শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

আবারও চালের দাম বাড়ছে

মূলত ভারতের সৃষ্ট পেঁয়াজের সংকট এবং অন্যসব  পণ্যের ক্রমাগত মূল্যবৃদ্ধির চাপে দেশের মানুষের যখন নাভিশ্বাস ওঠার অবস্থা তেমন এক কঠিন সময়ে সম্প্রতি আবারও বাড়তে শুরু করেছে চালের দাম। গতকাল দৈনিক সংগ্রামের রিপোর্টে জানানো হয়েছে, করোনা মহামারি ও বেকারত্ব এবং দেশজুড়ে দীর্ঘমেয়াদি ভয়াবহ বন্যার কারণে মানুষের জীবন যখন বিপন্ন বিভিন্ন বাজারে তখন প্রতি কেজি চালের দাম বেড়েছে দুই থেকে চার টাকা পর্যন্ত। এই বৃদ্ধি অব্যাহতও রয়েছে। এ নিয়ে চলতি বছরে চার দফা বাড়লো চালের দাম।
উল্লেখ্য, পবিত্র ঈদুল আযহার পর প্রতি কেজিতে পাঁচ টাকা পর্যন্ত দাম বাড়ার পর জনগণের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ ও প্রতিবাদ দেখা দেয়। সরকার তখন তৎপর হয়ে ওঠায় দ্রুতই দাম কমে এসেছিল। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই ব্যবসায়ীরা আবারও দাম বাড়াতে শুরু করেছে। প্রতি বস্তায় বেড়েছে তিনশ থেকে পঁচশ’ টাকা পর্যন্ত। আকস্মিক এই মূল্যবৃদ্ধির জন্য খুচরা বিক্রেতারা মিল মালিকদের সিন্ডিকেটকে দায়ী করেছেন। অন্যদিকে মিল মালিকদের যুক্তি, ধানের দাম হঠাৎ বেড়ে যাওয়ার ফলেই তারা নাকি দাম বাড়াতে বাধ্য হয়ছেন! খুচরা বিক্রেতাসহ জনগণের সচেতন অংশ অবশ্য বলেছেন, ভবিষ্যতে বেশি মুনাফার আশায় অসাধু মিল মালিকরা ধান-চাল মজুত করার কারণেই হঠাৎ চালের দাম বেড়ে চলেছে। তুলনামূলকভাবে বেশি বেড়েছে মিনিকেট ও নাজিরশাইল চালের দাম।
তথ্যাভিজ্ঞরা বলেছেন, দেশে চাহিদার তুলনায় পর্যাপ্ত চালের মজুত থাকলেও একটি সিন্ডিকেটের কারসাজিতে বারবার চালের বাজার অস্থির হয়ে উঠছে। সরকারের পক্ষ থেকে অবশ্য যথারীতি দায়দায়িত্ব পাশ কাটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। বাজারের খুচরা বিক্রেতারা মহাজনসহ পাইকারি বিক্রেতাদের ওপর দোষ চাপালেও সরকার শুনিয়ে চলেছে অন্য কথা। সরকার প্রথমত মূল্যবৃদ্ধির কথাই স্বীকার করতে চায়নি। মন্ত্রীসহ কর্তাব্যক্তিরা বলেছেন, ‘অসাধু’ ব্যবসায়ীদের ষড়যন্ত্রে দেশের অল্প কিছু স্থানে ‘বিচ্ছিন্নভাবে’ দাম বেড়ে থাকতে পারে! তবে রাজধানীসহ সারাদেশে চালের বাজার নাকি ‘পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে’! তাছাড়া দেশে বর্তমানে চালের ব্যাপক মজুত থাকায় মূল্যবৃদ্ধির কোনো কারণ নেই বলেও মন্তব্য করেছেন কর্তাব্যক্তিরা। তারা আরো শুনিয়েছেন, সকল পণ্যের বাজারমূল্যও নাকি স্বাভাবিক রয়েছে!
বলা দরকার, ক্ষমতাসীনরা যা কিছুই বোঝাতে চান না কেন, বাস্তবে বাজার পরিস্থিতি অত্যন্ত আশংকাজনক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কারণ, একদিকে পেঁয়াজের বাজারে এখনো স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসেনি অন্যদিকে একযোগে বেড়ে চলেছে ডাল ডিম তেল থেকে শুরু করে প্রতিটি সবজি ও পণ্যের দাম। ফলে নাভিশ্বাস উঠেছে স্বল্প আয়ের সাধারণ মানুষের। এমন এক অবস্থায় চালের দাম বেড়ে যাওয়ায় মানুষের পক্ষে কোনোভাবে বেঁচে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। একই কারণে সরকারের বক্তব্যও গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠতে পারেনি। বরং চালের বাজার পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে ও স্বাভাবিক রয়েছে বলে কর্তাব্যক্তিরা যে মন্তব্য করেছেন সাধারণ মানুষও তাকে নিষ্ঠুর রসিকতা হিসেবে চিহ্নিত না করে পারছেন না। উল্লেখ্য, কর্তাব্যক্তিরা শুধু পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে থাকার কথা বলেননি, পুনরাবৃত্তি করতে গিয়ে আরো বলেছেন, বর্তমানে দেশে চালের ব্যাপক মজুত রয়েছে। তাছাড়া আমরা চালে স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং সে কারণেই বাজারমূল্য স্বাভাবিক রয়েছে বলেও দাবি জানিয়েছেন কর্তাব্যক্তিরা।
চালের মজুত সম্পর্কিত সরকারের বক্তব্য অবশ্য সম্পূর্ণ অসত্য নয়। কারণ, গত বছর গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরেও জানানো হয়েছিল, তখন মজুত খাদ্যশস্যের পরিমাণ নাকি ছিল ১৬ লাখ ৮৭ হাজার টন। এর মধ্যে ১৩ লাখ ১৫  হাজার টনই ছিল চাল। কিন্তু এত চাল নিয়ে সরকার বিপাকে পড়েছিল। কারণ, দেশে এক বছরে চালের মোট চাহিদার পরিমাণ প্রায় ছয় লাখ টন। সে হিসাবে চাহিদার চাইতে দ্বিগুণেরও বেশি চাল মজুত হয়েছিল। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল পূর্ববর্তী বছরের দু’লাখ টনেরও বেশি চাল। গুদামে জায়গা না হওয়ায় এই চালকে বাইরে ফেলে রেখেছিল সরকারা। উদ্বেগের কারণ হলো, বিপুল পরিমাণ সে চালে পচন শুরু হয়েছিল। এই দু’লাখ টন চালের বাজার মূল্য ছিল আট হাজার কোটি টাকারও বেশি। অর্থাৎ অন্তত আট হাজার কোটি টাকার চাল নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর্যায়ে এসে গিয়েছিল!
খাদ্য বিশেষজ্ঞসহ পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, ত্রুটি ও দুর্বলতা রয়েছে আসলে সরকারের পরিকল্পনায় ও ব্যবস্থাপনায়। ধানের মৌসুমে সরকারের পক্ষ থেকে কৃষকদের লাভজনক মূল্য দেয়ার পরিবর্তে ফড়িয়া দালাল ও মিল মালিকসহ মহাজনদের প্রাধান্য দেয়া হয় বলে প্রতি বছর সব ধান-চাল চলে যায় বিশেষ একটি গোষ্ঠীর দখলে। বঞ্চিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হয় কৃষকরা। ওদিকে মালিকসহ মহাজনদের যে গোষ্ঠীর লোকজন সব ধান-চাল দখল করে নেয়, তারাই সারা বছর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে। এজন্যই আমনের ভরা মৌসুমেও হঠাৎ করে চালের দাম বেড়ে যায়। এবারের বোরো মৌসুমেও ব্যতিক্রম হয়নি। অন্যদিকে গুদামে স্থান না হওয়ায় পচন ধরে প্রায় আট হাজার কোটি টাকার চালে। সবকিছুর পেছনে থাকে ক্ষমতাসীনদের দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য এবং সরকারের ব্যর্থতা। এ বছরও ব্যতিক্রম হয়নি। একই কারণে একদিকে গুদামে চাল নষ্ট হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে, অন্যদিকে বোরো সংগ্রহের সময় এসে বেড়ে চলেছে চালের দাম।
আমরা মনে করি, পরিস্থিতিতে অবশ্যই পরিবর্তন ঘটানো দরকার। কেবলই কথিত অসাধু ব্যবসায়ীদের ওপর দোষ চাপানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত প্রথমত কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের মাধ্যমে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। প্রমাণ পাওয়া গেলে ব্যবসায়ী নামের টাউট লোকজনের বিরুদ্ধে অর্থ দন্ডসহ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া। সরকারকে একই সঙ্গে সুষ্ঠু পরিকল্পনার ভিত্তিতে কৃষকদের কাছ থেকে লাভজনক মূল্যে ধান কিনতে যেমন হবে তেমনি প্রতিরোধ অভিযান চালাতে হবে ধানের অবৈধ মজুত গড়ে তোলার বিরুদ্ধেও। পাশাপাশি বাজার মনিটরিং করতে হবে সারা বছর ধরে।
এভাবে সব মিলিয়ে সুচিন্তিত পরিকল্পনার বাস্তবায়ন করা হলে কোনো গোষ্ঠীর পক্ষেই চাল নিয়ে জালিয়াতি করা সম্ভব হবে না বলেই আমরা বিশ্বাস করি। নিত্যপ্রয়োজনীয় অন্য সব পণ্যের বেলাতেও সরকারকে একই নীতি অনুসরণ করতে হবে। আমরা আশা করতে চাই, কমিশন বাণিজ্য এবং দলীয় লোকজনের প্রতি আনকূল্য দেখানোর মতো কর্মকান্ডের ব্যাপারেও সরকার তার এতদিন ধরে অনুসৃত নীতি-কৌশলে পরিবর্তন ঘটিয়ে জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেবে এবং অনতিবিলম্বে বাজার নিয়ন্ত্রণ করবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ