মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

জীবনঘুড়ির আকাশ দেখা

সাজজাদ হোসাইন খান : ॥ সতের ॥ আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল নানাদের পাঠানো নৌকা। ভৈরবপুলের ধারঘেঁষে দাঁড়িয়ে ছিল সেটি। তফাতে আরো অনেক নৌকা মেঘনা ঘাটে।  স্থানীয় লোকেরা বলে গোদারা ঘাট। এসব নৌকা যাত্রী এপার ওপার করে। কোনোটি ছৈ-ওয়ালা, কোনোটি ছৈহীন। আমাদের নৌকাটি আবার অন্য ধরনের, ভিন্ন চেহারার। নৌকার ছৈটি বেশ পরিপাটি করে তৈরি। কাঠামোটি নিখুঁত এবং সুন্দর। ছৈ এর মুখ বরাবর নকশা করা দরজা। লাল নীল এবং হলুদ রংগে ছোপানো। নৌকাটি যে বিশেষ যতœ করে তৈরি, প্রথম নজরেই বোঝা যায়। নৌকাজুড়েই যেন একটা আভিজাত্যের ছাপ। নানা-নানি বা বাড়ির অন্য কোনো সদস্য কোথাও বেড়াতে গেলে এ নৌকাটি ব্যবহার করেন। মাঝিও আছে আলাদা নৌকার। আরো কয়েকটি নৌকা আছে নানাদের। যে গুলো ধান-পাট, মালপত্র আনা-নেওয়ার কাজে ব্যবহার হতো। জুতাটুতা বাইরে রেখে ছৈয়ের ভিতরে ঢুকলাম আমরা। পরিপাটি করে বিছানা পাতা। তোশকের ওপর রংগিন চাদর, সাথে দুটি বালিশ। সে বিছানা থেকে যেনো সরাফতির একটা গন্ধ উঠে আসছিল। আমরা ভিতরে বসলাম। বড় মামা ভিতরবাহির করলেন সারাটা সময়। 

আল্লাহ’র নাম নিয়ে নৌকা ভাসাল মাঝিরা। তিনজন মাঝি। একজন পিছনে ধরল হালের বৈঠা। দুজন থাকলো নৌকার আগায়। ছোট ছোট ঢেউ এসে ধাক্কা দিচ্ছে নৌকার তলায়। ফুরফুরে বাতাস। তামাম মেঘনা জুড়ে উত্তর দক্ষিণ করছে। কিছুটা পশ্চিমে হেলতে শুরু করেছে সূর্য। হলুদ হলুদ রং মেখে। আমি ছৈয়ের বাইরে যেতে চাইলাম। আম্মা আটকে দিলেন। উড়িয়ে দিলেন ভয়ের অনেকগুলো ধূসর পাতা। নদী দেখবো, নৌকা দেখবো মাঝি দেখবো, ভৈরবের পুল দেখবো। কিন্তু আম্মার বারণ আমাকে টেনে ধরলো। ছৈয়ের এক মাথায় কাঠের নকশা করা দরজা। অন্যদিকে একটি চাদর টানানো। শহরের রিকশাগুলোতে যেমন ঝুলে। মাঝেমধ্যেই বাতাসে উড়ছে চাদর। এই ফাঁক-ফোকর দিয়ে যতটুকু দেখা মিলে। এই দেখাতে  কি মন ভরে? আম্মাকে কে বোঝাবে। আমি মন ভার করে বসে থাকলাম ছৈয়ের ভিতরে। মামার কাছে যেতে মন আকুপাকু করছে। কিন্তু সরাফতির পর্দা আমার নজরের মাঝবরাবর ঝুলে থাকলো। 

বড়মামা এরি মধ্যে পাঠ করে ফেলেছেন আমার মনের পাতাগুলো। ছৈয়ের ভিতর ঢুকলেন পর্দা ঠেলে। এতো সময় মামাকে ডাকতে সাহস পাচ্ছিলাম না। আম্মার বকাঝকা শুরু হবে এজন্যে। মামার চেহারা দেখে সাহস লাফিয়ে উঠলো। ছৈয়ের বাইরে যাবার আবদার রাখলাম। আম্মার চোখে চোখ রাখলাম ভয়ে ভয়ে। শাসনের বেত তুলতে গিয়েও নামিয়ে নিলেন আম্মা। এই সুযোগে মামাকে জড়িয়ে ধরে বলালাম বাইরে দেখবো, নৌকার ভিতর আর কত সময় বসে থাকা যায়। আম্মা নরম গলায় আপত্তির নিশান উড়াতে চাইলেন। ভয় লাগে কখন কি হয়ে যায়। এতো বড় মেঘনা। বড় তাতে কি হয়েছে ওতো আমার সাথেই থাকবে। ভয় টয়ের চিন্তা পানিতে ফেলো, বড়মামা উঁচু গলায় শব্দগুলো বাতাসে ছুড়ে দিলেন। আমার চারপাশে তখন আনন্দের রঙিন ঝালর। 

আশুগঞ্জ বাজারে মাঝ বরাবর গিয়ে নৌকা মুখ ঘুরালো দক্ষিণে। মামা বললেন আমরা এখন মেঘনা পাড়ি দেবো। ছোট বড় ঢেউ। আগে বাড়ছে হামাগুড়ি দিয়ে। আকাশে উড়ছে পাখি, সাদা সাদা। কিছু সময় পরপর  ঝাঁপিয়ে পড়ছে পানিতে। ঠোঁটে ছোট ছোট মাছ নিয়ে উড়াল দিচ্ছে আবার। এ এক মজার খেলা। আমাদের নৌকার পেছন পেছনও আসছিল একদল সাদা পাখি। নৌকার পাশ দিয়েই ভেসে যাচ্ছে কচুরিপানার একটি দঙ্গল। এই দঙ্গলে বসে আছে বেশ কয়েকটি ধলবগ। কি চমৎকার দৃশ্য। মামা ইশারা করে দেখালেন আমাকে। আমিতো অবাক! এমন সুন্দর ছবি দেখে।  ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছে কচুরিপানা। বকগুলো দেখছে ইতিউতি। পানার সাথে দুলছে ওরাও। কোথায় যাচ্ছে কে জানে। দূরে দূরে গ্রাম। ভাসছে মনে হলো পানিতে। সারি সারি নৌকা মেঘনায়। যাচ্ছে আসছে সাঁতার কেটে কেটে। ছৈয়ের ভিতরে আম্মা দোয়া-কালাম পড়ছেন। হয়তো আমার জন্য। আমি পাটাতনে বসে বসে বাতাস খাচ্ছি। আর দেখছি মেঘনার থৈ থৈ পানি। অন্যদিকে আম্মার ভাবনা কি জানি কি হয় আমার। 

আমাদের নৌকা নদীর মাঝখানটায় এসে পড়েছে। বড়মামা আঙ্গুল ইশারায় বল্লেন অই যে দেখছ গ্রাম, এ গ্রামের বাঁক ঘুরলেই দেখা দেবে আগানগর। আগানগর নানাদের গ্রামের নাম। সে গ্রামও নাকি পানিতে ডুবুডুবু। এমন দৃশ্য অবশ্য প্রতি বর্ষার। 

এ এলাকার মানুষগুলোর যেনো পানিতেই বসবাস। প্রায় বাড়ির ঘাট বরাবর নৌকা। ঢেউয়ে ঢেউয়ে দুলছে। মামা জানালেন অই যে দেখছো নৌকা, এ নৌকাই ওদের যাতায়াতের বাহন। তবে এ চেহারাটা শুধু বরষাকালে। বরষা যখন পালিয়ে যায় এ তল্লাট থেকে তখন আশপাশে আর পানি থাকে না। হাঁটা-চলা করা যায়। খেলাধুলার মাঠও ভেসে ওঠে। ভেসে ওঠে ফসলের মাঠ। তখন হু হু করে বয়ে যায় আনন্দের বাতাস। ফসলের মৌ মৌ গন্ধ মেখে। আমার চোখে কেবল ভাসছে আগানগর গ্রাম। নানাবাড়িতে কখন পৌঁছবো। পানি আর নৌকার ছবি এখন ঝাপসা ঝাপসা লাগছে। 

ভিতর থেকে আম্মা জানতে চাইলেন কতদূর এলাম আমরা। বড়মামা জানালেন, অই তো শ্যামপুর দেখা যাচ্ছে। আর বেশি সময় লাগবে না বাড়ি পৌঁছতে। অনেক সময় ধরেই আম্মা একা একা। তাই পর্দা ঠেলে কাছে গেলাম। বড়মামাও এলেন পেছন পেছন। আম্মার চেহারায় ভয় আর আতঙ্ক জড়াজড়ি করে বসে আছে। ভাবনায় কেবল আমি, হয়তোবা। 

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ