শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ষষ্ঠবারের মতো ওয়াসার এমডি হতে মরিয়া তাকসিম এ খান!

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : আজীবন পদে থাকতে যেন মরিয়া হয়ে উঠেছেন বহুল আলোচিত-সমালোচিত ঢাকা ওয়াসার এমডি প্রকৌশলী তাকসিম এ খান। সাম্প্রতিক সময়ে তার বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হলেও ষষ্ঠবারের মতো নিজের আসনটি ধরে রাখতে বিভিন্ন কৌশল খাটাচ্ছেন তিনি। ঢাকা ওয়াসায় কর্মরত কেউই যেন তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে না পারে সেজন্য অলিখিত একটি আইনও তিনি করে রেখেছেন। যারাই তার অনিয়ম, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিসহ অভিযোগের কথা বলবে অথবা যে বা যারা তার ইচ্ছের বাইরে যাচ্ছে তাকেই প্রশাসনিক নানা খড়গ সহ্য করতে হচ্ছে। অবস্থা এমন যে, যাদের তিনি সন্দেহ করছেন তাদের করোনা মহামারির মধ্যেও প্রতিনিয়ত ওএসডি, বদলী, ডিমোশন, চাকরিচ্যুতি করা হচ্ছে। সম্প্রতি তিনি ওয়াসার বিভিন্ন পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে ভার্চুয়াল মিটিং করছেন। এসব বৈঠকে তিনি স্পষ্ট করেই বলছেন, যে বা যারা তার কথা শুনবে না তারা মরবে (বিপদে পড়বে)। এছাড়া ওয়াসায় বিভিন্ন গ্রুপ সৃষ্টি করে তার পক্ষে প্রচারণাও চালাচ্ছেন। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দীর্ঘ সময় ধরে এমডি পদে থেকে তাকসিম এ খান ঢাকা ওয়াসায় রাম রাজত্ব কায়েম করেছেন। তিনি আইনের ধার ধারেন না। নিজের ইচ্ছে মতোই সব কিছু করছেন। যখন ইচ্ছে বিদেশ যাচ্ছেন। যতদিন ইচ্ছে থাকছেন। ওয়াসার বোর্ড সদস্যদেরও জানানোর নূন্যতম প্রয়োজন মনে করেন না।  সূত্র মতে, টানা ১১ বছর ধরে ঢাকা ওয়াসার এমডি পদে আসীন তাকসিম এ খান। নিয়োগ ও প্রকল্প নিয়ে তার বিরুদ্ধে দুর্নীতির একাধিক অভিযোগ গড়িয়েছে দুদক পর্যন্ত। বিভিন্ন কমর্কান্ড নিয়ে বিতর্ক থাকলেও একটানা ক্ষমতায় থেকে রেকর্ড গড়েছেন তিনি। ওয়াসা বোর্ডকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ষষ্ঠ দফায় মেয়াদ বাড়াতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাকসিম এ খান। সরকারের শীর্ষ মহলও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত বলে জানা গেছে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকারমন্ত্রী তাজুল ইসলাম সম্প্রতি গণমাধ্যমকে বলেন, ওয়াসার অনেক বিষয়েই অসংগতি আছে। তিনি (বর্তমান এমডি) কীভাবে বারবার নিয়োগ পেয়েছেন, তা বলা মুশকিল। এগুলো আমার দায়িত্ব নেওয়ার আগে ঘটেছে। ওয়াসায় দীর্ঘদিনের অব্যবস্থাপনা দূর করতেই হবে।
স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, তাকসিম এ খান ওয়াসার এমডি হিসেবে প্রথম নিয়োগ পান মহাজোট সরকারের সময় ২০০৯ সালের ১৩ অক্টোবর। এমডি নিয়োগের ক্ষেত্রে যেসব শর্ত ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে সংবাদপত্রে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়, সে শর্তের কোনোটিই তাকসিম এ খানের নেই। এর পরও রহস্যজনকভাবে ওয়াসা বোর্ড তাকসিম এ খানকেই নিয়োগ দেয় এমডি হিসেবে। কিন্তু এরপর আরও চারবার তিনি নিয়োগ পান। যার কোনো বিত্তি নেই বলে গুঞ্জন রয়েছে। প্রথমবারের নিয়োগসংক্রান্ত নথি বিশ্লেষণে দেখা গেছে, এমডি নিয়োগের জন্য ওয়াসা বোর্ড ২০০৯ সালে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। বিজ্ঞপ্তিতে পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে অথবা সিনিয়র পর্যায়ে সাধারণ প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে ২০ বছরের আবশ্যিক অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়। ওই সময় এই পদের জন্য তাকসিম এ খানের জমা দেওয়া জীবনবৃত্তান্ত অনুযায়ী, পানি সরবরাহ ও পয়োনিষ্কাশনে তার কোনো অভিজ্ঞতা ছিল না।
জানা যায়,  শিক্ষক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, আইনজীবী, চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট, ওয়াসার কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের সমন্বয়ে গঠিত হয় ১৩ সদস্যের ওয়াসা বোর্ড। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের মতামতের ভিত্তিতে বিভিন্ন প্রকল্প বোর্ডে পাস হয়। কিন্তু বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে বারবারই পুনর্নিয়োগ নিয়েছেন তাকসিম এ খান। ২০১২ সালের ১৩ অক্টোবর ওয়াসার এমডি হিসেবে প্রথম দফায় তিন বছরের নিয়োগের মেয়াদ শেষ হলে স্বীয় পদে থাকতে যারপরনাই তদবির শুরু করেন তাকসিম এ খান। ওয়াসা আইনকে পাশ কাটিয়েই ওয়াসা বোর্ড তিন বছরের পরিবর্তে এক বছরের জন্য তাকসিম এ খানকে দ্বিতীয়বারের মতো চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়। ২০১৩ সালের ১৩ অক্টোবর এ চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়। তারপর আবার তোড়জোড় শুরু করেন তাকসিম এ খান। আবারও ওয়াসার আইন ও নিয়ম ভেঙে কোনো ধরনের বিজ্ঞপ্তি এবং পরীক্ষা ছাড়াই তাকে নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের অক্টোবরে পঞ্চমবারের মতো নিয়োগ পেতে সর্বশক্তি প্রয়োগ করেন তাকসিম এ খান। আর এ নিয়োগে ওয়াসা বোর্ডকে পাশ কাটিয়ে মন্ত্রণালয়ে ফাইল পাঠানোর অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। এমডি নিয়োগ বিষয়ে কোনো ধরনের বোর্ডসভা অনুষ্ঠিত না হলেও স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে তাকসিমের মেয়াদ নতুন করে এক বছর বাড়ানোর সুপারিশ করে ফাইল পাঠানো হয়। ওয়াসা বোর্ডের সভা অনুষ্ঠিত না হলেও তাকসিম এ খানের পুনর্নিয়োগের একটি ফাইল ওয়াসা থেকে ২৪ আগস্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়। মন্ত্রণালয়ের গ্রহণ করা সে ফাইলে উল্লেখ করা হয়, ঢাকা ওয়াসার কার্যক্রমের গতিশীলতা অব্যাহত রাখতে ওয়াসা বোর্ডের ২২৫তম সভার সুপারিশে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশন কর্তৃপক্ষ আইনের ধারা ২৮(১), (২) অনুযায়ী প্রকৌশলী তাকসিম এ খানকে তার বর্তমান চাকরির মেয়াদ পূর্ণ হওয়ার পর অথবা যোগদানের তারিখ থেকে এক বছরের জন্য নিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করা যেতে পারে। তবে এ ধরনের নির্দেশনা পাওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন ওই সময়ের বোর্ড চেয়ারম্যান হাবিবুর রহমান। তিনি গণমাধ্যমকে বলেন, তার বোর্ডের সুপারিশে এমডি নিয়োগ হয়নি। তাকসিম খানের পঞ্চম দফার মেয়াদ শেষ হবে আগামী ১৪ অক্টোবর। এখন ষষ্ঠ দফায় নিয়োগের জন্য চেষ্টা চলছে বলে জানা গেছে। ওয়াসার পরবর্তী বোর্ড সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হতে পারে বলে জানান বোর্ড চেয়ারম্যান এম এ রশিদ সরকার।
এমডির নিয়োগ প্রক্রিয়া অবশ্যই স্বচ্ছ হওয়া উচিত বলে মনে করেন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আলী ইমাম মজুমদার। তিনি বলেন, ওয়াসার আইনটিও এমন হওয়া উচিত, যাতে একজন দীর্ঘদিন একই পদে থাকতে না পারেন।
জানা গেছে, আবারো এমডি পদে আসীন হতে ওয়াসায় কয়েকটি গ্রুপকে দিয়ে প্রচারণাও চালাচ্ছেন তাকসিম এ খান। এর মধ্যে গত ১৪ আগস্ট ঢাকা ওয়াসা প্রকৌশলী সমিতি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, কিছু স্বার্থন্বেষী মহল ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খানের বিরুদ্ধে ব্যাপক অপপ্রচার চালাচ্ছে। এতে ওয়াসার সর্বস্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সুনাম ক্ষুন্ন হচ্ছে। ওয়াসার এমডি একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান। তিনি কখনোই দুর্নীতির বিরুদ্ধে আপোষ করেন নাই। জিরো টলারেন্স নীতিতে তিনি সততা ও নিষ্ঠার সাথে ওয়াসাকে পরিচালনা করছেন।  
একদিকে যখন একটি পক্ষ এমডির জন্য কাজ করছে তখন ওয়াসা কর্মকর্তা-কর্মচারী ব্যানারে আরেকটি অংশ এমডির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তারা একটি প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানায়, বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার মানসে নিজের আখের গোছানোর এজেন্ডা বস্তিবায়নেই বেশী তৎপর রয়েছেন। এর অংশ হিসেবে এমডি গড়ে তুলেছেন ‘আরএএমএস’ বাহিনীও। এ বাহিনী সরকার বিরোধীদের অবৈধ সুযোগ সুবিধা দিতেই বেশী ব্যস্ত রয়েছে। এই বাহিনীর মাধ্যমে এমডি প্রধানমন্ত্রীকে ভুল বুঝিয়ে অসত্য ও বানোয়াট তথ্য প্রদান করে যাচ্ছে। এমডি সরকার সমর্থকদের নিপীড়নের মধ্যে ফেলে সরকার বিরোধীদের পদোন্নতিসহ অবৈধ সুযোগ সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে। তারা এ বিষয়ে সরকারের সদয় দৃষ্টি কামনা করেন।
ঢাকা শহরে পানি সরবরাহ ও পয়ঃনিষ্কাশনের উদ্দেশ্যে ১৯৬৩ সালে যাত্রা হয় ঢাকা ওয়াসার। সে সময়ের একটি অধ্যাদেশ অনুযায়ী চলত সংস্থাটি। পরে ১৯৯৬ সালে ‘ওয়াসা অ্যাক্ট’ নামে নতুন আইন হয়। এ আইন অনুযায়ী সংস্থাটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হচ্ছেন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি)। বোর্ড চেয়ারম্যান থাকলেও সভা ডাকা ছাড়া তার একক কোনো ক্ষমতা নেই। এখনও ঢাকা ওয়াসার সব ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছেন তাকসিম এ খান। আগামী ১৪ অক্টোবর মেয়াদ শেষ হবে তার। তাই মেয়াদ বাড়াতে এর মধ্যেই শুরু হয়েছে দৌড়ঝাঁপ।
এভাবে এমডির নিয়োগ নিয়ে গত ২০ জুলাই একটি বিবৃতি দিয়েছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। বিবৃতিতে ঢাকা ওয়াসায় সুশাসন নিশ্চিত করতে শীর্ষ পদে নিয়োগে আইনের যথাযথ অনুসরণ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার দাবি জানানো হয়েছে। এ সম্পর্কে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বিধিসম্মতভাবে কাউকে নিয়োগ দিলে আমাদের কিছুই বলার থাকতে পারে না। কিন্তু তার প্রথমবারের নিয়োগেই সমস্যা ছিল। এর পরে আরও চার দফা মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। বিধি মেনে পাঁচ দফার জায়গায় আরও মেয়াদ বাড়ালেও টিআইবির আপত্তি ছিল না। প্রথমবার নিয়োগ দেওয়ার সময় বিজ্ঞপ্তিতে যে যোগ্যতা-দক্ষতা-অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়েছিল, তা তাকসিম খানের ছিল না। তার পুনর্নিয়োগের ক্ষেত্রেও বিধি মানা হয়নি।
ওয়াসা ঘুরে দাঁড়াবে। দায়িত্ব নেয়া পর একথা বলেছিলেন তাকসিম এ খান। কিন্তু গত ১১ বছর পরও এই ঘুরে দাঁড়ানো শেষ হয়নি, যেমনীভাবে শেষ হচ্ছেনা এই শীর্ষ কর্মকর্তার মেয়াদও। জানা গেছে, টানা পাঁচবার নিয়োগ পাওয়া এই কর্মকর্তার নিজের নিয়োগ, তার মাধ্যমে দেওয়া অন্যদের নিয়োগসহ নানা ক্ষেত্রে আছে বিতর্ক। দুর্নীতির অভিযোগ গেছে দুদক পর্যন্ত। কিন্তু কোনো কিছুরই ফয়সালা হয় না। এমডির ভয়ে কর্মকর্তারা মুখ খোলেন না। জনসেবার উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত সংস্থাটি এখন এমডি শাসিত প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে।
জানা গেছে, প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো, ঠিকাদার নিয়োগে সিন্ডিকেট, ঘুষ লেনদেন, পদ সৃষ্টি করে পছন্দের লোককে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ, অপছন্দের লোককে ওএসডি করাসহ বিস্তর অভিযোগ ওয়াসার এমডির বিরুদ্ধে। গত বছর ওয়াসার ১১টি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দিয়েছিল দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ওয়াসার প্রকল্পগুলো নির্দিষ্ট সময়ে শেষ হয় না। নানা প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানো হয়। অনেক ক্ষেত্রে প্রকল্পের নকশা ও বিবরণ অনুযায়ী কাজ করা হয় না। প্রকল্পে পরামর্শক ও ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে এমন কিছু শর্ত আরোপ করা হয়, যাতে নির্দিষ্টসংখ্যক ঠিকাদার প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারেন। এ ছাড়া ঠিকাদার নির্বাচনের ক্ষেত্রে সিন্ডিকেট পদ্ধতি ও রাজনৈতিক পরিচয় এবং কাজ পাওয়ার বিনিময়ে ঘুষ লেনদেন বর্তমানে একটি প্রচলিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। দুদকের প্রতিবেদন বলছে, ব্যক্তিমালিকানাধীন গভীর নলকূপ স্থাপন, মিটার রিডিং ও রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রেও ব্যাপক দুর্নীতি হয়।
ঢাকা ওয়াসার মূল দায়িত্বগুলোর মধ্যে রয়েছে নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা, পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা এবং পানিবদ্ধতা নিরসন করা। তাকসিম এ খান দায়িত্ব গ্রহণের পর সেবার মান বাড়াতে ২০১০ সালে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ নামে একটি কর্মসূচি চালু করা হয়। এখন ১১ বছর পর দেখা যাচ্ছে, সেবা প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি, গ্রাহক পর্যায়ে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে, জলাবদ্ধতা কমেনি, বরং বেড়েছে। এ ছাড়া পানির মান নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও গত ১২ বছরে অন্তত ১৩ বার পানির দাম বেড়েছে। ২০০৯ সালে যে পানির দাম ছিল পৌনে ৬ টাকা, এখন তা ১৪ টাকা ৪৬ পয়সা। বাণিজ্যিক ক্ষেত্রে সেটি প্রায় ৪০ টাকা। ওয়াসার হিসাব বলছে, ঢাকার ৮০ শতাংশ এলাকায় এখনো পয়োবর্জ্য নিষ্কাশনের ব্যবস্থা নেই। সামান্য বৃষ্টি হলেই ঢাকা ডুবে যাওয়া এখন দৃশ্যমান। ওয়াসা এমন ঘুরে দাঁড়িয়েছে যে খোদ সংস্থাটির প্রধান কার্যালয়ের সামনেই জলাবদ্ধতা হয়। এ সময় ঢাকা ওয়াসাকে সচল করতে বিভিন্ন সময়ে তিনি ২৬ হাজার কোটি টাকার প্রকল্প নিয়েছেন। কিন্তু ওয়াসা ঘুরে দাঁড়ায়নি। নগর পরিকল্পনাবিদদের মতে, দুর্নীতির কারণে ‘ঘুরে দাঁড়াও ঢাকা ওয়াসা’ প্রকল্প কার্যত ব্যর্থ হয়েছে।
সূত্র মতে, ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের মাত্রা কমাতে সাত হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে নেওয়া হয় পদ্মা-জশলদিয়া প্রকল্প। যার আওতায় পদ্মা থেকে পানি এনে রাজধানীতে সরবরাহ করে পানির চাহিদা পূরণ করার কথা। কিন্তু মাওয়ার জশলদিয়া পয়েন্টে ৮২ একর জমিতে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের শুরুতেই অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স চায়না সিএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে দরকষাকষি না করায় শুরুতেই ওয়াসার ৩৫০ কোটি টাকার আর্থিক ক্ষতি হয়। ওয়াসার শীর্ষ কর্তাদের বিরুদ্ধে এ বিষয়ে অভিযোগ আছে যে তারা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিয়েছিলেন। পরে ৩৩ কিলোমিটার পাইপলাইনের জন্য চীন থেকে এক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাইপ আমদানি করা হয়। এ পাইপের ব্যাস ২১ মিলিমিটার হওয়ার কথা থাকলেও ছিল ১৫ দশমিক পাঁচ মিলিমিটার। পুরুত্বও দেওয়া হয় কম- ২২ মিলিমিটারের (কে-১০) পরিবর্তে ১৯ মিলিমিটার (কে-৯)। অভিযোগ, কম দামে কম ব্যাসের পাইপ এনে অর্থ আত্মসাৎ করা হয়েছে। ফলে একাধিকবার পাইপ ফেটে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে। এভাবে জোড়াতালি দেওয়ায় দৈনিক পানি মিলছে ৪৫ কোটি লিটারের পরিবর্তে মাত্র ১৫ কোটি লিটার। এসব ঘটনায় দুদকে নিয়মিত হাজিরা দিচ্ছেন ওয়াসার এমডি ও প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালকরা। ২০১৭ সালের ২১ নভেম্বর ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তাকসিম এ খান সাংবাদিক সম্মেলন করে ঘোষণা দেন- ‘ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের জন্য সাভারের ভাকুর্তায় একটি পানির খনি পাওয়া গেছে। হিমালয় থেকে একটি চ্যানেল হয়ে ভাকুর্তায় এসে এ পানি জমা হচ্ছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেই খনি থেকে প্রতিদিন ১৫ কোটি লিটার পানি তোলা হবে। তবে এতে সেখানে শূন্যতা সৃষ্টি হবে না। হিমালয়ের পানি চ্যানেল দিয়ে এসে শূন্যস্থান ভরাট করবে।’ এ জন্য ঢাকা ওয়াসা ৫৭৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাকুর্তায় ৪৬টি গভীর নলকূপ স্থাপনের প্রকল্প নেয়। কিন্তু ১৫টি নলকূপ চালুর পরই আশপাশের টিউবওয়েলে পানি ওঠা বন্ধ হয়ে যায়। এতে অন্য ৩১টি নলকূপ চালুই করা যায়নি। সেগুলো পড়ে আছে ফাঁকা মাঠে। তবে প্রকল্পের সব অর্থই ব্যয় হয়ে গেছে।
অভিযোগে প্রকাশ, ষষ্ঠবারের মতো এমডি পদে নিয়োগ পেতে নানা কৌশল নিয়েছে তাকসিম এ খান। এর মধ্যে গত কিছুদিন ধরে তিনি ওয়াসাতে রামরাজত্ব কায়েম করেছেন। আইনের তোয়াক্কা না করে পিপিআই প্রকল্পের সব সম্পত্তি কোনো রকমের আনষ্ঠানিক ঘোষণা ছাড়াই ওয়াসর দখলে নিয়েছেন। পিপিআইর শত কোটি টাকার ফ্রিজিং করে রেখেছেন। যারা তার বিরুদ্ধে কথা বলছে তাদের চাকরীচ্যুতি, ওএসডি, বা বদলী করছেন। তিনি সম্পতি ওয়াসার প্রশাসনিক কর্মকর্তা, সিবিএ নেতা, ইঞ্জিনিয়ারসহ বিভিন্ন পর্যায়ের লোকবলদের নিয়ে ভার্চুয়াল মিটিং করছেন। এসব মিটিংয়ে তিনি বলছেন, তার পক্ষে কাজ করতে। অন্যথায় বিপদে পড়তে হবে। জানা গেছে, নির্বাহী প্রকৌশলী অসীম কুমার ঘোষকে বিনা কারণে বরখাস্ত করা হয়। প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মো. আজিমুজ্জামান, নির্বাহী প্রকৌশলী কাজী খায়রুল বাশার এবং মোজাম্মেল হককেও ওএসডি করে রাখা হয়েছে। নির্বাহী প্রকৌশলী মহিউদ্দিন আরিফ, উপসচিব আলমগীর হোসেন, শহিদুল ইসলাম, নির্বাহী প্রকৌশলী জাহিদুর রহমান, নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা মিজানুর রহমান, সহকারী সচিব নুরুজ্জামান মিয়াজী, অফিস তত্ত্বাবধায়ক এমএম ইকরাম, পিএলআই রফিকুল ইসলাম, এলডিএ কাম ক্যাশিয়ার শাহাবুদ্দীন ও পিএ কাম কম্পিউটার অপারেটর ইউসুফ আলীকে ওএসডি করে রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। সিএও রত্নচিফ বর্মনকে ডিমোশন দিয়ে জুনিয়র একজনকে তার জায়গায় বসানো হয়েছে। পাইপলাইন ইন্সপেক্টর শাহাবুদ্দিন সরকার, অফিস সহযোগী আনোয়ার হোসেন খান লাবুকেও হাস্যকর অভিযোগে বরখাস্ত করা হয়।
সার্বিক বিষয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিম এ খান বলেন, গত ১১ বছরে ওয়াসায় ব্যাপক পরিবর্তন ঘটেছে। দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ওয়াসা এখন রোল মডেল। মানুষ এখন বাসায় বসে ওয়াসার বিল দিতে পারেন। অনলাইনে অভিযোগ জানাতে পারেন।  ঢাকা ওয়াসা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। মানুষ আগের তুলনায় অনেক বেশি সেবা পাচ্ছে। ড্রেনেজ ব্যবস্থা অনেক ভালো। দুর্ণীতি প্রসঙ্গে তিনি বলেন, লিখিতভাবে কেউ অভিযোগ করলে সেটির জবাব জানাবো।  পানির মূল্য বাড়ানো প্রসঙ্গে ওয়াসার এমডি বলেন, ইতোমধ্যে বিদ্যুতের দাম অনেকবার বেড়েছে। ১০ বছর আগে যে দামে পানি শোধনের মালপত্র পাওয়া যেত, এখন কি সেই দর আছে। সবকিছুর সাথে পল্লা দিয়েই পানির দাম বাড়ানো হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ