শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বিশ্ববিদ্যালয় নয় ॥ বাড়ুক গুণগত শিক্ষা ও গবেষণা

আহসান হাবীব : ‘বিশ্ববিদ্যালয়’ শব্দটি শুনলেই আমাদের মনে ভেসে ওঠে এমন একটি চিত্র যেখানে বিশ্বমানের পাঠদান হয় এবং করা হয় বিশ্বমানের গবেষণা। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই গুণগত শিক্ষার মানে ততটা উন্নত নয়। গুণগত শিক্ষাকে সামগ্রিক উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে বিবেচনা করা হয়। গুণগত শিক্ষা হলো সেই শিক্ষা যা গ্রহণে একজন ছাত্র মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন হবে, দেশ ও জাতির সম্পদে পরিণত হবে, যার থেকে সমাজ উন্নয়নমূখী চিন্তাভাবনা পাবে। মোটকথা, গুণগত শিক্ষার প্রভাবে একজন শিক্ষার্থী তার চিন্তা চেতনাসহ যাবতীয় কাজকর্মের মাধ্যমে তার সমাজ তথা দেশকে এগিয়ে নেবে, পাল্টে দেবে। দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় এরকম জ্ঞানী ও গুণী মানুষ খুব কমই তৈরি হচ্ছে। কারণ দক্ষ কারিগরের অভাবে মানুষ গড়ার কারখানাগুলোতে আজ শুধুই সার্টিফিকেট গড়া হচ্ছে। প্রতিবছরই তাই আন্তর্জাতিক র‌্যাঙ্কিংয়ে পিছিয়ে পড়ছে দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।
আমরা জানি, বিশ্ববিদ্যালয় শুধু জ্ঞান দান করে না, জ্ঞান তৈরিও করে। জ্ঞান তৈরি করার প্রক্রিয়াটির নাম গবেষণা। সম্প্রতি গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদে দেখা গেছে, ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে  দেশের ৪৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজে ব্যয় হয়েছে মাত্র ৬৪ কোটি ১৮ লক্ষ টাকা। অথচ এর পেছনে বাজেট ছিল ৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। আরো ভয়ঙ্কর তথ্য হলো, অর্ধেকের বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনো গবেষণাই হয় না। সুতরাং জ্ঞান তৈরির কারখানা যে প্রায় বিকল তা সহজেই অনুমেয়।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পেছনে পরার  কারণ হিসেবে শিক্ষাবিদগণ বলছেন, শিক্ষকদের যথোপযুক্ত যোগ্যতা একটি প্রশ্নবিদ্ধ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অন্যান্য দেশে শিক্ষক হওয়ার নূন্যতম যোগ্যতা যেখানে পিএইচডি সেখানে বাংলাদেশের শিক্ষকদের অধিকাংশই পিএইচডিতে হাত দেন সহকারী অধ্যাপক পদে আসীন হওয়ার পর। দেশের শিক্ষকগণ বাইরের দেশে তাঁদের চেয়ে নিম্ন পদমর্যাদার শিক্ষকদের অধীনে গবেষণা করছেন। এটিই আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলের তুলনায় আমাদের শিক্ষকদের যোগ্যতাহীনতার একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক কয়েকদিন আগে তার ফেসবুক প্রোফাইলে একটি লেখা দিয়েছেন যার সারকথা মোটামুটি এরকম। ‘মানুষ শেখে তার পরিবেশ থেকে। এটি হতে পারে পরিবার, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং সমাজ। পরিবার থেকে শিক্ষার প্রক্রিয়াটি হলো, কেউ যদি তার সন্তানকে সদুপদেশ দিতে চান তাহলে তাকে নিজেকে সৎ থাকতে হবে। নচেৎ উপদেশে কাজ হবে না। অর্থ্যাৎ কোনো বাবা যদি নিজে অসৎ থেকে তার ছেলেকে সততার শিক্ষা দেন তাহলে কর্ম বিফলে যাওয়ার সম্ভাবনাই কাম্য। কেননা মানুষ শিখতে চায় দেখে, শুনে নয়।’
এমতাবস্থায় যদি আমরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিকে একটি পরিবার ধরি তাহলে এখানে গবেষণার অনুপ্রেরণা পাওয়ার খুব একটা বেশি সম্ভাবনা নেই। উন্নত দেশে শিক্ষকদের পদমর্যাদা বাড়ে কর্মে, চাকরির বয়সে নয়। বাংলাদেশের পদমর্যাদার ক্রম (লেকচারার-সহকারী অধ্যাপক-সহযোগী অধ্যাপক-অধ্যাপক) আর অন্যান্য দেশের শিক্ষকের পদমর্যাদার ক্রমেও রয়েছে বিরাট ভিন্নতা। যেমন অস্ট্রেলিয়ার ক্ষেত্রে একাডেমিক ক্রম হলো: একাডেমিক লেভেল এ (সহযোগী অধ্যাপক লেভেল এ/সহযোগী প্রভাষক)- একাডেমিক লেভেল বি (সহযোগী গবেষক লেভেল বি/প্রভাষক)- একাডেমিক লেভেল সি (সিনিয়র সহযোগী গবেষক/ সিনিয়র প্রভাষক)-একাডেমিক লেভেল ডি (সহযোগী অধ্যাপক)- একাডেমিক লেভেল ই (অধ্যাপক)।
অস্ট্রেলিয়ার ডেকিন বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. শুভংকর বিশ্বাস পত্রিকায় লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে তৈরিকৃত বিদ্যায় পারদর্শিতার ভিত্তিতে অর্থ্যাৎ ক্লাসের প্রথম সারির শিক্ষার্থীদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়।’ এটিকে তিনি একটি পশ্চাদপদ মডেল বলেছেন। তিনি ঠিকই বলেছেন। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে বিশ্বমানের মডেল অনুসরণ করা হবে এটাই স্বাভাবিক।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা আরো করুণ। এতকিছু সত্ত্বেও হুহু করে বাড়ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা। গত বছরেই অনুমোদন দেয়া হয়েছে বেশ কয়েকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের। সেই ধারা অব্যাহত আছে এবছরও, বছরের শুরুতেই পিরোজপুর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদন দিল মন্ত্রিসভা। আমার এক বন্ধু ফেসবুকে যথার্থই লিখেছে, ‘ইউজিসির এবার জন্মনিরোধক পিল খাওয়া দরকার’। কথাটি নিতান্তই ফেলনা নয়। কেননা শিক্ষার মানের দিকে নজর না দিয়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাড়ানো দেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে একটি চরম অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়ার সমতুল্য। এর ফলে বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী হয়তো উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য একটি ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে’ পড়ার সুযোগ পাবে কিন্তু তাকে পড়ে থাকতে হবে পড়াশোনার সেই আবদ্ধ গণ্ডিতেই। যেখানে আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা নেই, সুযোগ্য শিক্ষক নেই, নতুন জ্ঞান তৈরির উদ্যম নেই সেখানে হয়তো ডিগ্রিলাভ হবে, সেই ডিগ্রি দিয়ে চাকরিযোগও হবে। কিন্তু দেশ পিছিয়ে পড়বে সমানুপাতিক হারে।  আর মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর স্বপ্নের ‘সোনার মানুষ’ও পরিণত হবে সামান্যই।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ