জীবন ঘুড়ির আকাশ দেখা
সাজজাদ হোসাইন খান : ॥ চৌদ্দ॥ প্রতি রোববার আব্বা অফিস কামাই করেন। বাইরে কোনো কাজ না থাকলে ঘরেই সময় কাটান। সাপ্তাহের এই দিনটিতে অফিস-আদালত বন্ধ থাকে। দোকানপাটও বন্ধ, কোনো কোনো এলাকায়। অর্থাৎ রবিবার হলো সাপ্তাহিক ছুটির দিন। আব্বারা ঘরে থাকেন। তাই ভয়ের বাতাস এলোমেলো। ভারি ভারি। যখন তখন ঘরের বাইরে যাওয়া হয়ে ওঠে না। অসময় দাঁড়িয়ে থাকে সময়ের অপেক্ষায়। মাঠ-রাস্তা অনেকটা ফাঁকা ফাঁকা। খেলাধুলা তো সেই আসরের পর। সাপ্তাহের এই একদিনই গোসলে যান জোহরের আগে আব্বা। সে দিন আমিও থাকি সাথে। পুকুরটি একেবারেই কাছে। অবশ্য একে পুকুর না বলে দিঘী বললেই সঠিক হবে। কারণ আয়তনে বিশাল। এমন বিশাল বিশাল দিঘী আছে আরো অনেক, আব্বার কাছে শুনেছি। এজন্যেই নাকি কুমিল্লাকে বলা হয় দিঘীর শহর। এরি মধ্যে শানবাঁধানো ঘাটলার আড্ডাটা বেশ জমে ওঠে। সে আড্ডায় আব্বাও যোগ দেন তার পরিচিতজনদের সাথে। বিকালের দিকটায়তো প্রতিদিনই জম্পেশ আড্ডা, ঘাটলায়। তবে ছোটদের আসতে মানা। সব আব্বা-আম্মারা এ বিষয়টা নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকেন। তাই এ ব্যাপারে কড়া নজর। কিছুদিন আগেও নাকি উত্তরপাড়ে এক বালককে গিলে খেয়েছে এই দিঘী। এমনটা প্রায় ঘটছে আজকাল। যে জন্যে এত সাবধানতা, শতর্কতা।
এ দিঘীতেই সাঁতারের মশক করি। আব্বা আমার বুকের তলায় হাত রাখতেন। আমি আব্বার হাতের তালুতে ভর রেখে পানিতে হাত-পা ঝাপটাতাম। কোনো কোনো দিন ঘাটলার সিঁড়িতে হাত দিয়ে পানিতে শরীর ভাসিয়ে রাখার চেষ্টা করতাম। এভাবে চলল কিছু দিন। ভয় কেটে গেলো। সহজ হয়ে গেলো সাঁতারের কলা-কৌশল। এ জন্যে আব্বারও খুব আনন্দ। আনন্দের খবর বাসায় ফিরে আম্মাকেও শোনান। আম্মার কিন্তু ভয় কাটে না। আব্বাকে সাবধান করেন বারবার। আব্বা একদিন আমার বুকের তলা থেকে তার হাতটি সরিয়ে নিলেন আচমকা। আমাকে তখন অনেকগুলো ভয় চারদিক থেকে ঘিরে ধরলো। নাকে মুখে পানি ঢুকলো। এই যখন অবস্থা আব্বা আমাকে আবার পানির উপর তুলে ধরলেন। এরকম ডুবসাঁতার চললো কয়েক দিন। আমি তো অবাক। আব্বার সাহায্য ছাড়াই শরীর ভাসিয়ে রাখতে পারি। এখান থেকে ওখানে যেতেও পারি। তখন আব্বার চোখে ঝরছে হিজল ফুল, টপ টপ পানিতে। ঠাকুরপাড়ার দিঘীতে প্রথম সাঁতার শেখা, পানির সাথে দোস্তি। একটা ফখর ভাব চোখেমুখে। আনন্দের আকাশে প্রজাপতির ঝাঁক। তারপরও আম্মার সাবধান বাণী, দিঘীর ধারকাছেও ঘেষঁবে না একা একা। আব্বাও আম্মার পাশাপশিই হাঁটলেন। কেনো! আমিতো এখন সাঁতার পারি। আব্বা বললেন সাঁতার জানলেও ছোটদের পুকুর ঘাটে একা যেতে মানা। অই যে তোমার আম্মার ভূত-জিনের ভয়। ওরাও তো বেেস থাকতে পারে ঘাপটি মেরে। বলেই আব্বা হাসলেন আম্মার দিকে তাকিয়ে। (চলবে)