বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

প্রাণশক্তি স্পর্শ করা স্লোগান গ্রাম হবে শহর

মো. আবুল হাসান/খন রঞ্জন রায় : গ্রাম শব্দটি মূলত সংস্কৃত ভাষা হতে উদ্ভূত। লোকমুখে এই গ্রাম ‘গেরাম’ হিসেবে ছড়িয়ে পড়েছে। বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এই ‘গেরাম’ ‘গাঁও’ ‘গাই’ ‘গাঞি’ ‘গাঁ’- এ রূপান্তরিত হয়েছে। কারো কারো মতে, সংস্কৃত ব্যাকরণের অনুশাসন মেনে এ শব্দ ‘গ্রামে’ রূপান্তরিত হয়েছে।
মার্কণ্ডেয়-পুরাণের মতে, “যে ভূখণ্ডে ভদ্রগণ ও সমৃদ্ধশালী কৃষকেরা বাস করে তার নাম গ্রাম”। ইতিহাস পণ্ডিত নীহাররঞ্জন রায় এর উদ্ধৃতিতে বাংলাদেশের গ্রাম গড়ে ওঠার সমগ্র প্রেক্ষাপটটি তুলে ধরতে সমর্থ হয়েছেন।
‘একই বংশে জাত সন্তান-সন্ততি এবং তাদের বংশধরদের নিয়ে কয়েকটি পরিবারের ছোট একটি উপনিবেশ হলো গ্রামের স্বাভাবিক রূপ’। গ্রামের উৎপত্তি সম্বন্ধে প্রাচীন গ্রীক দার্শনিকের এই বক্তব্য সূচনায় সঠিক হলেও কালে গ্রামের এই স্বাভাবিক রূপ অক্ষুণ্ন থাকেনি। বিভিন্ন জাতের ও শ্রেণির মানুষের বসতি রয়েছে গ্রামে। স্বনির্ভর হয়েছে সংশোধন। সর্বোপরি প্রভাবশালী যোদ্ধা শ্রেণি, রাজন্যবর্গ এবং ধর্মযাজক গোষ্ঠীর প্রভূত্বকে স্বীকার করে নেওয়ার ফলে গ্রামের সামাজিক অর্থনৈতিক জীবনেও এসেছে পরিবর্তন যার ফলে সকল সিদ্ধান্ত কেবল পরিবারের বা গ্রাম সমাজের নিজ প্রয়োজনে নেয়া সম্ভব হয়নি। রাজ শক্তির উত্থান-পতন সামন্ত যুগে গ্রামীণ সমাজকে স্পর্শ করেছে প্রত্যক্ষভাবে।
বর্তমানে গ্রাম কেবল মানুষের বসতির একটি রূপ নয়। তা এখন উন্নয়নের অংশীদার। এর অভ্যুদয়ের সাথে জড়িত ছিলো জীবিকার্জ্জনের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং বিশেষ উৎপাদন ব্যবস্থা। আদিম যাযাবর মানুষ যখন পশু শিকার এবং ফলফুল আহরণ ছেড়ে কৃষিকাজ শিখল তখন সেই নতুন জীবিকার তাগিদেই তাকে গ্রহণ করতে হলো উপযুক্ত উৎপাদন ব্যবস্থা এবং সেই উৎপাদন ব্যবস্থাই যাযাবর মানুষকে স্থায়ী বসতি স্থাপনে বাধ্য করলো। গ্রামীণ সমাজের আদিলগ্নে প্রাকৃতিক অর্থনীতিই ছিল প্রধান। তখন গ্রামের মানুষেরা কেবলমাত্র নিজেদের ব্যবহারের জন্য দ্রব্য সামগ্রী তৈরী করতো। আদিম সাম্যবাদের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিলো যে গ্রাম ক্রমে ব্যক্তি মালিকানার স্বীকৃতি, উৎপাদন বৃদ্ধি এবং পণ্য-বিনিময়ের প্রসারের ফলে তার প্রকৃতিতে পরিবর্তন হলো।
গ্রামীণ বাংলার এক শাশ্বত প্রতিরূপ ভেসে উঠে হেমন্ত ও শীতের সন্ধিক্ষণে আমরা এখন তা উপলব্ধি করছি। চোখ মেলে চাইলেই চিরায়ত বাংলার সমৃদ্ধিতে ভরপুর ছবিটি দেখা যায়। কিছু উন্নয়ন আর রঙরূপ, দৃশ্যপট বদল হলেও বাংলাদেশের ভূগোলে গ্রাম এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু প্রাকৃতিক ও নান্দনিক সৌরভের গ্রামগুলোর ভেতরে রয়েছে আলো ও আঁধারের পুঞ্জীভূত অন্য এক জগৎ। গভীর অন্তর্দৃষ্টি না থাকলে গ্রামের সেসব ছবি দেখা অসম্ভব। আর একারণেই অতি সাম্প্রতিক প্রিয় লেখক হুমায়ন আহম্মদ পূর্ণিমা ও অমাবষ্যার আলো আধার উপভোগ করতে গহীন গ্রামে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করতেন।
অতীতের সাহিত্যিকরাও গ্রামের সম্ভাবনা গভীর অনুসন্ধান করেছিলেন। বঙ্কিমের ‘বঙ্গদেশের কৃষক’ ছাড়াও শরৎচন্দ্র গ্রামীণ জীবনের আলো ও অন্ধকারকে তুলে ধরেছেন। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ইউরোপের পুঁজিবাদী দানবীয় চাহিদা সৃষ্টিকারী সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনার বিরোধিতা করছিলেন ‘রক্তকরবী’ নাটকে। ‘রক্তকরবী’ লেখার আগেই রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সিটি অ্যান্ড ভিলেজ’ নামের ইংরেজি নিবন্ধে খেয়াল করিয়ে দিয়েছিলেন কৃত্রিম চাহিদা সৃষ্টি প্রকৃতি-পরিবেশকে বিনষ্ট করছে। রবীন্দ্র পরবর্তী সাহিত্যিকদের মধ্যে গ্রামসমাজের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধতম তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধায়। তারাশঙ্কর নিজেও তাঁর গ্রাম-কেন্দ্রীক সাহিত্যধর্মে অবিচল ছিলেন আজীবন। দলমত নির্বিশেষে গ্রামসমাজের সাধারণ মানুষের জীবনধারাকে বুঝতে গ্রামীণ জনতার জীবনের সমস্যার নানা বাস্তব সমাধানও প্রদান করতে তৎপর হয়েছিলেন।
বর্তমানের রাজনৈতিক ব্যক্তিরা অনেকেই গ্রামে যান বা গ্রামের সাথে সম্পর্কীত থাকেন, কিন্তু কয়জন গ্রামের রূপবৈচিত্র ও সম্ভাবনার কথা তুলে ধরতে পেরেছেন? গল্প-উপন্যাসের কৃৎ-কৌশল গ্রামের দুঃখদুর্দশা বারোয়ারী ভাষায় বর্ণনা আছে। ১৯৬৩ সালের ১৭ আগস্ট তারাশঙ্কর স্বাধীন দেশের উপরওয়ালাদের প্রসঙ্গে গ্রামের চিঠিতে বিদ্রুপ ও শ্লেষ ভরা বাক্যে লিখেছিলেন: ‘ইহারা গ্রামের লোকের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না কারণ ইহারা উপরওয়ালা। তারাশঙ্কর গ্রামকে ভেতর থেকে চিনতে ও চেনাতে চেয়েছিলেন। আমাদের রাজনীতিবিদগণ বা সাহিত্যিক, সমাজ-গবেষকরা হৃদয়ে ধারণ ও লালন করে সে চেষ্টাটি সরেজমিনে অবিরাম করে যাচ্ছেন তা একাদশ জাতীয় নির্বাচনে প্রস্ফূটিত হয়েছে।
তারাশঙ্কর যে গ্রামের চেহারা দেখেছিলেন, সে চেহারা হয়তো এখন খুঁেজ পাওয়া যাবে না। রাজনীতিও জটিলতর হয়েছে। তবে গ্রাম সম্বন্ধে মূলগত সমস্যার স্বরূপ একই। তা হলো, আমরা গ্রামের উন্নয়নের কথা ভাবি, কিন্তু গ্রামকে ভেতর থেকে চেনার চেষ্ট করি না।
নির্বাচনে জনগণ শুধু দল ও মার্কা নয়; প্রার্থীর যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, অতীত কর্মকাণ্ড ও অঙ্গীকার বিষয় বিবেচনা করেই ভোট দিয়ে থাকে। নির্বাচন-পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা কিভাবে করা হবে তার রূপরেখাই হলো নির্বাচনী ইশতেহার। ইশতেহার রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকারপত্র। বাস্তবভিত্তিক ও যুগোপযোগী চিন্তা চেতনার বহিঃপ্রকাশ নির্বাচনী ইশতেহার এবং তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার সামর্থও গুরুত্বের। নির্বাচনী ইশতেহার প্রণয়নে আলো ও অন্ধকারের গ্রামকে দৃশ্যমান করা।
বাংলাদেশকে নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি ডেল্টা প্ল্যান বা বদ্বীপ পরিকল্পনা প্রাধান্য পাচ্ছে। একই সঙ্গে বিপুলসংখ্যক তরুণ ভোটারকে আকৃষ্ট করার জন্য তাদের কর্মসংস্থান এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার অঙ্গীকার থাকছে। ইশতেহারে স্লোগান নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ ও ‘গ্রাম হবে শহর’। এই শ্লোগানের ফলে গ্রামগুলোতে শহরের মতো নাগরিক সুবিধা পৌঁছে দেওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। একটি রাষ্ট্র তখনই উন্নয়নের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছবে যখন দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন সাধিত হবে। আমাদের দেশে শহর থেকে গ্রামের আয়তন বেশি সেই সঙ্গে সস্তা শ্রম ও প্রাকৃতিক সম্পদও বেশি, গ্রামের উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারলে আমাদের উন্নয়ন হবে স্থায়ী ও নির্ভরশীল।
একটি গ্রামকে আলোকিত করতে খুব বেশি কিছু প্রয়োজন নেই; শুধু সরকারের একটু দৃষ্টি ও পরিকল্পিত রূপরেখা পালটে দিতে পারে গ্রামের চিত্র। গ্রামীণ অর্থনীতি এগিয়ে না গেলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন ব্যাহত হবে। প্রতিটি গ্রামে উৎপাদনমুখী ‘একটি গ্রাম একটি পণ্যে’র কুটিরশিল্প গড়ে তোলা গেলে একদিকে যেমন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে অন্যদিকে শহরে মানুষের চাপ কমে আসবে।
এই প্রেক্ষাপটে ‘সমৃদ্ধ বাংলাদেশ’ ‘গ্রাম হবে শহর’ স্লোগান বাস্তবধর্মীয় ও যুগোপযোগী হয়েছে। গ্রামের স্বল্প ও সীমিত আয়ের মানুষের আশা জেগেছে। তা সম্ভব হলে শহরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাবে গ্রামীণ অর্থনীতি সাধিত হবে সামগ্রিক উন্নতি। বিশেষত এই স্লোগানের হাত ধরে আমাদের গ্রামে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা রাখবে। তরুণ যুব প্রৌঢ় বৃদ্ধ সকলের সমন্বিত প্রয়াস শহর ও গ্রামকে একসঙ্গে উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে দেবে এমন স্বপ্ন দেখা আমরা শুরু করেছি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ