শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

পশু সঙ্কটের আশংকায় ক্রেতা-বিক্রেতারা

তোফাজ্জল হোসাইন কামাল : আসন্ন ঈদ-উল-আজহায় কোরবানির পশু ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য রাজধানীতে পশুর হাট অন্য বছরের তুলনায় কম বসবে। চাহিদা সত্ত্বেও ঘন জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বসবে না এবার পশুর হাট। এমনকি যেসব হাটে চাহিদামাফিক দর পাওয়া না যায় সেক্ষেত্রে এ বছর নিজ উদ্যোগে হাট চালু রাখতে কোন প্রকার খাস আদায়ও করবে না ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন। নাগরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার কথা বিবেচনা করে করোনার বিস্তার রোধে এমন উদ্যোগ নিচ্ছে ওই দুই সংস্থাই। একইসঙ্গে করোনা পরিস্থিতিতে পশুর হাটে সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিটি পশু ব্যবসায়ী, ইজারাদার ক্রেতা বিক্রেতাকে মানা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এদিকে পশুর হাটের সংখ্যা কমানো হলে পশু কম আসলে নাগরিকদের কোরবানির পশু ক্রয়ে ভয়াবহ সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা করছেন নগর বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে প্রতিটি পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মনিটরিংয়ের জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্রাম্যমাণ আদালত বসানো হবে বলে দুই সিটি কর্পোরেশনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। এবার প্রতিটি পশু কেনাবেচা করার সুবিধার্থে নির্দিষ্ট দূরত্ব হিসেবে কমপক্ষে ৫ ফুট দূরত্বে পশু বাঁধতে হবে।
অপরদিকে দেশে যখন সংক্রমণের হার ঊর্ধ্বমুখী তখন কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাট বসানো হলে ‘ম্যাসাকার’ হবে বলে আশঙ্কা করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর সক্ষমতা আমাদের নেই বলে জানিয়েছেন তারা। দেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) বলেছে জনসমাগম এড়িয়ে চলতে হবে।
জানা গেছে , ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন (ডিএনসিসি) ও ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) স্থায়ী ও অস্থায়ীসহ মোট ২৬ পশুর হাট বসানোর উদ্যোগ নিলেও করোনার বিস্তাররোধ করা, এ বছর হাট ইজারার জন্য পর্যাপ্ত দরদাতা না পাওয়া এবং হাট নিয়ে গড়ে ওঠা সিন্ডিকেট রোধে এমন উদ্যোগ নিয়েছেন ঢাকার দুই মেয়র। ঢাকা উত্তরে গাবতলী ও দক্ষিণে ডেমরায় ২টি স্থায়ী হাট বসবে। এছাড়া উত্তরে ১০টি ও দক্ষিণে ১৪টি অস্থায়ী পশুর হাট বসানোর উদ্যোগ নেয় ২ সিটি কর্পোরেশন। এর মধ্যে বেশ কয়েকটি হাট নানা কারণে এবছর বন্ধ থাকবে বলে জানা গেছে। রেড জোন এলাকাতেও পড়েছে পশুর হাট।
এদিকে ইতোমধ্যেই ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র আতিকুল ইসলাম ঘনবসতিপূর্ণ ও অধিক জনসমাগম হয় এমন এলাকায় পশুর হাট বসাবেন না ঘোষণা দিয়েছেন। সবমিলিয়ে তাই পশুর হাট কমবে। অপরদিকে সরকার ঘোষিত দর না পেলে অন্য বছরের ন্যায় খাস আদায় করে হাট পরিচালনা করাও বন্ধ রাখবে বলে জানিয়েছে ডিএসসিসি কর্তৃপক্ষ।
সূূত্র জানায়, করোনাকালেও ঢাকার দুই সিটিতে পশুর হাট ইজারা নিতে একটি সিন্ডিকেট গড়ে উঠেছে। এখন পর্যন্ত ঢাকা উত্তরের ২টি হাটে মাত্র একটি করে হাটের দরপত্র জমা দিয়েছে। এদিকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৩টি হাটের জন্য কোন প্রকার দরপত্রই জমা দেয়নি কোনো ইজারাদার। এছাড়া ২টি হাটের সরকারি দরমূল্য পায়নি প্রথম দফা দরপত্রে। এর বাইরে ডিএনসিসির ৫টি হাটের ইজারার জন্য দেয়া সরকারি মূল্যের চেয়ে ৫-৬ গুণ পর্যন্ত দর কম দাখিল করেছেন ইজারাদারগণ। যা ভয়াবহ দরপতন। তাই এ বছর দুই মেয়র সংস্থার রাজস্ব আদায় কম হলেও কোন প্রকার সিন্ডিকেট না রাখার ঘোষণা দিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে সিন্ডিকেট ভাংতেও কম পশুর হাট বসানোর দিকে মনোযোগ দিয়েছে সংস্থা দুটি এমনটাও জানা গেছে।
ডিএসসিসির সম্পত্তি শাখা সূত্র জানায়, দরপত্র আহ্বান করা হাটের প্রকৃত মূল্যে দরদাতা না পাওয়া গেলে বা যেসব হাটের সরকারি দরের চেয়ে অনেক কম দর পাওয়া যাবে সেসব হাটের ইজারা প্রদান বন্ধ থাকবে। এমনকি নিজ দায়িত্বে খাস আদায় করার পদ্ধতিও বন্ধ রাখবে সংস্থাটি। ফলে ইজারা মূল্য না পাওয়া হাটগুলোতে এবছর কোন পশুর হাট বসবে না। তাই স্বাভাবিকভাবেই কম পশুর হাট বসবে। এছাড়া করোনার জন্য ক্ষুদ্র পরিসরে বা অল্প স্থানে পশুর হাট না বসানোর পক্ষে ডিএসসিসি।
ডিএনসিসি সূত্র জানায়, ঢাকা উত্তরের আবাসিক এলাকায় ও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোন হাট বসতে দেয়া হবে না। এছাড়া যেসব হাট বসবে সেসব স্থান হবে তুলনামূলক ফাঁকা স্থানে। ডিএনসিসি এ পর্যন্ত মোট ১০টি অস্থায়ী পশুর হাটের ইজারা দিতে দরপত্র দাখিল করেছে। এসব হাটের মধ্যে এ বছর পূর্বাচল এলাকার ডুমনি মস্তুুল এলাকায় সম্পূর্ণ নতুন হাট বসাবে সংস্থাটি। এছাড়া বাকি ৯টি হাট পুরনো। তবে ইজারার দরপত্র আহ্বান করলেও শেষ পর্যন্ত হাটের সংখ্যা কমানোর ঘোষণা দিয়েছেন মেয়র আতিকুল ইসলাম।
ঘোষিত হাটের মধ্যে উত্তরায় গত বছর তিনটি হাট বসালেও এবছর তা একটিতে নামিয়ে আনা হবে এছাড়া ডেমরায় ও ঢাকা পলিটেকনিকেলের পশুর হাট বাতিলের পরিকল্পনা করা হচ্ছে। এদিকে রামপুরা আফতাবনগর এলাকায় দুই সিটির দুটি হাটের পরিবর্তে একটি হাট বসবে। মোহম্মদপুর এলাকার জন্য বসিলায় হাট বসাবে এছাড়া সকল হাটই হবে খোলা স্থানে।
জানতে চাইলে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান সম্পত্তি কর্মকর্তা রাসেল সাবরিন বলেন,আমরা করোনার বিস্তার রোধে পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি রক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছি। এরই অংশ হিসেবে আমরা সরকারি দর অনুযায়ী পশুর হাটের ইজারা না পেলে অন্যান্য বছরের ন্যয় নিজস্ব পদ্ধতিতে খাস আদায় করে পশুর হাট পরিচালনা করব না। দর না পেলে এসব পশুর হাট এ বছর বন্ধ থাকবে।
ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় নিয়ে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় কোরবানি পশুর হাট বসাব না। আমাদের শহরে ঘনবসতিপূর্ণ স্থানে যদি পশুর হাট বসে সেটি কিন্তু জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। মেয়র বলেন, হাট ইজারা দিয়ে হয়তো কোটি টাকা আয় করা যাবে, কিন্তু টাকার চেয়ে মানুষের জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

হাট নিয়ে জনস্বাস্থ্যবিদদের শঙ্কা
কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে পশুর হাট বসানো হলে ‘ম্যাসাকার’ হবে বলে আশঙ্কা করেছেন জনস্বাস্থ্যবিদরা। পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানানোর সক্ষমতা আমাদের নেই বলে জানিয়েছেন তারা।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসমাগমে না যাওয়াই হচ্ছে করোনা থেকে বাঁচার প্রথম শর্ত। সেখানে পশুর হাটে মানুষ কীভাবে নিরাপদ থাকবে। এমনিতেই মানুষের মধ্যে হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব মেনে চলা বা মাস্ক পরার মতো বিষয়ে উদাসীনতা রয়েছে। আর গরুর হাটে কোনোভাবেই করোনা প্রতিরোধের এই তিন ‘বেসিক’ মেনে চলা সম্ভব নয়।
রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘সংক্রমণের হার যখন ঊর্ধ্বমুখী তখন এমন ভাবনা একেবারেই যুক্তিহীন, ভিত্তিহীন। এখনতো চারিদিকে সংক্রমণ, বায়োলজিক্যালি পশুর হাটে স্বাস্থ্যবিধি মানা সম্ভব নয়। যখন একটা দেশে মহামারি হয়, তখন যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে। মহামারিকে নিয়ন্ত্রণে না এনে জনসমাগম করা যাবে না, এটা আত্মঘাতী হবে।’
জনস্বাস্থ্যবিদ চিন্ময় দাস বলেন, ‘স্বাস্থ্যবিধি তো মানুষ এমনিতেই মানছে না। সেখানে পশুর হাট কী করে হয়। এটা কোনোভাবেই কন্ট্রোল মতো পথ নেই, আমরা এখনও এভাবে প্রশিক্ষিত না-এটা বুঝতে হবে।’
স্বাস্থ্যবিধি মেনে কী করে পশুর হাট! বিজ্ঞান এবং জনস্বাস্থ্য একে পারমিট করে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘কোরবানি জরুরি কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে কোরবানির পশুটি হাটে গিয়ে কিনতে হবে, বিকল্প ভাবা জরুরি।’

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ