শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

মন্ত্রণালয় পেঁয়াজের দাম কমার দাবি করলেও বাজারে বাড়তি দামই বহাল

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: গত সোমবার পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয় ভারত। ভারতের রফতানি বন্ধ-এমন খবরে হঠাৎ লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে পেঁয়াজের দাম। আতঙ্কে গত মঙ্গল ও বুধবার একশ্রেণির ক্রেতা বাড়তি পেঁয়াজ কিনে মজুত করেন। এতে রাজধানীর বাজারগুলোতে পেঁয়াজ কেনার হিড়িক পড়ে যায়। এতেই পেঁয়াজের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো ছুটতে থাকে। এক সপ্তাহ আগে যে পেঁয়াজের কেজি ছিলো ৪০ টাকা। দুই দিন আগেও নিত্যপণ্যটির দাম ছিল ৫০ থেকে ৬০ টাকা। কিন্তু এখন খুচরা বাজারে প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১২০ টাকা। এই বাড়তি দামেই স্থির রয়েছে তবে বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে বাণিজ্যমন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও রাজধানীর বাজারগুলোতে কোথাও তার প্রমাণ মেলেনি। গত দু’দিন বাড়তি কেনার পর গতকাল বৃহস্পতিবার পেঁয়াজ কেনার পরিমাণ কিছুটা কমেছে। ফলে খুচরা বাজারে কমেছে পেঁয়াজ বিক্রি। হঠাৎ করে বেড়ে যাওয়া পেঁয়াজের দাম কমেনি। 

রাজধানীর খুচরা বিক্রেতারা বলছেন, গত বছর এই মাসেই ভারত পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করায় দেশের বাজারে পেঁয়াজের কেজি ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা হয়েছিল। এ কারণে এবার ভারতের রফতানি বন্ধ এবং পেঁয়াজের দাম বাড়ার সংবাদে গত মঙ্গলবার পেঁয়াজ কেনার এক ধরনের হিড়িক পড়ে যায়। বুধবারও বাড়তি পেঁয়াজ কেনেন ক্রেতারা। মূলত গত দুদিনেই ভোক্তাদের বড় অংশ পেঁয়াজ কিনে মজুত করেছেন। এ কারণে পেঁয়াজের বিক্রি কমেছে।

তারা বলেন, পেঁয়াজের বিক্রি কমলেও পাইকারি বাজারে দাম কমেনি। যে কারণে খুচরা বাজারেও পেঁয়াজের দাম কমেনি। সহসা পেঁয়াজের দাম কমার সম্ভাবনাও কম। ভারত যদি বাংলাদেশকে পেঁয়াজ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তাহলে দাম কিছুটা কমতে পারে। ভারত পেঁয়াজ না দেয়ার সিদ্ধান্তে অনড় থাকলে দাম আরও বেড়ে যেতে পারে।

গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, খুচরা বাজারে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ১১০ টাকা। কোথাও কোথাও ১২০ টাকা। আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৭০ থেকে ৮০ টাকা কেজি। অন্যদিকে পাইকারিতে দেশি পেঁয়াজের কেজি বিক্রি হচ্ছে ৮০-৮৫ টাকা। আমদানি করা ভারতের পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা।

মালিবাগ হাজীপাড়ার এক ব্যবসায়ী জানান, দাম বাড়ার সংবাদে মঙ্গলবার ২০ বস্তা পেঁয়াজ কিনেছিলাম। গত দুদিনে ১২ বস্তা পেঁয়াজ বিক্রি হয়েছে। ক্রেতাদের বেশিরভাগ পাঁচ কেজি করে পেঁয়াজ কিনেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) পেঁয়াজের ক্রেতা নেই। তিনি বলেন, বেশিরভাগ মানুষ গত দুদিনে বাড়তি পেঁয়াজ কিনে মজুত করেছেন। যে কারণে আজ বিক্রি খুব কম। ৮-১০ দিন পরে আবার পেঁয়াজের চাহিদা বাড়বে। তখন পেঁয়াজের দাম আরও বেড়ে যেতে পারে। অবশ্য শুনছি পেঁয়াজ দেয়ার জন্য বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। ভারত যদি অনুরোধ রেখে বাংলাদেশকে পেঁয়াজ দেয় তাহলে দাম কিছুটা কমতে পারে।

একই ধরনের কথা বলেন হাজীপাড়া বৌ-বাজারের ব্যবসায়ীরা। তারা বলেন, শ্যামবাজারে গিয়ে শুনছি ভারতে পেঁয়াজ বোঝাই অনেক ট্রাক আটকে আছে। টেলিভিশনেও এমন খবর শুনছি। এসব পেঁয়াজ বাংলাদেশে আসার অনুমতি দেয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে নাকি অনুরোধ করা হয়েছে। আটকে থাকা পেঁয়াজের ট্রাক বাংলাদেশে আসলে দাম কমবে বলে শ্যামবাজারের ব্যবসায়ীরা বলছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ব্যবসায়ী বলেন, পেঁয়াজের দাম আগামী দু-তিন মাস কমার সম্ভাবনা কম। ভারত পেঁয়াজ দিলে দাম কিছুটা স্থির থাকতে পারে, কিন্তু দাম কমবে বলে মনে হয় না। ভারত পেঁয়াজ না দিলে দাম আরও বেড়ে যাবে। এবার হয়তো গত বছরের মতো হবে না। কারণ পেঁয়াজের দাম নিয়ন্ত্রণে এবার আগেভাগেই অভিযান শুরু হয়েছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন বাজারে অভিযান চালানো হয়েছে। এই অভিযান না চালালে পেঁয়াজের কেজি আরও বেড়ে যেতো। 

কারওয়ান বাজারের ব্যবসায়ীরা জানান, পেঁয়াজের দাম নতুন করে আরও বাড়ার সম্ভাবনা কম। কারণ পেঁয়াজের বিক্রি অনেক কমে গেছে। আতঙ্কে দুদিনে সাধারণ মানুষ অনেক পেঁয়াজ কিনেছেন। আজ (বৃহস্পতিবার) বিক্রি নেই বললেই চলে। তারা বলেন, এবার পেঁয়াজের দাম অস্বাভাবিক বাড়ার সম্ভাবনা যেমন কম, তেমনি দাম কমার সম্ভাবনাও কম। গত বুধবার আমরা দেশি পেঁয়াজ ৮০ টাকা কেজি বিক্রি করেছি। আজও ৮০ টাকা কেজি বিক্রি করছি। নতুন পেঁয়াজ না ওঠা পর্যন্ত পেঁয়াজের এই দাম স্থির থাকবে বলে মনে হচ্ছে। আমাদের ধারণা, পেঁয়াজের দাম খুব বেশি ওঠা-নামা করবে না। হয়তো কেজিতে ৫-১০ টাকা কম-বেশি হতে পারে। তবে পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, পেঁয়াজের এই দাম কয়েক দিন স্থির হবে।

এদিকে সরকারের নানামুখী পদক্ষেপের কারণে দেশের বাজারে পেঁয়াজের দাম কমতে শুরু করেছে বলে দাবি করছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কিন্তু রাজধানীর বাজারগুলোতে তার প্রভাব দেখা যায়নি। বাণিজ্যমন্ত্রণালয় বলছে, বিভিন্ন দেশ থেকে জরুরি ভিত্তিতে পেঁয়াজ আমদানির কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। অল্প সময়ের মধ্যেই পর্যাপ্ত পেঁয়াজ দেশে পৌঁছবে। এক মাসের মধ্যে পেঁয়াজের বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসবে। একই সঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরসহ দেশব্যাপী স্থানীয় প্রশাসনের নেতৃত্বে বাজার অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

গতকাল বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এসব কথা জানানো হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দেশে পেঁয়াজের মূল্য ও সরবরাহ স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) মাধ্যমে ট্রাকে করে পেঁয়াজ বিক্রি শুরু হয়। ঢাকাসহ শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানসহ দেশব্যাপী ১৩ সেপ্টেম্বর থেকে প্রতি কেজি পেঁয়াজ ৩০ টাকা করে বিক্রি করছে সরকারি এ প্রতিষ্ঠানটি। ফলে বাজারে পেঁয়াজের মূল্যে ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। পেঁয়াজ বিক্রির এ কার্যক্রম আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। সেখানে বলা হয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় টিসিবির মাধ্যমে এবার পেঁয়াজ আমদানি ও বিক্রির উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষ করে টিসিবি এবার ই-কমার্সের মাধ্যমে পেঁয়াজ বিক্রয় করবে। পেঁয়াজের অবৈধ মজুত বা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে মূল্যবৃদ্ধির চেষ্টা করা হলে সরকার প্রচলিত আইনে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

এদিকে চাহিদা মোতাবেক বাজারে পেঁয়াজের মজুত, সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে গত বছরের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে বেশকিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এর মধ্যে পেঁয়াজ রফতানির ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের বিষয়ে ভারত সরকারের সঙ্গে কূটনীতিক মাধ্যমে জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণের জন্য দেশটির পররাষ্ট্র সচিবকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আমদানিকৃত পেঁয়াজ স্থলবন্দর থেকে দ্রুততম সময়ে ছাড় করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে এনবিআরের চেয়ারম্যান এবং বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যানকে চিঠি পাঠানো হয়েছে। আগামী বছরের মার্চ পর্যন্ত পেঁয়াজের ওপর ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক আপাতত প্রত্যাহারের বিষয়ে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে। কৃষি মন্ত্রণালয়ে পেঁয়াজের বিষয়ে দ্রুত সংনিরোধ সনদ ইস্যু শুরু করেছে।

আরও বলা হয়েছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতর সার্বিক পরিস্থিতি মনিটরিং জোরদার করেছে। দেশের পেঁয়াজ উৎপাদনকারী জেলাসহ (ফরিদপুর, পাবনা, রাজবাড়ী, রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর) সব জেলার প্রশাসকদের সরবরাহ ক্ষেত্রে যাতে কোনো ধরনের সমস্যা না থাকে, সে বিষয়ে মনিটরিং জোরদার করার জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

এছাড়া পরিস্থিতি পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের তিনজন যুগ্ম-সচিবকে উল্লিখিত জেলায় পাঠানো হয়েছে। প্রতিটি বন্দরে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা দায়িত্ব পালন করছেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসকদের কাছে বাজার মনিটরিং জোরদার করতে চিঠি পাঠানো হয়েছে। পেঁয়াজ আমদানিকারকদের এলসি খোলাসহ সার্বিক সহযোগিতা প্রদানের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকেও চিঠি পাঠানো হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ