শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

করোনা ভাইরাসের প্রিভেনশন সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের পরস্পরবিরোধী সুপারিশ

আসিফ আরসালান : ইদানিং আমাদের জন্য পত্রিকায় কলাম লেখা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘আমাদের’ বলতে বুঝাতে চাচ্ছি সেই সব কলামিস্ট যারা নিরপেক্ষ লেখা লিখতে চান, বস্তুনিষ্ঠ লেখা লিখতে চান। কিন্তু এখন লিখতে গেলেই নিজের কাছেই অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সম্মুখীন হতে হয়। লেখাটি কি সাইবার অ্যাক্টের অধীনে পড়ে? ভাষা কি কঠোর হয়ে যাচ্ছে? আমাদের লেখার ফলে এই দৈনিক পত্রিকাটির কি কোন ক্ষতি হতে পারে? ব্যক্তিগতভাবে আমার কি কোন ক্ষতি হতে পারে? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে হয়। আরো ভাবি, সম্পাদক সাহেব এখনও জেলে আছেন। বিশেষ প্রতিনিধি রুহুল আমিন গাজীও জেলে। কবে বের হবেন সেটি কারো জানা নাই। এসব চিন্তা-ভাবনা মাথায় নিয়ে লিখতে হয়।
পাঠকরা চান, রাজনীতি নিয়ে লিখি। কিন্তু রাজনীতি নিয়ে কি লিখবো? রাজনীতি বলতে যা বোঝায় সেটি কি দেশে আছে? খোলাখুলি বলতে গেলে বলতে হয় যে দেশে রাজনৈতিক বন্ধ্যাত্ব চলছে। সেই বন্ধ্যাত্ব আরো প্রকট হয়েছে করোনার প্রাদুর্ভাবের ফলে এবং সেই করোনা ব্যাপক মহামারি আকারে বিস্তৃতির ফলে। ৯ মাস হলো করোনার আক্রমণ চলছে। এখন আবার শোনা যাচ্ছে, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। ঠান্ডায় কি করোনা বাড়ে? আমরা বিশেষজ্ঞ নই। তাই বলতে পারব না। কিন্তু গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে প্রথম যখন ৩ জন রোগী শনাক্ত হলেন, তার পরেই এই ঠান্ডা গরমের প্রশ্ন ওঠে। বাংলাদেশের আইইডিসিআরের তৎকালীন পরিচালক এবং বর্তমানে অতিরিক্ত মহাপরিচালক মীরজাদী সেব্রিনা ফ্লোরা এবং প্রধান বৈজ্ঞানিক আলমগীর এক সুধী সমাবেশে বলেন যে শীত গ্রীষ্মের সাথে এই ভাইরাসের কোনো সম্পর্ক নাই। এই ভাইরাস কাবু হয় ৫৬০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। কিন্তু এর মৃত্যু ঘটে ১০০০ ডিগ্রী সেলসিয়াসে। বাংলাদেশে গ্রীষ্মকালে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ওঠে ৪০০ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডে। তাও সেটি কদাচিৎ ঘটে। গ্রীষ্মকাল যখন চূড়ায় সেই জুন জুলাইয়ে তাপমাত্রা সাধারণত থাকে ৩৩০ থেকে ৩৭০ ডিগ্রীর মধ্যে। কিন্তু বাংলাদেশে করোনা পিকে উঠেছিল, অর্থাৎ চূড়ায় উঠেছিল জুন জুলাইয়ের পর। আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান ড: ফাহিম ইউনুস বলেন, “গ্রীষ্মে ভাইরাসটি তার প্রভাব হ্রাস করে না। ভারত, ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনায় গ্রীষ্মকালেই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়ায়।”
বাংলাদেশে বলা হচ্ছে যে, শীতকাল এসে যাচ্ছে। এখন বাংলাদেশে করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আসছে। অন্য কথায় শীতকালে করোনা বাড়ে এবং গরমকালে কমে। যাই হোক, সেই বিতর্কে যাব না। কিন্তু দেখা যাচ্ছে করোনা সম্পর্কে এক এক বিশেষজ্ঞ এক এক কথা বলেন। ফলে আমরা যারা সাধারণ মানুষ তারা বিভ্রান্ত হই। করোনার প্রিভেনশন, অর্থাৎ কি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করলে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা কম থাকে সে সম্পর্কে এক এক বিশেষজ্ঞের এক এক রকম মত থাকে। আমি এখানে দুইজন বিশেষজ্ঞের মতামত উদ্ধৃত করছি। দেখা যাবে, তাদের মতামত কেমন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। এদের একজন হলেন ডক্টর বিজন কুমার শীল। তিনি মাইক্রোবায়োলজিস্ট বা অণুজীববিজ্ঞানী। কিছুদিন পূর্বেও তিনি গণস্বাস্থ্য নগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অণুজীব বিভাগের প্রধান ছিলেন। তিনি সিঙ্গাপুরের নাগরিক। ওয়ার্ক পারমিট নিয়ে তিনি বাংলাদেশ কাজ করছিলেন। কিন্তু তার ওয়ার্ক পারমিট এক্সটেন্ড করা হয়নি। ফলে তিনি সিঙ্গাপুর ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছেন। অথচ তার ইচ্ছা ছিল তিনি বাংলাদেশে থেকে যাবেন এবং তার বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বাংলাদেশের চিকিৎসা বিজ্ঞানে কাজে লাগাবেন। আর দ্বিতীয়জন একজন বাংলাদেশী। বর্তমানে আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ বিভাগের প্রধান। তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বিগত ২০ বছর ধরে নানা ধরনের সংক্রামক রোগ নিয়ে কাজ করছেন।
॥ দুই ॥
ড: বিজন শীল বলেন, কোন ধরনের গলা খুসখুস বা কাশি দেখা দিলেই আর অপেক্ষা করা উচিত হবে না। ওটা করোনা বা করোনা নয়, এ নিয়ে চিন্তা করার কোন দরকার নেই। এখানে বলে রাখা ভালো যে বাংলাদেশে করোনার নতুন ঢেউ আসছে বলে বলা হচ্ছে। গত কয়েকদিন ধরে সংক্রমণ এবং মৃত্যুর হার বেড়েছে। তাই এখন প্রিভেন্টিভ স্টেপগুলো সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করা দরকার। সেজন্যই আমরা এই প্রসঙ্গ আবার আলোচনা করছি।
যাই হোক, ডক্টর বিজন শীলের পরামর্শ, গলা খুসখুস করলে বা কাশি দেখা দিলে আর অবহেলা না করে আদা (জিঞ্জার) ও লবঙ্গ (ক্লোব) একসঙ্গে পিষে সেটাকে গরম পানিতে সিদ্ধ করে তার সাথে কিছুটা চা দিয়ে ওটা এক কাপ মত নিয়ে গড়গড়া করে খেতে হবে। দিনে অন্তত তিন-চারবার এক কাপ করে এটা খেতে হবে। এর ফলে গলার ভেতরের কোষগুলোতে রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। এতে কোষগুলো শক্তিশালী হবে। কোষগুলোর ইমিউনিটি বা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়বে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোষগুলো করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ প্রতিরোধে সক্ষম হবে যদি সেটি প্রাথমিক পর্যায়ে থাকে।
যাদের গলা খুসখুস করে না বা কোনো কাশিও দেখা যায়নি তারাও এটি নিয়মিত দিনে দুইবার দুই কাপ খাবেন। তাতে তাদের ইমিউনিটি বাড়বে। এছাড়া কিছুটা নিমপাতা একটু পানি দিয়ে পিষতে হবে। পেষার ফলে যে সবুজ রংয়ের রসটি বের হবে সেটার সঙ্গে গরম পানি মিশিয়ে তা গড়গড়া করে খেতে হবে। এর ফলে গলার কোষগুলোয় রক্ত সঞ্চালন বাড়বে। ফলে  ইমিউনিটি বাড়বে।
ডক্টর বিজন শীল এর মতে গলা খুসখুস কাশি হওয়া করোনার প্রথম স্টেজ। এরপর ফুসফুসের ব্রঙ্কোএ্যালভিয়োলিতে যাওয়া বা সেখানে সংক্রমিত হওয়া। এটি দ্বিতীয় স্টেজ। তৃতীয় স্টেজ হচ্ছে ব্রঙ্কোএ্যালভিয়োলিতে পানি জমা। এটি ক্রিটিক্যাল স্টেজ। এই পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট হয় এবং অক্সিজেন লেভেল কমে যায়।
॥ তিন ॥
ডক্টর বিজন শীলের পরামর্শ হলো, দ্বিতীয় স্তর বা ফুসফুসে সংক্রমণ হওয়ার আগেই প্রথম স্টেজেই ভাইরাসটিকে রুখে দিতে হবে। আর সেজন্যই লবঙ্গ ও আদা থেরাপি এবং নিমপাতার থেরাপি। এই দুটি থেরাপির পাশাপাশি ডঃ বিজন শীল ভিটামিন সি এবং জিংক খাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। এসব ট্যাবলেট বাজারে পাওয়া যায়। তিনি জানান যে, অস্ট্রেলিয়া তাদের দেশের নাগরিকদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জিংক ইনজেকশন দিচ্ছে। অপর এক ইন্টারভিউয়ে তিনি বলেছেন, লবঙ্গ ও আদার সঙ্গে গোলমরিচ মিশিয়ে নিলে ভালো হয়। তেমনি নিম পাতার রসের সাথে এক চামচ হলুদের গুঁড়া মেশালে আরো ভালো ফল পাওয়া যায়।
ডক্টর বিজন শীল আরেকটি থেরাপি দিয়েছেন। সেটি হল গরম পানির ভাপ নেয়া। ডক্টর শীল প্লাজমা থেরাপি কথা বলেছেন। সেটি এখন সকলেই জানেন। তবে তিনি বলেছেন যে সবচেয়ে কার্যকর থেরাপি হচ্ছে, যে ব্যক্তির করোনা হয়েছিল, কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছেন, সেই ব্যক্তির রক্ত যদি করোনা রোগীকে দেয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রে রোগী এবং রক্তদানকারীর ব্লাডগ্রুপ ম্যাচ করতে হবে, অর্থাৎ মিলতে হবে।
ডক্টর বিজন শীলের এসব সুপারিশ বাংলাদেশের বিভিন্ন স্তরের মানুষের মনে বিপুল আলোড়ন তুলেছিল। এখনও বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ বিজন শীল সুপারিশকৃত আদা ও লবণ থেরাপি দিয়ে গারগল করেছেন এবং সেটি খাচ্ছেন। এছাড়া লক্ষ লক্ষ মানুষ গরম পানির ভাপ নিচ্ছেন।
॥ চার ॥
সবকিছু যখন এভাবেই চলছিল তখন গত ১৪ নভেম্বর বাংলাদেশের একটি জাতীয় দৈনিকের প্রথম পৃষ্ঠায় একটি খবর প্রকাশিত হয়। খবরটির শিরোনাম, “করোনা থেকে কিভাবে হবে জীবন রক্ষা/ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. ফাহিম ইউনূসের পরামর্শ”। রিপোর্টটিতে বলা হয় যে ডক্টর ফাহিম ইউনুস আমেরিকার ম্যারিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্রামক রোগ ক্লিনিকের প্রধান। তিনি বিভিন্ন ধরনের ভাইরাস নিয়ে কাজ করছেন প্রায় বিশ বছর ধরে। তিনি করোনা নিয়ে টুইটারে কিছু তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি লিখেছেন, “আমরা কত মাস বা কত বছর ধরে কোভিড-১৯ এর সঙ্গে থাকব, তা কেউ জানিনা। আমাদের সুখে থাকা দরকার। এজন্য দরকার সত্য কথাগুলো জানার”। তার মতে কোভিড থেকে বাঁচার জন্য শুধুমাত্র তিনটি উপায় আছে। এগুলো হলো (১) মাস্ক পরা (২) হাত ধোয়া এবং (৩) ১.৮ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা। উল্লেখ্য, ১ মিটার সমান ৩ ফুট। ১.৮ মিটার সমান প্রায় ৬ ফুট। ডক্টর ফাহিম ইউনুসের মতে এই তিনটি কাজ ভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার সেরা পদ্ধতি। এরপর তিনি যেসব তথ্য দিয়েছেন সেগুলি বিগত ৯ মাস ধরে যেসব তথ্য আমরা পেয়ে আসছি এবং সেই সব তথ্যের ভিত্তিতে যে ধারণা পুষে আসছি তা সর্বাংশে না হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নাকচ করে দেয়। নিচে আমরা তার ফাইন্ডিংস সমূহ তুলে ধরছি।
(১) গ্রীষ্মে ভাইরাসটি তার প্রভাব হ্রাস করে না। ভারত ব্রাজিল এবং আর্জেন্টিনায় গ্রীষ্মকালেই ভাইরাসটি খুব দ্রুত ছড়িয়েছে।
(২) লিটারের পর লিটার গরম পানি খেয়ে কোন লাভ নাই। কারণ সেল ওয়ালে ঢুকে যাওয়া ভাইরাসের কোন ক্ষতি গরমপানি করতে পারে না।
(৩) যদি আপনার বাড়িতে কোভিড-১৯ রোগী না থাকে তাহলে বাড়ির মেঝে, দেওয়াল এবং উপরিভাগের সবকিছুকে জীবাণুমুক্ত করার দরকারও নাই, লাভও নাই।
(৪) কার্গো প্যাকেজ, শপিং ব্যাগ, পেট্রলপাম্প, শপিং কার্ট বা ব্যাংকের এটিএম মেশিন সংক্রমণ সৃষ্টি করে না। আপনার হাত ধুয়ে নেবেন বারবার এবং যথারীতি আপনার জীবন যাপন করবেন।
(৫) কোভিড-১৯ কোন খাদ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে ছড়ায় না। এটি ফ্লুর সংক্রমণের মত হাঁচি-কাশির ফোঁটাগুলির (ড্রপলেট) সাথে সম্পর্কিত। অর্ডার করা খাবার থেকে কোভিড-১৯ সংক্রমণের কোন প্রমাণিত ঝুঁকি পাওয়া যায় না। অর্ডার করা খাবারগুলো মাইক্রোওভেনে প্রয়োজনে গরম করতে পারেন।
(৬) সুয়ানা ভাপ করোনা ভাইরাসকে কখনো হত্যা করতে পারে না। যা একবার আপনার সেলে প্রবেশ করেছে সেটি পানি বা বাষ্প যাই হোক না কেন, কোন উষ্ণতাই তাকে ধ্বংস করতে পারে না।
(৭) গন্ধ না পাওয়া কোভিড-১৯ এর একটি অনির্দিষ্ট লক্ষণ, সুনির্দিষ্ট নয়।
(৮) বাইরে থেকে ফেরার পর তাৎক্ষণিকভাবে জামা কাপড় পরিবর্তন করার বা গোসল করার কোন দরকার নেই। কোভিড ঠেকাতে এর প্রয়োজন নাই।
(৯) এই ভাইরাস বাতাসে ভেসে বেড়ায় না। মানুষের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগেই এর সংক্রমণ ঘটে। তাই আপনি খোলা পার্কে মানুষের সাথে ৬ ফুট দূরত্ব বজায় রেখে ঘুরে আসতে পারেন।
(১০) জুতোর মাধ্যমে কোভিড ছড়ায় না।
(১১) ভিনেগার, সোডা, আদার রস ভাইরাস থেকে রক্ষা করে না।
(১২) সাধারণ মানুষের জন্য সারাক্ষণ গ্লাভস পরার চেয়ে হাত ধোয়াই ভালো।
প্রিয় পাঠক, ওপরের এই ১২ টি পয়েন্ট পড়লে ১০ মাস ধরে লালিত আপনার চিন্তা ধারা এলোমেলো হয়ে যাবে। দুইজন বিশেষজ্ঞের সুপারিশ ও মন্তব্য ওপরে উল্লেখ করলাম। কাকে গ্রহণ করবো? আর কাকে বর্জন করবো? আমার মতে এই বিভ্রান্তি দূর করার একটি মাত্র রাস্তা আছে। আর সেটি হল, পরস্পরবিরোধী মতামত বা সুপারিশের ঊর্ধ্বে উঠে এ ব্যাপারে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (হু) একটি সুনির্দিষ্ট প্রিভেন্টিভ গাইড লাইন তুলে ধরা।
[email protected]

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ