শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মুক্তি সংগ্রামের মহান বীর শহীদ তিতুমীর

অধ্যাপক মুহম্মদ মতিউর রহমান : ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশী প্রান্তরে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা-সূর্য অস্তমিত হয়। এক ষড়যন্ত্রমূলক পাতানো যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলা পরাজিত হন। ২ জুলাই তিনি বন্দী হয়ে ৩ জুলাই ঘাতকের হাতে প্রাণ হারান। সিরাজউদ্দৌলার পতনের সাথে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়।

এরপর নামমাত্র নবাব হলেন ইংরাজদের হাতের ক্রীড়নক বিশ্বাসঘাতক মীর জাফর আলী খাঁ। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী পেল শাসন ও শোষণের অবাধ অধিকার। জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, কৃষ্ণচন্দ্র, নন্দকুমার, মানিকচাঁদ প্রমুখ দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতক, যারা সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে বেনিয়া ইংরাজদের হাতে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসন-ভার তুলে দেয়, তারা তাদের বিশ্বাসঘাতকতার পুরস্কার স্বরূপ অপরিমেয় ধন-সম্পদ, ক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা লাভ করলেও বাংলার সাধারণ মানুষের জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়, দুর্ভাগ্যের অমানিশা-ঘেরা দীর্ঘ নিথর নিস্তব্ধ প্রহর।

ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর নফর, দালাল, কেরানীকুল ও ভাগ্যাণ্বেষী বেকার ভাড়াটিয়া পেশাজীবীগণ হঠাৎ আলাউদ্দিনের আশ্চর্য চেরাগ হাতে পাওয়ার মত এক একজন আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়। নিজ দেশে যাদের মামুলি রুজির ব্যবস্থা ছিল না, পলাশী যুদ্ধের পর তারা রাতারাতি কোটিপতি বনে যায়, তারা কার্যত বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার বিশাল রাজ্যের শাসনভার গ্রহণ করে। অবাধ শোষণ ও লুটপাটের মাধ্যমে বেনিয়া ইংরাজগণ বাংলার বিপুল ধনরাশি ইংল্যান্ডে স্থানান্তরিত করে। ফলে একদিকে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণত হয়, অন্যদিকে বাংলার সম্পদে ইংল্যান্ডে নতুন নতুন ইমারত, নগর ও শিল্প-কারখানা নির্মিত হয়, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জোয়ার সৃষ্টি হয়, শিল্প-বিপ্লব ঘটে। 

এভাবে বাংলার ধন-ভা-ার লুটপাট করে ইংল্যান্ডে নেওয়ার ফলে এখানকার শোষিত, বঞ্চিত জনপদে নেমে আসে মন্বন্তরের কালো ছায়া, লক্ষ লক্ষ ক্ষুধিত মানুষের মর্মভেদী রোনাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে শ্যামলীমা বাংলার বাতাস। ১৭৬৯-৭০ সনের এ মন্বন্তরে তৎকালীন ভারতের গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংস-এর মতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ মানুষ অনাহারে মৃত্যুবরণ করে। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকদের মতে, দুর্ভিক্ষে বাংলার অর্ধেক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। প্রকৃতপক্ষে, মৃত্যুর সঠিক কোন হিসাবই রাখা হয়নি। তবে এ সব অনুমান-আন্দাজ থেকে এ সর্বগ্রাসী মন্বন্তরের ভয়াবহতা সম্পর্কে কিছুটা ধারণা করা চলে।

নবাব সিরাজউদ্দৌলার পতনের পর ইংরাজগণ বিশ্বাসঘাতক মীর জাফরকে নবাবীর তখ্তে অধিষ্ঠিত করে। এজন্য তারা প্রতিশ্রুত বিপুল পরিমাণ অর্থ লাভ করা ছাড়াও নতুন নবাবের নিকট থেকে দফায় দফায় মোটা অংকের এনাম-পুরস্কার পেতে থাকে। এভাবে রাজকোষ শূন্য হয়ে গেলেও ইংরাজদের দাবি ক্রমান্বয়ে বাড়তেই থাকে। মীর জাফর ইংরাজদের ক্রমবর্ধমান দাবি মেটাতে অক্ষম হয়ে পড়েন। এ সুযোগে মীর জাফরের জামাতা মীর কাসিম ইংরাজদেরকে মোটা অংকের ঘুষ দিয়ে মীর জাফরকে গদিচ্যুত করে ১৭৬০ সালের অক্টোবরে নবাবী তখ্তে আসীন হন। 

মীর কাসিম নবাব হয়ে স্বাধীনভাবে দেশ পরিচালনার চেষ্টা করেন। ইংরাজগণ তাঁর মতলব বুঝতে পেরে তাদের একান্ত অনুগত মীর জাফরকে পুনরায় ১৭৬৩ সালের ২৪ জুলাই নবাব বানান। ক্ষমতাচ্যুত মীর কাসিম ইংরাজদের বিরুদ্ধে পরপর তিনটি যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু তিনটি যুদ্ধেই তিনি পরাজিত হন। অবশেষে ১৭৬৪ সালের ২২ অক্টোবর বক্সারের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় বরণ করে মীর কাসিম দিল্লীতে পলায়ন করে আত্মরক্ষা করেন। বহু বছর আত্মগোপন অবস্থায় থাকার পর ১৭৭৭ সালে একজন দীনহীন ভিখারীর ন্যায় দিল্লীর রাজপথে তিনি অসহায় করুণ মৃত্যুবরণ করেন।

১৭৫৭ সালে পলাশী যুদ্ধে পরাজয় বরণের পর মুসলমানরা রাজ্য-হারা হয়, ইংরাজরা তাদেরকে সন্দেহের চোখে দেখে এবং নানাভাবে তারা শোষিত-বঞ্চিত হতে থাকে। অন্যদিকে, বর্ণহিন্দু সম্প্রদায়ের বিশেষ ধনিক-বণিক-প্রভাবশালী শ্রেণি সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ইংরাজদের পক্ষাবলম্বন করায় তারা সহজেই ইংরাজদের বিশ্বাসভাজনে পরিণত হয় এবং সামরিক-বেসামরিক বিভিন্ন পদে নিয়োগ লাভ, ব্যবসা-বাণিজ্যে অবাধ সুবিধা ভোগ ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে সুযোগ-সুবিধা লাভ করে। ফলে নতুন ইংরাজ শাসকদেরকে তারা বিধাতার আশীর্বাদ বলেই মনে করতে থাকে।

কিন্তু পলাশীর যুদ্ধে পরাজিত হবার পর থেকে মুসলমানগণ একদিনের জন্যও ইংরাজদের শাসন মেনে নিতে প্রস্তুত ছিল না। ইংরাজদের বিরুদ্ধে মীর কাসিমের যুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পূর্বেই বাংলার গণ-মানুষ ১৭৬০ সালে প্রথম ইংরাজদের বিরুদ্ধে যে প্রতিরোধ আন্দোলন গড়ে তোলে, এ আন্দোলন ইতিহাসে ‘ফকীর বিদ্রোহ’ নামে পরিচিত। দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর্যন্ত এ বিদ্রোহ বাংলার বিভিন্ন জেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে বিশেষ সক্রিয় ছিল। এরপর ১৮৫৭ সাল পর্যন্ত একশো বছর একে একে ফরায়েজী আন্দোলন, জিহাদ আন্দোলন, সিপাহী বিদ্রোহ প্রভৃতি আযাদী আন্দোলনে মুসলমানরা শরীক হয়ে বিদেশী ইংরাজ শাসকদের বিব্রত করে তোলে। এতে অনেক মুসলিম শহীদ হন এবং সাধারণভাবে বাঙালি মুসলিম নানাভাবে জুলুম-নিপীড়নের শিকার হন। ইংরাজের বিরুদ্ধে এ স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম মহান নায়ক শহীদ মাওলানা সাইয়েদ নেছার আলী তিতুমীর। ‘তিতুমীর’ নামেই তিনি সমধিক পরিচিত। তৎকালিন উপমহাদেশের প্রখ্যাত জিহাদ আন্দোলনের নেতা মওলানা সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তিতুমীর বাংলায় জিহাদ আন্দোলন শুরু করেন। মূলত এটা ছিল ইংরাজ-বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন।  

১৭৮২ সালে সাইয়েদ নেছার আলী তিতুমীর পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগণা জেলার বসিরহাট মহকুমার চাঁদপুর গ্রামে জš§গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মীর হাসান আলী ও মায়ের নাম আবিদা রুকাইয়া খাতুন। কথিত আছে, ছোটবেলায় তিক্ত ঔষধের প্রতি তাঁর আসক্তি থাকায় তাকে ‘তিতা মিয়া’ নামে ডাকা হতো। এ তিতা মিয়াই কালক্রমে বাংলার গৌরব, স্বাধীনতা সংগ্রামের দুঃসাহসী নায়ক শহীদ তিতুমীর নামে ইতিহাসে সুখ্যাতি অর্জন করেন। 

তিতুমীরের পূর্ব-পুরুষগণ ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলীফা শেরে খোদা আলী বিন আবি তালিব (রা)-এর বংশধর। তাঁরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে উপমহাদেশে আগমন করেন। তাঁর পূর্ব-পুরুষদের মধ্যে যিনি প্রথম এদেশে আগমন করেন তাঁর নাম সাইয়েদ শাহাদাত আলী। তাঁর পুত্র সাইয়েদ আব্দুল্লাহ দিল্লীর শাহী দরবার কর্তৃক জাফরপুরের প্রধান বিচারপতি নিযুক্ত হয়ে ‘মীর ইনসাফ’ উপাধিতে ভূষিত হন। সেই থেকে শাহাদাত আলীর বংশধরেরা ‘মীর’ ও ‘সাইয়েদ’ উভয় উপাধিই ব্যবহার করতে থাকেন।

নিজ গ্রামে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে তিতুমীর স্থানীয় মাদ্রাসায় ভর্তি হন। সেখানে কুরআন শরীফ হিফয্ করেন এবং শরীয়ত, তরিকত ও হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেন। এছাড়াও তিনি ফারায়েজ, দর্শন, তাসাওউফ, মান্তিক এবং আরবি ও ফারসি সাহিত্যের বহু গ্রন্থ অধ্যয়ন করেন। মাত্র আঠার বছর বয়সে তাঁর মাদ্রাসার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা সমাপ্ত হয়। তিনি বাংলা, আরবি ও ফারসি ভাষায় অনর্গল বক্তৃতা করতে পারতেন।

তিনি একজন খ্যাতনামা বীর পাহলোয়ান ছিলেন। মাদ্রাসা শিক্ষার সাথে সাথে তিনি তাঁর ওস্তাদ সাইয়েদ নিয়ামতুল্লাহর উৎসাহে স্থানীয় আখড়ায় শরীর চর্চার প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। তিনি কলকাতার সমসাময়িক কালের কয়েকজন খ্যাতনামা পাহলোয়ান আরীফ আলী, মীর লাল মুহম্মদ প্রমুখকে পরাজিত করে একজন খ্যাতিমান বীর পাহলোয়ান হিসাবে পরিচিত হন। এ পাহলোয়ানীর কারণে তিনি এক ফৌজদারী মামলায় জড়িয়ে পড়েন এবং কিছু দিনের জন্য কারাদ- ভোগ করেন।

১৮২২ সালে তিতুমীর হজ্জ্ব ব্রত পালনের জন্য মক্কা শরীফ গমন করেন। সেখানে উপমহাদেশের প্রখ্যাত আলেমেদ্বীন ও মুক্তি সংগ্রামের মহান নায়ক মওলানা সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর সঙ্গে তাঁর মুলাকাত হয়। তিতুমীর তাঁর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন এবং কিছুদিন পর মদীনায় রাসূলুল্লাহর স. রওজা মুবারক জিয়ারতের সময় তিনি মওলানা ব্রেলভীর নিকট থেকে খিলাফত প্রাপ্ত হন। মওলানা ব্রেলভীর নিকট তিনি শরীয়ত ও তরীকতের বাইয়াত গ্রহণের সাথে সাথে জিহাদের প্রেরণা ও মুক্তি-সংগ্রামের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হন।

হজ্জ্বব্রত সমাপন করে তিতুমীর মওলানা ব্রেলভীর সঙ্গে মক্কা, মদীনা, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, ইরান, আফগানিস্তান প্রভৃতি দেশ সফর করে সে সব স্থানের বিভিন্ন মুসলিম মনীষীর সাথে সাক্ষাত করে প্রভূত জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। দেশে ফিরে তিনি নারিকেলবাড়িয়ার নিকটবর্তী হায়দরপুরে খানকা স্থাপন করেন। সেখান থেকেই তিনি সৈয়দ আহমদের সুযোগ্য খলীফা হিসাবে বাংলায় জিহাদ আন্দোলনে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করেন। বাংলার তৎকালিন আর্থ-সামাজিক-ধর্মীয় পটভূমিতে তিতুমীরের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এ সম্পর্কে জনৈক গবেষকের লেখা থেকে কিঞ্চিৎ উদ্ধৃতি দিচ্ছি :

“মারাঠা-বর্গীদের দ্বারা লুন্ঠিত পশ্চিম বাংলায় হিন্দু জমিদার ও নীলকরদের দ্বারা নিষ্পেষিত জনগণ অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ধ্বংসের প্রান্তসীমায় উপনীত হয়েছিল। মুসলমানদের উপর কায়েম হয়েছিল হিন্দুদের সাংস্কৃতিক আধিপত্য। তহবন্দের পরিবর্তে ধুতি, সালামের পরিবর্তে আদাব-নমস্কার, নামের আগে শ্রী ব্যবহার, মুসলমানী নাম রাখতে জমিদারের পূর্বানুমতি ও খারিজানা, হিন্দুদের পূজার জন্য পাঁঠা যোগানো ও চাঁদা দেওয়া, দাড়ির ওপর ট্যাক্স, মসজিদ তৈরি করলে নজরানা, গরু জবাই করলে ডান হাত কেটে নেয়া প্রভৃতি জুলুম ছিল নিত্য দিনের ঘটনা। এই পটভূমিতেই জিহাদ আন্দোলনের বিপ্লবী মন্ত্রে উজ্জীবিত মওলানা তিতুমীর কাজ শুরু করেন। বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করে তিনি জনগণকে তাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করে তোলেন। ধর্মীয় অনুশাসনসমূহ পূর্ণরূপে অনুসরণ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে জিহাদের বীজমন্ত্রে তিনি সকলকে উজ্জীবিত করে তোলেন। বিরান হয়ে যাওয়া মসজিদসমূহ তিনি সংস্কারের ব্যবস্থা করেন এবং সেখানে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযের প্রচলন করেন। তিনি পূজার চাঁদা দান বা তাতে অংশগ্রহণের মতো কাজ বন্ধ করেন। শিরক-বি’দাত বন্ধ করেন। মুসলমানী নাম রাখা, ধুতি ছেড়ে লুঙ্গি পড়া, এক আল্লাহর সাথে কাউকে শরিক না করা, পীরপূজা ও কবরপূজা বন্ধ করা, কোরআন-হাদীসের খেলাপ কোন কাজ না করা, কুসংস্কার ও অনিসলামী কাজের মূলোচ্ছেদ প্রভৃতি ছিল মুসলমানদের ধর্মীয় ও সামাজিক জীবন পুনর্গঠনে তাঁর কর্মসূচীর অন্তর্ভুক্ত।” (দ্র. মোহম্মদ আব্দুল মান্নান : আমাদের জাতিসত্তার বিকাশধারা ২য় সংস্করণ, জুলাই ১৯৯৮, পৃ. ১০১-২)।

তিতুমীর তাঁর মুরশিদ সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভীর ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিন্তাধারায় বাংলাভাষী মুসলমানদেরকে উদ্বুদ্ধ করার প্রয়াস পান। সমসাময়িক কালে পরিচালিত ফরায়জী আন্দোলনের নেতা বিশিষ্ট দ্বীনি ও মুক্তি-আন্দোলনের মহান নেতা হাজী শরীয়তুল্লাহর দৃষ্টিভঙ্গী, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সাথে তাঁর সম্পূর্ণ মিল ছিল। তিতুমীরের চিন্তাদর্শ ও কর্মপন্থা সম্পর্কে বিশিষ্ট লেখক-সাংবাদিক মওলানা জুলফিকার আহমদ কিসমতী বলেন :

“তিনি (তিতুমীর) বলতেন, ইসলাম গ্রহণ করার পর চরিত্রে বৈপরীত্যের লালন সম্পূর্ণ অন্যায়। মুসলমানদেরকে ইসলামে পূর্ণ বিশ্বাসী হয়ে কথায় কাজে ও আচার-আচরণে পুরোপুরি মুসলমান হতে হবে এবং কোন সবল কর্তৃক দুর্বল মুসলমান অত্যাচারিত হতে থাকলে সেই মজলুম মুসলমানের সাহায্য করা অপর মুসলমানের ধর্মীয় কর্তব্য। স্থানীয় হিন্দু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় মুসলমানদের দাড়ি গোঁফ মুসলমানী নাম ও মসজিদের উপর মোটা কর ধার্য করায় শত প্রতিকূলতার মাঝেও তাঁর ঈমানী আগুন প্রজ্জ্বলিত হয়ে ওঠে। ফলে কৃষ্ণ রায় ও তার সহচরদের সাথে মওলানা হাজী সাইয়েদ নেছার আলী তিতুমীরের প্রচ- বিরোধ দেখা দেয়।” (জুলফিকার আহমদ কিসমতী : বাংলাদেশের সংগ্রামী ওলামা পীর-মাশায়েখ, পৃ. ৪৬)।

জমিদার কৃষ্ণ রায় মুসলমানদের দাড়ি, গোঁফ, মসজিদ ও মুসলমানী নামের উপর ট্যাক্স ধার্য, লুঙ্গি পরার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি এবং পূজার জন্য মুসলমানদের উপর চাঁদা ধার্য ও পূজার অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য পীড়াপীড়ি করলে তিতুমীর তার জোর প্রতিবাদ করেন। এ প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে উভয়ের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। জমিদার তিতুমীরকে ওয়াহ্হাবী প্রতিপন্ন করে তাঁর ভক্ত-অনুরক্তদের মধ্যে বিভেদ ও অনৈক্য সৃষ্টির প্রয়াস পায়। কিন্তু মুসলমানগণ জমিদারের কথায় কর্ণপাত করে নি। তারা তিতুমীরের নেতৃত্বে অটল থাকে। ফলে মুসলমানদের উপর জমিদারের অত্যাচারের মাত্রা আরো বৃদ্ধি পায়।

তিতুমীর অত্যন্ত ধৈর্য ও সাহসের সাথে অত্যাচারী জমিদারের অন্যায় ও ইসলাম-বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে ও জমিদারের প্রতিহিংসার মুকাবিলা করতে থাকেন। কিন্তু জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ইংরাজ নীলকরদের সহায়তায় তিতুমীরের অনুসারীদের উপর ক্রমাগত অত্যাচার চালাতে থাকে এবং এ অত্যাচারের ফলে তাঁর কয়েকজন অনুসারী নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। তিতুমীর তখন বাধ্য হয়ে জমিদার ও নীলকর সাহেবদের প্রতিরোধ করার উদ্দেশ্যে একটি শক্তিশালী মুজাহিদ বাহিনী গঠন করে তাদেরকে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্রÑলাঠি, ঢাল, শরকি, তলোয়ার ইত্যাদির দ্বারা সুসজ্জিত করেন। নারিকেলবাড়িয়ায় একটি বাঁশের কেল্লা নির্মাণ করে মুজাহিদ বাহিনীকে সেখানে ট্রেনিং দেয়ার ব্যবস্থা করেন। তিতুমীরের আপন ভাগিনেয় গোলাম মাসুম মুজাহিদ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। মুজাহিদ বাহিনীর সংখ্যা ছিল ৪/৫ হাজার।

তিতুমীরের আন্দোলন ছিল অত্যাচারী, নিষ্ঠুর জমিদারদের বিরুদ্ধেÑনির্যাতীত, নিপীড়িত কৃষকের মুক্তির সপক্ষে। মুসলিম কৃষককুল এমনকি, বহু সংখ্যক অমুসলিম কৃষকও তাঁর আন্দোলনে শরীক হয়। শুধু জমিদারের অত্যাচার ও শোষণের বিরুদ্ধেই নয়, জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধেও ছিল তাঁর আন্দোলন। তাঁর মূল শ্লোগান ছিল : ‘লাঙ্গল যার জমি তার’। তাঁর বক্তব্য ছিল : ‘প্রত্যেকের শ্রমের ফসল তাকেই ভোগ করতে দিতে হবে।’

তাঁর এ শ্লোগান ও বক্তব্য ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করে ও বাংলার ব্যাপক জনপদে কৃষক-শ্রমিকদের মধ্যে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ইংরাজ শাসক সম্প্রদায়ও ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে।

পুঁড়ার জমিদার কৃষ্ণদেব রায় ছাড়াও গোবরা গোবিন্দপুরের জমিদার শ্রীদেবনাথ রায়, ধান্যকুড়িয়ার জমিদার শ্রী রায়বল্লভ, তারাবুনিয়ার জমিদার শ্রী রামনারায়ণ নাগ, নাগরপুরের জমিদার শ্রী গৌরপ্রসাদ চৌধুরী, সরফ-রাজপুরের জমিদার শ্রী কে.পি. মুখার্জী ও কলকাতার গোমস্তা লাটু বাবুরা সকলে তিতুমীরের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়। ইংরাজ নীলকররাও ছিল জমিদারদের পক্ষে। জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিতুমীর যতই প্রতিবাদ মুখর হয়ে ওঠেন, জমিদারদের অত্যাচারের মাত্রাও ততই বৃদ্ধি পায়। তিতুমীরের একজন পত্র-বাহককে পুঁড়ার জমিদার নিষ্ঠুর নির্যাতনের মাধ্যমে হত্যা করে। জমিদারের লোকেরা বশিরহাটের জামে মসজিদ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। মুসলমানদের ঘর-বাড়ি লুটতরাজ করে। এভাবে জমিদাররা একের পর এক তিতুমীরের অনুসারীদের উপর অত্যাচার চালাতে থাকে।

জমিদারের অত্যাচারের মাত্রা যতই বৃদ্ধি পায়, প্রতিবাদের ভাষাও ততই উচ্চকিত হয়। স্থানে স্থানে প্রতিরোধ গড়ে ওঠে। তিতুমীরের নেতৃত্বে মুজাহিদ গণ-বাহিনী জমিদারের লেলিয়ে দেয়া পশু-বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। এসব সংঘর্ষে তিতুমীরের বাহিনীরই জয় হয়। ধীরে ধীরে তিতুমীর সমগ্র চব্বিশ পরগণা, নদীয়া ও ফরিদপুর জেলার অধিকাংশ এলাকা মুক্ত করে সেখানে ইংরাজ শাসন অস্বীকার করে ইসলামী শরীয়ত-ভিত্তিক হুকুমাত কায়েমের ঘোষণা দেন। এতদঞ্চলের নির্যাতিত মুসলিম প্রজাবৃন্দ তিতুমীরের সাথে ছিল। কতিপয় সশস্ত্র ফকীর দলও তিতুমীরের মুজাহিদ বাহিনীতে যোগ দেয়। তিতুমীর একাধারে বেনিয়া ইংরাজ শাসক, জালেম নীলকর সাহেব ও দেশীয় অত্যাচারী হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের নিশান উড়িয়ে দেন।

এবার শুধু জমিদার-নীলকর শ্রেণি নয়; বৃটিশ শাসকেরও টনক নড়ে ওঠে। ফলে এক পূর্ণাঙ্গ লড়াই অনিবার্য হয়ে পড়ে। প্রথমে কলকাতা থেকে ইংরাজ বাহিনী প্রেরিত হয়। তার সাথে জমিদার বাহিনীও যোগ দেয়। ইংরাজ ও জমিদারদের মিলিত বাহিনীর সাথে তিতুমীরের যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে মিলিত বাহিনী পর্যুদস্ত হয়। ফলে তিতুমীরের শক্তি ও সুনাম অধিকতর বৃদ্ধি পায়। অবশেষে ভারতের বড়লাট লর্ড উইলিয়ম বেন্টিঙ্ক ১৮৩১ সালের নভেম্বর মাসে মেজর স্কট হার্ডিং-এর নেতৃত্বে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট, ক্যাপ্টেন সাদারল্যান্ড, ক্যাপ্টেন শেক্সপীয়রসহ এক শো অশ্বারোহী ইংরাজ সৈন্য, তিন শো পদাতিক দেশীয় সৈন্য ও দু’টি কামান সজ্জিত বিরাট বাহিনী তিতুমীরের বিরুদ্ধে প্রেরণ করেন।

১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ফজরের নামাজের পর তিতুমীর তাঁর বাঁশের কেল্লায় অবস্থানরত ৪/৫ হাজার মুজাহিদ বাহিনীর উদ্দেশ্যে তাঁর স্বভাবসুলভ ও তেজস্বী ভাষায় ভাষণ দেন। আওলাদে রাসূল স., কারবালার শহীদদের উত্তরসূরী, বিজ্ঞ আলেমে দ্বীন, স্বাধীনতা সংগ্রামের অকুতোভয় সিপাহসালার সাইয়েদ নেছার আলী তিতুমীর নির্যাতিত মানবতার অধিকার রক্ষা, মুসলমানদের ঈমান ও আমলের হিফাজত, ইসলামের পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও স্বাধীনতা অর্জনে জিহাদে অংশগ্রহণ ও শাহাদতের অমিয় সুধা পানের জন্য সকলকে উদ্বুদ্ধ করেন।

যুদ্ধ শুরুর পূর্বে ইংরাজ সেনাপতি ও তিতুমীরের মধ্যে রামচন্দ্র নামক জনৈক হিন্দু দোভাষীর মাধ্যমে বৈঠক হয়। উক্ত দোভাষী উভয় পক্ষের বক্তব্য বিকৃতভাবে পরিবেশন করায় আলোচনার পরিবেশ বিনষ্ট হয় ও উভয় পক্ষে চরম উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ফলে যুদ্ধের দামামা বেজে ওঠে। তুমুল যুদ্ধ বাঁধে।

একদিকে তীর-ধনুক, তলোয়ার-বল্লম, লাঠি-সোটা ইত্যাদি মামুলী অস্ত্রে সজ্জিত ঈমানী তেজে বলীয়ান মুসলিম বাহিনী অন্যদিকে, অশ্ব, কামান, বন্দুক ইত্যাদি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত ইংরাজ বাহিনী। তাই রণ-কৃতিত্বে নয়; আধুনিক অস্ত্রের বদৌলতেই ইংরাজরা জয়ী হয়। ইংরাজদের গোলার আঘাতে তিতুমীর, তাঁর পুত্র মীর জওহর আলী ও আন্দোলনের অন্যতম নায়ক ময়েজ উদ্দিন বিশ্বাসসহ অসংখ্য যোদ্ধা বীর বিক্রমে যুদ্ধ করে শাহাদত বরণ করেন। তিতুমীরের দুই পুত্র মীর তোরাব আলী, মীর গওহার আলী এবং সেনাপতি গোলাম মাসুমসহ বন্দী হন সাড়ে তিন শো মুজাহিদ। গোলাম মাসুমকে দোষ স্বীকার করে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বলা হলে তিনি ঘৃণা ভরে তা প্রত্যাখ্যান করেন। তিতুমীরের বাঁশের কেল্লার পাশেই এ অকুতোভয় মুক্তি-সংগ্রামী গোলাম মাসুমকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলিয়ে শহীদ করা হয়। বন্দী মুজাহিদদের মধ্যে ১৪০ জনকে কারাদ- দেয়া হয়।

তিতুমীরের আত্মোৎসর্গ আমাদের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এক অতুজ্জ্বল অধ্যায়। অত্যাচারী জমিদার, শোষক নীলকর ও সাম্রাজ্যবাদী ইংরাজদের বিরুদ্ধে একজন সাধারণ মানুষ যে অমিত বিক্রমে দুর্জয় সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন ও অগণিত সাধারণ মানুষকে সে সংগ্রামে অংশগ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেন তা তাঁর ঈমানী শক্তি, চারিত্রিক দৃঢ়তা, অন্যায়, অসত্য ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে সত্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার সংগ্রামে দুর্জয় শপথের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়। তাই তাঁর শাহাদাতের পর ইংরাজ সেনাপতি স্কট মন্তব্য করেন : “যুদ্ধে আমরা জয়ী হয়েছি, কিন্তু জীবন দিয়েছেন একজন ধর্মপ্রাণ দেশপ্রেমিক মহান ব্যক্তি।”

এভাবে মুক্তি-সংগ্রামের ইতিহাস যেমন দীর্ঘ, তেমনি রক্তরঞ্জিত ও ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জ্বল। দীর্ঘ সংগ্রাম-আন্দোলন ও সীমাহীন আত্মত্যাগের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়, তার মূল্য অপরিসীম। এ স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য যে কোনো আত্মত্যাগে দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সর্বদা প্রস্তুত থাকা অপরিহার্য কর্তব্য। দেশী-বিদেশী ষড়যন্ত্রকারীদের হাতের ক্রীড়নকে পরিণত না হয়ে স্বকীয় আদর্শে উদ্বুদ্ধ-অনুপ্রাণিত হয়ে দেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য সর্বদা আমাদের সচেতন থাকা প্রয়োজন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ