শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নতুন স্বপ্ন নিয়ে আবারও শেয়ারবাজারে সক্রিয় হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজারে হঠাৎ করেই টানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে। পতনের ধারা কাটিয়ে টানা ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা চলছে মূল্য সূচকের। তলানিতে নেমে যাওয়া লেনদেন আবারও গতি ফিরে পেয়েছে। ফলে নতুন স্বপ্ন নিয়ে আবারও শেয়ারবাজারে সক্রিয় হচ্ছেন বিনিয়োগকারীরা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নতুন কমিশনের সম্প্রতি কয়েকটি সিদ্ধান্তে বিনিয়োগকারীদের আস্থা কিছুটা ফিরে এসেছে। এতে বাজার ইতিবাচক ধারায় ফিরেছে।

বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, ধীরে ধীরে লেনদেন খরা কাটিয়ে উঠছে দেশের শেয়ারবাজার। গতকাল বুধবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) ৭০০ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়েছে। এর মাধ্যমে দেড় মাসের মধ্যে বাজারটিতে সর্বোচ্চ লেনদেন হয়েছে। মহামারি করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে শেয়ারবাজারের ভয়াবহ ধস নামে। এর প্রেক্ষিতে গত ১৯ মার্চ প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ারের ফ্লোর প্রাইস (সর্বনি¤œ দাম) নির্ধারণ করে নতুন সার্কিট ব্রেকার চালু করা হয়।

এতে দরপতন ঠেকানো গেলেও বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার লেনদেন একপ্রকার বন্ধ হয়ে যায়। ফলে লেনদেনে অংশ নেয়া সিংহভাগ প্রতিষ্ঠানের দাম অপরিবর্তিত থাকে। ফলে দেখা দেয় লেনদেন খরা। ধারাবাহিকভাবে কমে ডিএসইর লেনদেন ৫০ কোটি টাকার ঘরে নেমে আসে। অবশ্য গত কয়েকদিন ধরে লেনদেন বাড়তে থাকায় ঈদের আগের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর লেনদেন ৫০০ কোটি টাকার ঘরে স্পর্শ করে। ঈদের পরেও অব্যাহত থাকে লেনদেনের গতি। ঈদের ছুটি শেষে সোমবার শেয়ারবাজার খুললে ডিএসইতে ৬০০ কোটি টাকার ওপরে লেনদেন হয়। মঙ্গলবারও লেনদেন হয় ৬০০ কোটি টাকার ওপরে। আর গতকাল বুধবার তা আরও বেড়ে ৭০০ কোটি টাকার ঘরে পৌঁছেছে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ এবং মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপের মধ্যেও ব্যবসা-বাণিজ্য অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে আসায় শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। তারা বলছেন, শেয়ারবাজারের মূল সমস্যা ছিল আস্থার সংকট। আস্থার সংকটের কারণেই শেয়ারবাজার এতো দিন ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। বিএসইসির নতুন চেয়ারম্যান অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামের নেতৃত্বাধীন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বেশকিছু সাহসী পদক্ষেপ নিয়েছেন। বিএসইসির এমন ভূমিকায় শেয়ারবাজারের ওপর সাধারণ বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে।

এদিকে বিনিয়োগকারীরা বলছেন, করোনা ভাইরাসের প্রকোপ শুরু হওয়ার আগে থেকেই শেয়ারবাজারে মন্দা চলছে। ধারাবাহিক দরপতনে পুঁজি হারিয়ে বেশিরভাগ বিনিয়োগকারী বাজারের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন। এমন পরিস্থিতিতেই মহামারি করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হয়। ফলে শেয়ারবাজারে ভয়াবহ ধস নামে। এতে প্রায় সব বিনিয়োগকারী বড় ধরনের লোকসানের মুখে পড়েন। তারা বলছেন, কয়েক দিন ধরে শেয়ারবাজারে টানা উত্থান প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এতে বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। তবে এরপরও লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। ভয়াবহ ধসের কবলে পড়ে যে পরিমাণ লোকসান হয়েছে তা কাটিয়ে উঠতে আরও সময় লাগবে। তবে নতুন কমিশন দায়িত্ব নিয়ে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া শুরু করেছে তা অব্যাহত থাকলে শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরে আসবে এবং লোকসান কাটিয়ে বিনিয়োগকারীরা মুনাফার মুখ দেখবেন।

সূচক ফিরেছে সাড়ে ৩০০ পয়েন্ট: ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজার মূলত ঘুরে দাঁড়ানো শুরু করে গত ৭ জুন থেকে। মাঝে মধ্যে ছোট দরপতন হলেও মূলত ওই সময় থেকেই ঊর্ধ্বমুখী ধারায় রয়েছে শেয়ারবাজার। এতে ডিএসই'র প্রধান মূল্য সূচক বেড়েছে ৩৫৪ পয়েন্ট। অবশ্য এর মধ্যে শেষ আট কার্যদিবসেই সূচকটি বেড়েছে ২২৭ পয়েন্ট। গতকাল বুধবার ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স আগের কার্যদিবসের তুলনায় ৮ পয়েন্ট বেড়ে ৪ হাজার ৩০৭ পয়েন্টে উঠে এসেছে।

৫০ কোটি টাকার লেনদেন পৌঁছেছে ৭০০ কোটিতে: আস্থা সংকটে ধুঁকতে থাকা শেয়ারবাজারে দেখা দেয় মারাত্মক লেনদেন খরা। দরপতন ঠেকাতে বিএসইসির আগের কমিশন প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের শেয়ার দামে ফ্লোর প্রাইস (দাম কমার সর্বনি¤œ সীমা) নির্ধারণ করে দিলে এই লেনদেন খরা শুরু হয়। ডিএসইর লেনদেন কমে ৫০ কোটি টাকায় নেমে আসে। নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পরও ফ্লোর প্রাইস অব্যাহত রেখেছে। তবে তলানিতে নেমে যাওয়া লেনদেন আবার ৭০০ কোটি টাকায় উঠে এসেছে। ঈদের পরের দুই কার্যদিবস মঙ্গলবার ৬৭৬ কোটি এবং সোমবার ৬৭২ কোটি টাকার লেনদেন হয়েছে। আর ঈদের আগের শেষ কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৫৮০ কোটি টাকার।

বাজারে ফিরেছে ২১ হাজার কোটি টাকা : ধস কাটিয়ে শেয়ারবাজার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতায় ফিরে আসায় বাজারে ২১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা ফিরে এসেছে। তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বাড়ার মাধ্যমে এই অর্থ ফিরেছে। ধসের কবলে পড়ে ৪ জুন ডিএসইর বাজার মূলধন ৩ লাখ ৯ হাজার ৯৬৬ কোটি টাকায় নেমে যায়, সেই বাজার মূলধন এখন ৩ লাখ ৩১ হাজার ২৩৬ কোটি টাকায় উঠে এসেছে।

শেয়ারবাজারের এই চিত্র সম্পর্কে বিনিয়োগকারী আশরাফুল আলম বলেন, শেয়ারবাজার ধস কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে এটা আমাদের জন্য আশার কথা। কিন্তু পতনের কবলে পড়ে আমরা যে পরিমাণ অর্থ হারিয়েছি তার খুবই সামান্য অংশ ফিরে এসেছে। ডিএসইর বাজার মূলধনের দিকে তাকালেই তা স্পষ্ট হয়ে যাবে। পতনের কবলে পড়ে বিনিয়োগকারীরা এক লাখ কোটি টাকার ওপরে হারিয়েছেন, সেখানে কেবল ২১ হাজার কোটি টাকা ফিরেছে। তিনি বলেন, এখনও প্রায় সব সাধারণ বিনিয়োগকারী লোকসানে রয়েছেন। তারপরও বাজারের যে গতি দেখছি, বিশেষ করে বিএসইসির পদক্ষেপ নিয়ে নতুন করে আশাবাদী হওয়া যায়। অনিয়মের কারণে বেশ কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে বিএসইসি জরিমানা করেছে। একাধিক দুর্বল কোম্পানির প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) বাতিল করে দিয়েছে। বিএসইসি এই অবস্থা ধরে রাখতে পারলে শেয়ারবাজারে সুদিন ফিরবেই। আমরাও লোকসান কাটিয়ে মুনাফার মুখ দেখতে পারবো।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের পরিচালক শাকিল রিজভী বলেন, শেয়ারবাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। যার ফলে এমন টানা উত্থান প্রবণতা দেখা দিয়েছে এবং লেনদেনের গতি বেড়েছে। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ কমে আসায় এবং নিয়ন্ত্রক সংস্থার নতুন কমিশন বেশ কিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নেয়ায় বাজারের ওপর এই আস্থা বাড়ছে। তিনি বলেন, নতুন কমিশন কয়েকটি দুর্বল কোম্পানির আইপিও বাতিল করেছে। বাজারে এসব তথ্য ছড়িয়ে পড়েছে। এছাড়াও বেশকিছু ইতিবাচক পদক্ষেপ নিয়েছে। সব মিলিয়ে নিয়ন্ত্রক সংস্থা ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা বেড়েছে।

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক বলেন, নতুন কমিশন বেশকিছু ভালো পদক্ষেপ নিয়েছে, এতে বাজারের ওপর বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে। যার কারণে শেয়ারবাজারে টানা উত্থান দেখা দিয়েছে। তবে আমাদের বিনিয়োগকারী ভাইয়েরা এখনো অনেক লোকসানে রয়েছেন। বিএসইসিকে অনিয়কারীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ অব্যাহত রাখতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ