্যক্তি
১৯৪২ সালে কালকাতা বেতারের মাধ্যমে একবার আজান ও কোরআন তেলওয়াত প্রচার করা হয়, এবং সেই আজানের মুয়াজ্জিন ও কোরআনের তেলওয়াতকারী ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বেতার জগতের ইতিহাসে ঐটাই ছিল প্রথম আজান ও কোরআন তেলওয়াত প্রচার। যা কবি নজরুলের কন্ঠেই হয়েছিল। কবি নজরুলের এ এক অনন্য সৌভাগ্য বলতে হবে।
ঢাকা বেতার কেন্দ্রের প্রথম গানের গীতিকার কবি নজরুল ইসলাম
ঢাকা বেতার কেন্দ্র উদ্বোধন হয় ১৯৪০ সালের ২৬ আগস্ট। উদ্বোধনী সংগীত (আকাশে আজ ছড়িয়ে দিলাম তোমার গানের ফুল, তোমার গানের মালা গো, কুড়িয়ে তুমি নিও) লেখেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম। খুলনা বেতারের উদ্বোধনী সংগীতও ঐ কবি নজরুলের গান দিয়ে হয় বলে জানা যায়। কবির জীবনে এটিও একটি অনন্য ঘটনা।
বাংলা ভাষায় প্রথম গজল গানের স্রষ্টা
বাংলা ভাষায় ও সাহিত্যে প্রথম গজল গান প্রবেশ করে কবি নজরুলের হাত ধরে। ১৯২৬ সালে কবি নজরুল প্রথম যে গজলটি লেখেন সেটি হলো, ‘বাগিচায় বুলবুলি তুই ফুল শাখাতে দিস্ নে আজি দোল’। এই গজলটি ‘কল্লোল’ পত্রিকায় মাঘ ১৩৩৪ সালে প্রথম ছাপানো হয়। অবশ্য গান বা সংগীতের ক্ষেত্রে নজরুলের অবদান অসাধারণ, তাকে সংগীত জগতের স¤্রাটও বলা হয়।
সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমে গাড়ি ক্রয়
১৯৩১-১৯৩২ সালের দিকে কবি নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের প্রথম সাহিত্যিক যিনি কি না সাহিত্যচর্চার মাধ্যমে প্রাইভেট গাড়ি কিনেছিলেন। তা সে যেসে গাড়ি নয়, তৎকালীন সময়ের অন্যতম বিলাসবহুল ছয় সিলিন্ডার যুক্ত ‘কনভ্যার্টিবল ক্রাইসলার’ গাড়ি। গাড়ির রঙ ছিল খয়েরী। (সূত্র-,৭ ঘড়া,১৯২৯ ও বিদ্রোহী রণক্লান্ত, পৃষ্ঠা-৩৭৪)
কাব্যে নবী (সা.) এর জীবনী রচনা
কবি কাজী নজরুল ইসলাম কাব্যে আমপারা প্রকাশের পাশাপাশি কাব্যে নবী (সা.) এর জীবনী ‘মরু ভাস্কর’ রচনা করেন। কাব্যে নবী (সা.) এর জীবনী রচনাও কবি নজরুলের আর এক অনবদ্য সৃষ্টি। এখানে আর একটি কথা খুব গুরুত্ব সহকারে উল্লেখ করা প্রয়োজন মনে করছি যে, কবি নজরুলের বংশের সদস্য সুবর্ণ কাজী বিভিন্ন তথ্য দিয়ে দাবি করেন যে কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবকে কবি নজরুল ‘বিশ্ব নবী (সা.)’ গ্রন্থের পান্ডুলিপি দেন তথ্যগত কোন ভুল ত্রুটি আছে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু কবি গোলাম মোস্তফা সাহেব পান্ডুলিপিটি পড়ে এতোই অভিভূত হন যে তা নিজের নামে ছাপিয়ে ফেলেন। (কবি গোলাম মোস্তফা সাহেবের মত বড়মাপের মানুষের কাছ থেকে এ ধরণের তন্চকতা নিয়ে সন্দেহ ও প্রশ্ন রয়েছে বলে মনে করি। অন্য দিকে ‘বিশ্ব নবী (সা.)’ গ্রন্থের ভাষা শৈলীতে কবি নজরুলের ভাষা শৈলীর ছাপ রয়েছে। এবিষয়ে আরও গবেষণার দাবি রাখে। )
মিলাদ মাহফিলেও নজরুল গান গেয়েছেন
কবি নজরুল নবী (সা.) এর জীবনী যেমন লিখেছেন তেমনি নবী (সা.) এর জীবনী আলোচনা অনুষ্ঠান মিলাদ মাহফিলেও ইসলামি গান (তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে- প্রভৃতি) গেয়েছেন। কলকাতার দু’টি মুসলিম ছাত্রাবাসের মিলাদ মাহফিলে তিনি এ ইসলামি গান পরিবেশন করেন। (সূত্র-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, গোলম মুরশিদ, পৃষ্ঠা-৩৮১)
বাংলা সাহিত্যে রুশ বিপ্লব
বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে রাশিয়ায় যে বিপ্লব সংঘটিত হয় তা ছিল মূলত তত্ত্বগতভাবে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্যতা প্রতিষ্ঠার মন্ত্র নিয়ে। এই বিপ্লব গোটা পৃথিবীর সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে। বাংলা সাহিত্যে রুশ বিপ্লবের প্রথম ঢেউ আসে কবি নজরুলের কলমের কালি থেকে। নজরুলের ‘বিদ্রোহী’ থেকেই যেন তার যাত্রা শুরু। তারপর তো আর কথাই নেই, লালফৌজের চেতনবানী কবি নজরুলের কালো কালি-সাদা কাগজে আগুন ঝরাতে শুরু করলো। বৃটিশদের রক্ত চক্ষু লাল থেকে আরও লাল হয়ে উঠলো। নজরুলকে থামাতে মরিয়া হয়ে উঠলো ইংরেজ শাসকগোষ্ঠি। তাকে কারাগারে বন্দী করলো, তার বই বাজেয়াপ্ত হলো, তার বিরুদ্ধে গুন্ডা লেলিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হলো। হ্যা সমাজতান্ত্রিক রুশ বিপ্লবের চেতনা প্রথম বাংলা সাহিত্যে সংযুক্তির অনন্য কৃতিত্ব কবি কাজী নজরুল ইসলামেরই। (সূত্র-নারায়ণ চৌধুরীর ‘নজরুল চর্চা, পৃষ্ঠা ৪৯-৫৩)
বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক হাসির গানের রচয়িতা এবং রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক গানের স্রষ্টাও কবি নজরুল
বাংলা সাহিত্যে সর্বাধিক গানের স্রষ্টা কাজী নজরুল। কেবল বাংলা সাহিত্যে নয় বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক গানের শ্রষ্টাও কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গানের সংখ্যা চার থেকে পাঁচ হাজার, কোনো কোনো গবেষকের মতে প্রায় দশ হাজার। গানের সংখ্যার এই পার্থক্যের কারণ, নজরুলের গানের দু’টি খাতা যেমন চুরি হয়েছে তেমনি তাঁর অনেক গান হারিয়ে গেছে, আবার যে যখন গান চেয়েছে নজরুল তখন তারে গান লিখে দিয়েছেন, সে সব গান আর সংরক্ষিত হয়নি। সে সকল অনেক গান হারান দিনের গান বলে শোনাও যায়, তবে গানের কথা, বানী, সুর প্রভৃতি বিবেচনা করে অনেক গবেষক সেগুলি নজরুলের বলে দাবিও করেন। এসব দাবির অনেক গুলির সত্যতাও পাওয়া গেছে। গানের জনপ্রিয়তার দিক দিয়েও নজরুলের গানের সংখ্যা সহ¯্রাধিক। কিছু গান রয়েছে কালজয়ী। শিশুতোষ, হাস্যরসাত্মক, শ্যামা সংগীত, হামদ্, নাত, গজল প্রভৃতি গানের এমন কোনো শাখা নেই যেখানে নজরুল নেই, বাংলা ভাষায় রাজনৈতিক ব্যঙ্গাত্মক গানও নজরুলের হাত ধরেই এসেছে। বাংলা গানে প্রায় সব ধরনের রাগ, তাল, সুর, প্রভৃতি নজরুল প্রয়োগ করেছেন। প্রকৃত প্রস্তাবে কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ব সংগীত জগতের এক অপ্রতিদ্বন্দী সম্রাট।
একটি কবিতা ৪০টিরও বেশী ভাষায় অনুবাদ
বিশ্বে অনেক গ্রন্থ আছে যা বহু ভাষায় অনুবাদ হয়েছে বা হচ্ছে। কিন্তু একক কবিতা হিসাবে কেবল ‘বিদ্রোহী’ কবিতা ৪০টিরও বেশী ভাষায় অনুবাদ হয়েছে। বিশ্বের আর কোনো কবিতার ক্ষেত্রে এরকম হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
কোনো কবিতার (বিদ্রোহী) জনপ্রিয়তার জন্য কোনো পত্রিকার (বিজলী) দ্বিতীয় সংস্করণ মূদ্রিত হয়
১৯২২ সালের ৬ জানুয়ারি নলিনীকান্ত সরকার সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘বিজলী’ পত্রিকায় ‘বিদ্রোহী’ কবিতা প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি প্রকাশের পর বাঙালী পাঠক সমাজে এতখানিই চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে যে ঐ সংখ্যাটি দু’বার ছাপাতে হয়। পত্রিকা জগতের ইতিহাসে এমন নজির নেই যে কোনো কবিতার পাঠক প্রিয়তার জন্য কোনো পত্রিকা দু’বার ছাপাতে হয়েছে। এ যেন কবিতার বিস্ফোরণ।(সূত্র -নজরুল-চরিতমানস, পৃষ্ঠা-৪৫)
সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে জীবন ও জীবিকা চালানো
কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি যিনি সাহিত্য চর্চার মাধ্যমে জীবন ও জীবিকার খরচ নির্বাহ করতেন বা করতে পেরেছিলেন। সেনা বাহিনীতে কিছু দিন চাকুরি করা ছাড়া আর কোথাও তিনি স্থায়ীভাবে চাকুরি করেননি। টুকটাক এক মাস, দুই মাস, তিন মাস বিভিন্ন সময় বিভিন্ন স্থানে কাজ করেছেন। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক চাকুরি বলতে যা বুঝায় তা কিন্তু করেননি। মূলত নিজের ও সংসার পরিচালনার খরচ সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক চর্চার মাধ্যমেই করেছেন। কেবল সংসার পরিচালনা করেননি, গাড়ি, বাড়ি করেছেন, দারোয়ানও রেখেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে কবি নজরুলের পূর্বে আর কেউ এমন পারেননি। (সূত্র-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, গোলাম মুরশিদ, পৃষ্ঠা-১৭৮)
প্রথম মুসলিম চলচিত্রকার
কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন একজন বিশিষ্ট চলচ্চিত্রকার। তিনি কেবল উপমহাদেশের নয় গোটা বিশ্বের প্রথম মুসলিম চলচিত্রকার।
নাট্যকার নজরুল
বাংলা নাট্যচর্চায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এক অতুলনীয় নাম। কবি হিসেবে তার জগৎ জোড়া খ্যাতির কারণে নাট্যকার নজরুলের অনন্য প্রতিভার দিকটি প্রায় সকলের নজর এড়িয়ে গেছে। নাট্যকার নজরুল শতাধিক নাটক রচনা করেন। রেকর্ড নাটক, বেতার নাটক, গীতিনাট্য, মঞ্চনাটক, শিশুতোষ নাটক, পালা নাটক, সকল দিককার নাটক তিনি রচনা করেছেন। রূপকাশ্রয়ী গীতিনাট্য রচনায় আজও কবি নজরুলের অবস্থান অতুলনীয়। নাটক রচনায় বিশেষত মুসলিম নাট্যকারদের কাছে আজও তিনি দিশারী পুরুষ। (সূত্র-কাজী নজরুল ইসলামের নাটক-আরিফুল হক, কান্ডারী হুশিয়ার-পৃষ্ঠা ১৫১)
বাংলা ভাষার গতি পরিবর্তনকারী কবি
কবি নজরুলের সাহিত্যচর্চার পূর্বে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য মূলত নির্ভরশীল ছিল আদি বাংলা, সংস্কৃতি, তদভব, তৎসম, অর্ধতৎসম ও অল্প কিছু বিদেশি শব্দ দ্বারা। কিন্তু কবি নজরুল এসে বাংলা ভাষার এই স্বল্প পরিসরে গন্ডি থেকে বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ারের মতো বেরিয়ে এসে বাংলা ভাষায় প্রবেশ করালেন অসংখ্য আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, ইংরেজি, অন্যান্য বিদেশি, আঞ্চলিক জাতি-উপজাতির অজ¯্র শব্দ। কেবল শব্দ নয় ভাষাও। বাংলা ভাষা তার ক্ষুদ্র পরিসরের গন্ডি থেকে বেরিয়ে বিশাল পরিসরে সংযুক্ত হলো। বাংলা ভাষায় বিদেশি শব্দ গ্রহণ ও প্রয়োগের যে গতি কবি নজরুল সৃষ্টি করে যান, আজও তা চলমান রয়েছে। (সহায়ক সূত্র-নজরুল চর্চা, নারায়ণ চৌধুরী)
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ অসাম্প্রদায়িক কবি
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর অসাম্প্রদায়িক চেতনার কথা বলতে গিয়ে প্রখ্যাত কথা সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় বলেন-‘ভুল হয়ে গেছে বিলকুল, সবকিছু ভাগ হয়ে গেছে ভাগ হয়নিকো নজরুল।’ বস্তুত দ্বিজাতিতত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশে ভাগ হয়ে গেলেও কবি নজরুল উপমহাদেশের সকল মানুষের কাছে সমানভাবে গ্রহণযোগ্য ও সন্মানিত। কবি নজরুল হিন্দু, মুসলমান, খৃষ্টান, বৌদ্ধ, কামার-কুমোর, জেলে, চাষি, উপজাতি, আদিবাসী, মুচি, মেথর, রাজা, বাদশা প্রভৃতি সকল জাতি, গোষ্ঠী, মানুষদেরকে তার সাহিত্যচর্চায় ঠাই দিয়েছেন। এরকম নজির বাংলা সাহিত্যেতো দূরের কথা বিশ্বসাহিত্যেও খুঁজে পাওয়া ভার। আর চিন্তা চেতনায় কবি নজরুল কতটা অসাম্প্রদায়িক হলে নিজের প্রথম সন্তানের ডাক নাম ‘কৃষ্ণ মোহাম্মদ’ দিতে পারেন (ভালো নাম আজাদ কামাল)।
ইন্টারন্যাশনাল সংগীতের প্রথম ভারতীয় অনুবাদক
কবি নজরুলের সময় যে বিশ্ববিশ্রত ‘ইন্টারন্যাশনাল’ সংগীত ছিল তিনি তার প্রথম ভারতীয় অনুবাদক ছিলেন। ‘অন্তরন্যাশনাল’ শিরোনামে কবি নজরুল লেখেন-‘জাগো অনশন বন্দী ওঠরে যত/জগতের লাঞ্ছিত ভাগ্যহত। গানটি ভীমপলশ্রী সুরে।
বাংলা গানে বিদেশি সুর নজরুলের হাত ধরে এসেছে
কবি নজরুল কর্তৃক বাংলা গানে এক অসাধারণ কৃত্তি হলো বিদেশি সুর সংযোজন।
যেমন--
* চমকে চমকে ধীরু ভীরু পায় (আরবি সুরে)
* দূর দ্বীপ বাসিনী, চিনি তোমারে চিনি(দক্ষিণ সমুদ্র দ্বীপের গান)
* মোমের পুতুল মমীর দেশের মেয়ে নেচে যায় (মিসরীয়)
* রুম ঝুম ঝুম ঝুম (মরিসাশ মেলডি) প্রভৃতি।
বাংলা সাহিত্যের ভাবধারা, বিষয়বস্তু ও উপজীব্যের দিক পরিবর্তন
কবি নজরুল পূর্বকালে বাংলা সাহিত্যের ভাব, বিষয় ও উপজীব্য ছিল সমাজের উচ্চবিত্ত শ্রেণি বা বড়জোর মধ্যবিত্ত শ্রেণির জন্য। কিন্তু দূরন্ত নদীর বাঁধভাঙ্গা ¯্রােত যেমন নদীর গতিপথ বদলে দেয়, কবি নজরুল তেমনি বাংলা সাহিত্যের গতি বদলে দিলেন। সাহিত্য হয়ে উঠলো উচ্চবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত মুচি, মেথর, কামার-কুমোর সকলের। সাম্যবাদের গান শোনালেন তাবৎ বিশ্বের কর্ণকূহরে। অনেকে নাক সিটকে নজরুলের এই দূর্বার গতিকে রুখতে চেয়েছিলো। কিন্তু সব বাধাকে খড়কুটোর মতো ভাসিয়ে নিয়ে নজরুল হয়ে উঠলেন ব্যাঙাচি থেকে সাপ, গোদা কবি থেকে বিদ্রোহী কবি, বাঙালির জাতীয় কবি, বাংলাদেশের জাতীয় কবি ও বিশ্ব কবি।
এক কবিতায় কাব্যের সকল রসের ব্যবহার
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর ‘বিদ্রোহী’ কবিতায় কাব্যের যে ৯টি বা ১২টি রস আছে তার প্রায় সবগুলি কমবেশি ব্যবহার করা হয়েছে। বিশ্ব সাহিত্যের কোনো কবিতায় এরকম দৃষ্টান্ত নেই।
বিশ্বে প্রথম ও একমাত্র রণসংগীত বা মার্চ সংগীতের রচয়িতা
‘চলচল’ গীতি কবিতাটি বিশ্ব সাহিত্যের একমাত্র মার্চ বা প্যারেড সংগীত। কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর এ এক অনন্য সৃষ্টি। এই গীতি কবিতাটি অনেক অনুষ্ঠানে কবি নজরুল উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে গাওয়ার কারণে এর সৃষ্টির স্থান ও সময় নিয়ে বিভিন্ন মত পাওয়া যায়। আব্দুল কাদিরের মতে এটি ৩ ফেব্রুয়ারি ১৯২৮ সালে কবি নজরুল ঢাকায় সলিমুল্লাহ হলের হাউজ টিউটর আবুল হোসেন সাহেবের বাড়িতে বসে রচনা করেন এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে গান। অন্যদিকে মুজাফফর আহমদ বলেন, গানটি ১৯২৬সালে কৃষ্ণনগরে যুব সম্মেলনের উদ্বোধনী সংগীতে নজরুল এ গানটি গান। আবার কারোর মতে, গানটি ১৯২৫ সালে বর্ধমানে অনুষ্ঠিত ‘অল বেঙ্গল ইয়ং মেনজ্ মুসলিম কন্ফারেন্সে’ উদ্বোধনী সংগীত হিসাবে কবি নজরুল লিখে ও সুর করে দেন, অন্যরা গায়। এই গীতি কবিতাটি বর্তমান স্বাধীন বাংলাদেশের রণসংগীত। (সূত্র-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, পৃষ্ঠা-৩০০)
কবি নজরুলের এক অনন্য সাধারণ ভবিষ্যত বাণী
কবি নজরুল তাঁর ‘সংকল্প’ কবিতার এক জায়গায় বলেন-‘বিশ্ব জগৎ দেখবো আমি আপন হাতের মুঠোয় পুরে’ আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষ আপন হাতের মুঠোয় পুরে (মোবাইল ফোনের মাধ্যমে) সত্যি সত্যিই বিশ্ব জগৎ দেখছে। সাধারণত মানুষ তার ক্ষমতার দাপট দেখাতে বলে ‘বিশ্বের ক্ষমতা হাতের মুঠোয় রাখবে’। কিন্তু নজরুল সেখানে দেখার কথা বলেছিলেন, যা আজ বৈজ্ঞানিক সত্যরূপে আমরা দেখছি। ভাবুনতো যখন বিশ্বের মানুষ টেলিভিশন তৈরীর খবর ঠিক মত পায়নি, তখন মোবাইলের মতো যন্ত্রে হাতের মুঠোয় বিশ্ব জগৎ দেখার কথা বলা কতটা অবাস্তব ও অবৈজ্ঞানিক কল্পনা ছিলো।
কবি নজরুলকে ও তার কবিতা-গান শোনার জন্য বিনিময় গ্রহণ বা টিকিট কাটা
১৯২৪ সালের ৯ এপ্রিল আলফ্রেড রঙ্গমঞ্চে শিশির কুমার ভাদুড়ী ও তার নাট্য গোষ্ঠী কবি নজরুলকে সংবর্ধণা দেন। দর্শক-শ্রোতা কবি নজরুলকে উপহার হিসেবে তৎকালীন ১৯০০ টাকা উপহার দেন। (সূত্র-কল্লোল পত্রিকা, বৈশাখ-১৩৩১)। ‘সওগাত’ পত্রিকার উদ্যোগে ‘নজরুল রজনী’ উদযাপিত হয়। সেখানে দর্শক-শ্রোতাকে অর্থের বিনিময়ে কবি নজরুলের গান, কবিতা শোনেন। ১৯২৯ সালে কবি নজরুল ইসলাম চট্টগ্রাম ভিক্টোরিয়া ইসলামিয়া হোস্টেল ও মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি’র ৩০তম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উৎসবে নজরুলের গান ও কবিতা শোনার জন্য পাঁচ টাকা প্রবেশ মূল্য নির্ধারণ করা হয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কোনো কবিকে দেখার জন্য, তার কবিতা ও গান শোনার জন্য শ্রোতা-দর্শকদের নিকট থেকে বিনিময় নেয়া বা টিকিট কাটার ঘটনা কবি নজরুলের ক্ষেত্রেই প্রথম। (সূত্র-বাংলাদেশে নজরুল, রশীদ হায়দার, পৃষ্ঠা -১৩৪,ও বিদ্রোহী রণক্লান্ত- পৃষ্ঠা -১৮২)
‘মালেকুশ শুয়ারা’ উপাধি প্রাপ্তি
১৯২৬ সালের জুলাই মাসে কবি নজরুল প্রথম চট্টগ্রামে যান কবি হাবিবউল্লাহ বাহার এর আমন্ত্রণে। সেখানে কবি নজরুলকে বিভিন্ন সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী আন্দারকিল্লা শাহী জামে মসজিদে কবি নজরুলকে সংবর্ধণা দেয়া হয়, ঐ সংবর্ধণা অনুষ্ঠানে মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কবি নজরুলকে ‘মালেকুশ শুয়ারা’ উপাধি প্রদান করা হয়। ‘মালেকুশ শুয়ারা’ শব্দের অর্থ ‘ছন্দের মালিক’। কোনো মসজিদ কমিটির পক্ষ থেকে কোনো কবিকে কোনো খেতাব দেয়ার নজির আর নেই।
মন্দিরে কবি নজরুলকে সংবর্ধণা
মসজিদে কবি নজরুলকে যেমন সংবর্ধণা দেয়া হয় তেমনি মন্দিরেও তাকে সংবর্ধণা দেয়া হয়। ১৯২৯ সালে হিন্দুদের তীর্থস্থান চট্রগ্রাম সীতাকুন্ডু মন্দিরে হিন্দুসভায় কবি নজরুলকে সংবর্ধণা দেওয়া হয়। (সূত্র-বাংলাদেশে নজরুল, রশীদ হায়দার, পৃষ্ঠা -১৩৬)। ভাবুনতো একবার যে কবিকে মসজিদে সংবর্ধণা দেয়া হচ্ছে, সেই কবিকে আবার মন্দিরেও সংবর্ধণা দেয়া হচ্ছে। কী আশ্চর্য! কী অসাধারণ! ঘটনা।
সর্বাধিক বাজেয়াপ্ত কাব্য গ্রন্থের কবি
কবি নজরুল বিশ্ব সাহিত্যের একমাত্র কবি (ভয়ংকর বিদ্রোহী কবি) যার দশটি কাব্য গ্রন্থ সমকালীন ব্রিটিশ রাষ্ট্রযন্ত্রের রোষানলে পড়ে, এরমধ্যে পাঁচটি বাজেয়াপ্ত হয় (‘যুগবাণী’ (প্রবন্ধগ্রন্থ), ‘বিষের বাঁশী’, ‘ভাঙার গান’ ও ‘প্রলয় শিখা’ (কাব্য গ্রন্থ), এবং ‘চন্দ্র বিন্দু’ (সংগীত গ্রন্থ)। ‘যুগবাণী’ গ্রন্থটি কেবল ভারতে বাজেয়াপ্ত হয়নি, এই গ্রন্থটি বার্মায়ও (বর্তমান মায়ানমার) বাজেয়াপ্ত করা হয়। বাকি পাঁচটি গ্রন্থ ( অগ্নিবীণা, সঞ্চিতা, ফণিমনসা ও সর্বহারা (কাব্য গ্রন্থ) এবং ‘রুদ্রমঙ্গল’ (প্রবন্ধগ্রন্থ) বাজেয়াপ্তের অপেক্ষায় ছিল। ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীন না হলে বাকি পাঁচটিও বাজেয়াপ্ত হতো। সাহিত্য জগতে এমন নজীর আর কোনো কবির ক্ষেত্রে এখনো ঘটেনি। (সূত্র-ড. সুশীল কুমার গুপ্ত, নজরুল চরিতমানস, পৃষ্ঠা-৭৯)
কবিকে ভালোবাসার জন্য আত্মহত্যা!
১৯২৪ সালের ২২ থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি মেদিনীপুরে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চারদিন ব্যাপী সাহিত্য সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন ২৩ ফেব্রুয়ারি কবি নজরুলকে সংবর্ধণা দেয়া হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় মেদিনীপুর বাংলা স্কুলে নজরুলকে সংবর্ধণা ও অভিনন্দন পত্র দেয়া হয়। ২৫ ফেব্রুয়ারি মেদিনীপুর মহিলাদের পক্ষ থেকেও কবি নজরুলকে ঐদিন সংবর্ধণা দেয়া হয়। মহিলাদের সংবর্ধণা অনুষ্ঠানে ‘কমলা’ নাম্নী এক স্কুল শিক্ষকের মেয়ে নজরুলের কন্ঠে গান-কবিতা শুনে নিজের গলার হার খুলে কবির গলায় পরিয়ে দেয়। নজরুল আবার তা মেয়েটিকে ফিরিয়েও দেন। মেয়েটির এই কাজে নিন্দা ও অপবাদের ঝড় ওঠে। মেয়েটি তা সহ্য করতে না পেরে এসিড পান করে আত্মহত্যা করে। ঘটনাটি অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ও বেদনাদায়ক। তবে কবিতা, গান ও কবিকে ভালোবাসার কারণে এ ধরণের ঘটনা বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমনকি বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেছে বলে আমাদের জানা নেই। (সূত্র-বাংলা সাহিত্যে নজরুল- আজহারউদ্দীন খান পৃষ্ঠা-৩৭ ও জৈাষ্ঠের ঝড়-অচিন্তিত্য কুমার সেনগুপ্ত, পৃষ্ঠা -১৬৯)
কোনো প্রতিষ্ঠিত কবির রাজনৈতিক দল গঠন ও নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করা
কবি নজরুল ১৯২৫ সালের নভেম্বর মাসে হেমন্ত কুমার সরকার, কুতুবউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন হোসেন প্রমুখ ব্যক্তিদের নিয়ে ‘দি লেবার স্বরাজ পার্টি অব ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। দলটির পরিবর্তিত নাম ‘শ্রমিক-প্রজা-স্বরাজ দল’ এই দলের পত্রিকার নাম ছিল ‘লাঙল’। ১৯২৬ সালের নভেম্বর মাসে কেন্দ্রীয় আইন সভার সভ্যপদে পূর্ব বঙ্গের ঢাকা-ফরিদপুর আসনে কংগ্রেস দলের প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নেন। অবশ্য তিনি পরাজিত হন। একজন কবির রাজনৈতিক দল গঠন ও রাজনৈতিক নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার দৃষ্টান্ত নজরুল পূর্বে কোনো বাঙ্গালীর ছিল না।
কবিতা লেখার জন্য কারাবরণ
বাংলা সাহিত্য এবং বিশ্ব সাহিত্যে কবিতা লেখার কারণে কারাদন্ড ভোগের ইতিহাস কবি কাজী নজরুল ইসলামের পূর্বে আর কারো হয়েছে বলে আমার জানা নেই। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ‘ধূমকেতু’ পত্রিকার প্রথম বর্ষের ১২শ’ সংখ্যায়’ আনন্দময়ীর আগমনে ‘শিরোনাম কবি নজরুলের কবিতাটি প্রথম প্রকাশিত হয়। এই কবিতাটির বক্তব্য তৎকালীন ইংরেজ শাসকদের গায়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারা কবি নজরুলকে ২৩ নভেম্বর ১৯২২ সালের বেলা বারোটার সময় কুমিল্লা থেকে গ্রেফতার করে। ১৯২৩ সালের ১৬ জানুয়ারি কলকাতার চিফ প্রেসিডেন্সি ম্যাজিস্ট্রেট মি. সুইনহোর কবি নজরুলকে এক বছর (১৫ ডিসেম্বর ১৯২৩ পর্যন্ত) সশ্রম কারাদন্ড দেয়। কবি নজরুলের মুক্তির জন্য দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। (সূত্র-নজরুল চরিতমানস,ড. সুশীল কুমার গুপ্ত)। ‘প্রলয় শিখা’ কাব্য গ্রন্থটি ইংরেজ শাসক বাজেয়াপ্ত করে ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৩০ সালে। গ্রন্থটি বাজেয়াপ্তের পাশাপাশি সরকার কবি নজরুলকে গ্রেফতার করে। পাঁচশত টাকা জামিনে কবির মুক্তি লাভ হলেও কবির ছয়মাস জেল হয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়। পরবর্তীতে ৪ মার্চ ১৯৩১ তারিখে গান্ধী-লর্ড আরউইন চুক্তির ফলে এই কেইস থেকে মুক্ত হন। (সূত্র-নজরুল চরিতমানস, পৃষ্ঠা-৮১)
কারাগারে অনশনকারী কবি
কবি নজরুলের ‘আনন্দময়ীর আগমন’ কবিতা লেখার জন্য এক বছর জেল হয়। প্রথমে তাকে কলকাতার আলিপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে রাখা হয় ১৯২৩ সালের ১৬/১৭ জানুয়ারি থেকে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। সেখানে তিনি ১২৪ ধারা মতে রাজবন্দীর মর্যাদা পাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৪ এপ্রিল তাকে বরহমপুর জেলে পাঠানোর নাম করে হুগলি জেলে পাঠায় রাজবন্দীর মর্যাদা না দিয়ে। কবি নজরুল এর প্রতিবাদে ১৪ এপ্রিল থেকেই অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। বন্ধু, বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন, কবি রবীন্দ্রনাথ, এমনকি কবির মা এসেও সে অনশন ভাঙাতে পারেনি। টানা ৩৯ দিন অনশন করার পর কুমিল্লার কান্দিরপাড় থেকে বিরজাসুন্দরী দেবী এসে ২৩ মে ১৯২৩ সালে লেবুর সরবত পান করিয়ে কবি নজরুলের অনশন ভঙ্গ করান। কারা কর্তৃপক্ষ কবি নজরুলের প্রতি আরও রুষ্ট হয়ে তাকে নির্জন কক্ষে স্থানান্তর করে। সেখানে তাকে ১৯দিন রাখা হয়। ১৮ জুন তাঁকে বহরমপুর জেলে রাজবন্দীর মর্যাদায় নিয়ে রাখা হয়। ১৯২৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর কবি নজরুল কারাবাস থেকে বীর বেশে মুক্তি পান। কারা ফটকে বহরমপুরবাসী অভ্যর্থনা দিয়ে ড. নলিনাক্ষ স্যান্যালের বাড়ী নিয়ে যায়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে কবি নজরুলই প্রথম অনশন ধর্মঘটকারী কবি।
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বসন্ত’ নাটকের উৎসর্গ প্রাপ্তি
কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার রচিত গ্রন্থসমূহ তার পারিবারিক বলয়ের বাইরে কবি নজরুলকেই প্রথম কোনো গ্রন্থ (‘বসন্ত’ নাটক) উৎসর্গ করেন। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর উৎসর্গকৃত গ্রন্থটি পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায়ের মাধ্যমে হুগলি জেলে কবি নজরুলের কাছে পাঠিয়ে দেন। পবিত্র গঙ্গোপাধ্যায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্বৃতি দিয়েছেন, কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন ‘জাতীর জীবনে বসন্ত এনেছে নজরুল।---নজরুলকে আমি ‘বসন্ত’ গীতিনাট্য উৎসর্গ করেছি এবং উৎসর্গ পত্রে তাকে ‘কবি’ বলে অভিহিত করেছি। জানি তোমাদের মধ্যে কেউ কেউ এটা অনুমোদন করতে পারো নি। আমার বিশ্বাস, তারা নজরুলের কবিতা না পড়েই এই মনোভাব পোষণ করেছে। আর পড়ে থাকলেও তারমধ্যে রূপ ও রসের সন্ধান করেনি, অবজ্ঞাভরে চোখ বুলিয়েছে মাত্র।---আমি তাকে (নজরুলকে) সমগ্র অন্তর দিয়ে অকুন্ঠ আশীর্বাদ জানাচ্ছি। আর বলো, কবিতা লেখা যেন কোন কারণেই সে বন্ধ না করে। সৈনিক অনেক মিলবে, কিন্তু যুদ্ধে প্রেরণা যোগাবার কবিও তো চাই।’ বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এটি একটি অসাধারণ ঘটনা। (সূত্র-নজরুল-চরিতমানস, পৃষ্ঠা -৫৮, ৮২)। কবি নজরুল কারাগারে যখন অনশন করছেন তখন তার অনশন ভাঙতে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে টেলিগ্রামটি করেন তার ভাষা ছিল এ রকম- (Give up hunger strike, our literature claims you.)....‘অনশন ত্যাগ করো, আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়।’ ‘আমাদের সাহিত্য তোমাকে চায়’ এই কথাটি কতটা অসাধারণ তা মূল্যায়নের দাবি রাখে। একজন কবির জন্য আমাদের সাহিত্য অপেক্ষা করছে, একজন কবির বাঁচা মরার উপর নির্ভর করছে একটা জাতির সাহিত্যের অগ্রগতি, সমৃদ্ধি, বিকাশ। আর তা বলছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো নোবেল পুরষ্কার প্রাপ্ত কবি-সাহিত্যিক। কবি নজরুলের সাহিত্য প্রতিভার এ এক অসাধারণ স্বীকৃতি। কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এরকম মূল্যায়ন কবি নজরুল সম্পর্কে আরও অনেকবার করেছেন।
কবি নজরুলের বিবাহ
কবি নজরুলের জীবনটাই যেন বৈচিত্র্যময়। ১৯২৩ সালের ১৭ জুন সৈয়দা খাতুন এর সঙ্গে নজরুলের বিবাহ হয়, যদিও সে বিয়ে টেকেনি। ১৯২৪ সালের ২৫ এপ্রিল কবি নজরুলের সঙ্গে ‘দোলন’ বা ‘দুলি’ আসল নাম ‘আশালতা’ দেবী (নজরুলের দেয়া নাম ‘প্রমিলা’)এর বিবাহ ছিল উপমহাদেশের ইতিহাসে কেবল নয় হিন্দু-মুসলিম ইতিহাসেও এক নজিরবিহীন বিবাহের ঘটনা। সাধারণত হিন্দু-মুসলমান বিবাহ হয় হিন্দু ছেলে বা মেয়ের ইসলাম ধর্ম কবুল করার পর মুসলিম রীতি অনুযায়ী। কিন্তু নজরুল-প্রমিলার বিবাহ (বর মুসলমান, কনে হিন্দু) হয় কারোরই ধর্মান্তর না ঘটিয়ে ‘আহলুল কিতাব’ ইসলামী নিয়মে। এ ক্ষেত্রে নজরুল হিন্দু ধর্ম গ্রন্থ বেদ কে আসমানী কিতাব হিসাবে বিবেচনায় নিয়ে ইসলামী রীতিতে বিয়ে করেছিলেন। (সূত্র-বিদ্রোহী রণক্লান্ত, পৃষ্ঠা -১৮৬)
নারী ও পুরুষের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠার কবি
কবি নজরুলের পূর্বে অনেক কবি নারী ও পুরুষের মান, সম্মান, অধিকার, মর্যাদা নিয়ে অনেক কথা বলেছেন। কিন্তু কেউ নারী পুরুষের সমমর্যাদা দিয়ে কথা বলেছেন বলে আমার জানা নেই। সম্ভবত কবি নজরুলই প্রথম নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা দিয়ে কথা বলেছেন। ‘নারী’ কবিতায় কবি নজরুল বলেছেন-----
‘সাম্যের গান গাই
আমার চক্ষে পুরুষ রমনী কোন ভেদাভেদ নাই।’
‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।’
এখানে উল্লেখ করা ভালো যে বিশ্ব ইতিহাসে ইসলাম ধর্মই প্রথম নারী ও পুরুষের সমমর্যাদা দিয়েছে। আল কোরআন নারী ও পুরুষ কে একে অন্যের পরিচ্ছদ বলে সমমর্যাদা দিয়েছে। কবি নজরুল কোরআনের বক্তব্যকে যেন কাব্যরূপ দিয়েছেন মাত্র।
কবি কাজী নজরুল ইসলাম আটটি ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেছেন
বাংলা সাহিত্যে কেবল নয়, বিশ্ব সাহিত্যের ইতিহাসে যে ক’জন সাহিত্যিক একাধিক ভাষায় সাহিত্য চর্চা করেন তাদের মধ্যে কবি কাজী নজরুল ইসলাম অতুলনীয়। তিনি তার সাহিত্য চর্চায় সর্বাধিক আটটি ভাষার ব্যবহার করেছেন। বাংলা, ইংরেজি, আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দি, পাঞ্জাবি এবং সংস্কৃতি এই আটটি ভাষায় কবি নজরুল সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা করেন। সাহিত্য-সংস্কৃতিক চর্চার জগতে এ এক অনন্য, অসাধারণ দৃষ্টান্ত। পৃথিবীতে অনেক জ্ঞানী ব্যাক্তি ছিলেন এবং আছেন যারা কবি নজরুল অপেক্ষা অনেক বেশি ভাষায় কথা বলতে ও লিখতে পারলেও সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চর্চা করেননি।
বাঙলার ও বাঙালীর জাতীয় কবি হিসেবে স্বীকৃতি লাভ
সময়টা ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর অপরাহ্ন দুটো, কলকাতা এলবার্ট হল। লোকে লোকারণ্য, তিলধারণের ঠাঁই নাই। ‘নজরুল সংবর্ধণা সমিতির’ (সভাপতি সাহিত্যিক এস, ওয়াজেদ আলী। সম্পাদক ‘কল্লোল’ পত্রিকা সম্পাদক দীনেশ রঞ্জন দাশ ও ‘সওগাত’ পত্রিকার সম্পাদক এম. নাসিরুদ্দিন) আহবানে সভা। সভায় সভাপতিত্ব করছেন আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়। সভায় হাজার লোকের মাঝে উপস্থিত ছিলেন জলধর সেন, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, অপূর্বকুমার চন্দ, করুণানিধান বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈলজানন্দ মুখোপাধ্যায়, প্রেমেন্দ্র মিত্র প্রমুখ প্রবীণ ও নবীন সাহিত্যিক ও সাহিত্য রসিক ব্যাক্তিগণ। এই সভার সভাপতি হিসাবে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় কবি কাজী নজরুল ইসলাম কে ‘বাঙলার কবি, বাঙালীর কবি’ ঘোষণা দেন। উপস্থিত হাজার জনতা উৎফুল্ল চিত্তে করতালির মাধ্যমে ঐ ঘোষণার প্রতি সমর্থন জানায়। সভার পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে একটি অভিনন্দন পত্র ও সোনার দোয়াত-কলম একটি রূপার কাস্কেটে ভরে উপহার হিসেবে দেয়া হয়। অভিনন্দন পত্রের শেষে লেখা হয় ‘গুণমুগ্ধ বাঙালীর পক্ষে’ নজরুল-সংবর্ধণা সমিতির সভ্যবৃন্দ। হাজার বছরের বাঙালী জাতী ও বাঙলা ভাষার ইতিহাসে এই প্রথম কোনো কবিকে বাঙালী জাতীর কবি, বাঙলা ভাষার কবি হিসাবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। (সূত্র-নজরুল চরিতমানস, পৃষ্ঠা-৮৮-৮৯)
অল্প বয়সে (৩০-৩১ বয়সে) জাতীয় কবির মর্যাদা
১৫ ডিসেম্বর ১৯২৯ সালে কবি নজরুলকে পৃথিবীর একটি জাতির (বাঙালি), একটি ভাষার (বাংলা) জাতীয় কবি হিসাবে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হচ্ছে তখন কবির বয়স মাত্র ৩০/৩১ বছর। পৃথিবীর ইতিহাসে নজরুলই সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে জাতীয় কবির মর্যাদা লাভ করেন।
কবি নজরুল বাঙালী জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা ও স্বাধীন স্বত্তার রূপকার
১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতা এলবার্ট হলে কবি নজরুলকে ‘বাঙালীর জাতীয় কবি’ হিসাবে ঘোষণা দেয়ার পর নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু তাকে ‘বাঙালি জাতির স্বপ্নদ্রষ্টা’ বলে আখ্যায়িত করেন। অন্যদিকে ১৯৭২ সালে কবি নজরুলকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে ঢাকায় আনেন এবং তাকে ‘বাঙালীর স্বাধীন সত্তার রূপকার’ বলে উল্লেখ করেন। ঐ সময়ের সরকারি পত্রিকা দৈনিক বাংলা প্রথম পৃষ্ঠার শিরোনামে তা প্রকাশ করে। (সূত্র -‘সমকাল-সংস্কৃতি’ ড,আবুল আজাদ, পৃষ্ঠা-৫৭) বস্তুত নজরুল সাহিত্যে বাঙালী জাতিস্বত্তার বিকাশের পূর্বে বাঙালিরা ছিল উপমহাদেশে আর দশটা জাতি-উপজাতির মত একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মাত্র। কবি নজরুলই প্রথম এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখান। তিনি বলেন, ‘বাঙালি যে দিন ঐক্যবদ্ধ হয়ে বলতে পরবে- ‘বাঙালির বাংলা’ সেদিন তারা অসাধ্য সাধন করবে।-----বাঙলা বাঙালির হোক! বাঙলার জয় হোক! বাঙালির জয় হোক।’ আজ বাঙালির জয় হয়েছে, বাঙালির বাংলাদেশ হয়েছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হয়েছে। কবি নজরুলের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ পেয়েছে।
বিশ্বের বিস্ময়কর প্রতিভাধর কবি কাজী নজরুল ইসলাম
জাতীয় কবি নজরুল গবেষণা পরিষদ খুলনা কর্তৃক ৬/৯/২০১১ সালের এক গবেষণায় নজরুল প্রতিভার বিভিন্ন দিক নিয়ে একটি তালিকা পুস্তিকাকারে প্রকাশ করেছে। তালিকাটির সংক্ষিপ্ত রূপ এখানে তুলে ধরা হলো---কবি নজরুলের ব্যক্তিগত প্রতিভা-১৮টি, সামাজিক প্রতিভা-১২টি, সৈনিক প্রতিভা-৫টি, রাজনৈতিক প্রতিভা-১১টি, বেতার প্রতিভা-৪টি, চলচিত্র প্রতিভা-১১টি, সাংবাদিক প্রতিভা-৪টি, লেটো সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্রতিভা-৫টি, বিভিন্ন ভাষায় সাহিত্য চর্চা-৮টি, অংকন-আল্পনা-১টি, গানে সুর সংযোজন-৪৬টি, লক্ষণগীত-ও তার দশটি ঠাটের জোড়া বিন্যাস-৬টি, নতুন তাল সৃষ্টি-৬টি, ব্যবহৃত তাল-১৪টি, ব্যবহৃত রাগ-৭০টি, নতুন রাগ সৃষ্টি-১৯টি, বিভিন্ন বিষয়ে সাহিত্য চর্চা-৩৯টি, আরবি-ফার্সি কাব্য ভাষার আঠারোটি ছন্দ (১-হযজ,২-রবজ,৩-রমল,৪-মোতাকারেব,৫-সরীএ,৬-খফীফ,৭-ময্তস্,৮-মোজারা,৯-কামেল, ১০ ওয়াফের, ১১-মোতদারিক, ১২-তবীল, ১৩-মদীদ, ১৪-বসীত, ১৫-মন্ সরহ, ১৬-করীব, ১৭-যদীদ, ১৮-মশাকেল) ১৮ টি (সূত্র-কান্ডারী হুশিয়ার, ১৮০ পৃষ্ঠা) অন্যান্য ৩টি, সর্বমোট ৩০৩টি। ভেবে দেখুন একজন মানুষ ৩০৩টি দিকে তার প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন! মানব সভ্যতার ইতিহাসে এতো বহুমুখী প্রতিভার স্ফূরণ আর কোনো মানুষের মধ্যে এসেছে বলে আমার জানা নেই। কবি নজরুল মহান আললাহর এক বিষ্ময়কর সৃষ্টি!
কবি নজরুল ইসলাম যে সকল সম্মাননা পান
কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবি হিসেবে পরিচিতি পাওয়াটাই বড় সম্মাননা। যে সময় গোটা উপমহাদেশের সকল পরাধীন মানুষেরই উচিত ছিল দখলদার ইংরেজ শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলা, বিদ্রোহ করা, সে সময় কবি নজরুলই সর্বোচ্চ হুংকার দিয়ে কথা বলেন, বিদ্রোহ করেন। কবি নজরুল ‘ধুমকেতু’ পত্রিকায় বলেন-‘ও সব স্বরাজ-টরাজ বুঝিনা, চাই ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতা।’ ইংরেজ শাসকগোষ্ঠী তাই কবি নজরুলের উপর ভীষণ রুষ্ট ছিল, তাই তার বিরুদ্ধে রাজদ্রোহীতার অভিযোগ এনে এক বছর সশ্রম কারাদন্ড দেয়। একজন বাঙালী কবি হিসাবে এটাইতো কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর বড় পুরষ্কার -নোবেল প্রাইজ। কারাভোগের পুরস্কার ছাড়াও কবি নজরুল আর যে সব পুরস্কার পান---
* ১৯২৯ সালের ১৫ ডিসেম্বর কলকাতার এ্যালবার্ড হলে বাঙালীর জাতীয় কবি ও যুগ স্রষ্টা কবি হিসাবে সম্মাননা দেয়া হয়।
* ১৯৩২ সালে চট্টগ্রামের আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদে মসজিদ কমিটি এবং মুসল্লীদের পক্ষ থেকে কবি কাজী নজরুল ইসলামকে ‘মালেকুশ শুয়ারা’ অর্থাত সুরেরমালিক খেতাবে ভূষিত করা হয়।
* ১৯৪৫ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ‘জগত্তারিণী স্বর্ণ পদক’।
* ১৯৪৫ সালে ভারত সরকার কর্তৃক পদ্মভূষণ উপাধি লাভ।
* ১৯৬৯ সালে রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্মান সূচক ডি.লিট. উপাধি লাভ।
* ১৯৭৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্মান সূচক ডি. লিট.উপাধি লাভ।
* ১৯৭৫ সালে সাহিত্যে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘২১শে পদক’ দেয়া ও জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়।
* ১৯৭৬ সালে ২৪ মে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কবি নজরুলকে ‘আর্মি ক্রেস্ট’ উপহার দেয়া হয়।
ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ তিনটি দেশের সাহিত্যিক ভাতা প্রাপ্তি
কবি কাজী নজরুল ইসলামই একমাত্র বাঙালি কবি যিনি ভারত ও পাকিস্তান দু’টি দেশের সাহিত্য ভাতা পেতেন ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারত ও বাংলাদেশ উভয় দেশের সাহিত্য ভাতা পেতেন। বলতে গেলে তিনি ভারত,পাকিস্তান ও বাংলাদেশ অর্থাৎ সাহিত্য ভাতা পেয়েছেন।
রাষ্ট্রপ্রধান কর্তৃক কবি নজরুলের কফিন বহন
১৯৭৬ সালে কবি নজরুল ইন্তিকাল করলে তাঁর লাশ কবরস্থ করতে কবির কফিনবাহী খাটিয়া বহন করেছিলেন তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, সেনা প্রধান মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান (পরবর্তী রাষ্ট্রপতি), বিমান বাহিনী প্রধান, নৌ বাহিনী প্রধান। পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো কবির ভাগ্যে পার্থিব এরূপ রাষ্ট্রীয় সন্মান এখন পর্যন্ত কারও হয়নি। আল্লাহ যাকে সন্মান দেন তাঁকে দুনিয়াতেও সন্মান দেন।
রাষ্ট্রী মর্যাদায় শেষ গোসল, কাফন ও দাফন
কবি কাজী নজরুল ইসলাম উপমহাদেশে প্রথম বাঙালী কবি যাকে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। কবি নজরুলের দাফনের সময় বাংলাদেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান উভয়ই উপস্থিত ছিলেন। আর রাষ্ট্রের অন্যান্য উচ্চ পদস্থদের কথা নাইবা উল্লেখ করলাম। কবির কফিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে আনা হলে অপেক্ষমান ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের এক প্লাটুন সৈনিক তাকে বিশটি রাইফেল গর্জনের মাধ্যমে লাস্ট প্রেজেন্ট আর্মস শুরু করে, রেজিমেন্টাল কালার ও পতাকা অবনর্মিত করে। সেকেন্ড রেজিমেন্টের বিউগলে করুণ সুর বেজে ওঠে, একুশ বার তোপধ্বনির পর কবির লাশ কবরে নামানো হয়। মাটি দেয়ার পর রাষ্ট্র, সরকার ও সর্বস্তরের পক্ষ থেকে ফুলেল শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হয়। কবির শেষ গোসলও হয় রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির অন্যতম উপদেষ্টা কর্নেল এম এস হকের তত্ত্বাবধানে পি জি হাসপাতালের স্টুয়ার্ড সৈয়দ নাসির আলী কবিকে শেষ গোসল দেন। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফনের নজির অনেকের হয়তো আছে কিন্তু রাষ্ট্রীয় তত্ত্বাবধানে বা মর্যাদায় শেষ গোসলের নজির কবি নজরুলের পূর্বে কারও হয়েছে বলে জানা নেই। (সূত্র-রবীন্দ্র নজরুল চরিত,-সরকার শাহাবুদ্দীন আহমেদ, পৃষ্ঠা-৬০৭)
কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবন ও কর্মের যে সকল অনন্য, অসাধারণ, অতুলনীয় দিক সমূহের প্রতি এ পর্যন্ত যা কিছু নজরে পড়েছে তা সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে ধরা হলো, যদি কোনো তথ্য-উপাত্তের অসংগতি, অতিরঞ্জন বা ঘাটতি পরিলক্ষিত হয় তবে তা লেখককে জানালে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ থাকব এবং পরবর্তিতে তা সংশোধনের ইচ্ছা পোষণ করছি।
(লেখক পরিচিতি-সভাপতি, জাতীয় কবি নজরুল গবেষণা পরিষদ, খুলনা। মোবাইল নং-০১৯৭৮-০৪৪০৬৫, ইমেইল-[email protected],)