শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

ভারী বৃষ্টিপাতে এবারো ডুববে রাজধানীর অধিকাংশ এলাকা

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল: পানিবদ্ধতা নিরসনে রাজধানীবাসীর জন্য এবারো ভালো কোনো খবরের ব্যবস্থা করতে পারেনি ঢাকা ওয়াসাসহ সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন ধরে চলা এ সঙ্কট সমাধানে এক প্রতিষ্ঠান অন্য প্রতিষ্ঠানকে দোষারোপ করে যাচ্ছে। অধশতাধিক পানিবদ্ধতা প্রবণ এলাকা নিয়ে বেকায়দায় রয়েছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি)। পানি নিষ্কাশনের অধিকাংশ চ্যানেল অকার্যকর হয়ে পড়ায় এমন পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা দক্ষিণের ৩২টি ও উত্তরের ২৯টি এলাকা রয়েছে। ফলে এ বছরও ঢাকাবাসী পানিবদ্ধতার মুখোমুখি হবে বলে আশঙ্কা করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, এলাকাভিত্তিক পানিবদ্ধতা নিরসনে একাধিক প্রকল্প গ্রহণ করেছে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এরমধ্যে বেশ কয়েকটি এলাকার সমস্যার সমাধান করা হয়েছে। তবে পানি নিষ্কাশনের বড় বড় সার্ফেস ড্রেনগুলো হচ্ছে ঢাকা ওয়াসার। সেগুলো পরিষ্কার না থাকায় পানি নিষ্কাশন ব্যাহত হচ্ছে বলে মনে করছে সিটি করপোরেশন। এ অবস্থায় সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণের কথা বলছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এতে সাময়িক নিরসন হলেও টেকসই সমাধান মিলবে না।
ডিএনসিসির পানিবদ্ধতাপ্রবণ এলাকা হচ্ছে আশকোনা, বিমানবন্দর সড়কের আর্মি স্টেডিয়াম থেকে বনানী ২৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত, মিরপুর সাংবাদিক কলোনি এলাকা, নয়াটোলা শহীদ আবদুল ওয়াহাব রোড, উত্তর বেগুনবাড়ি, মোহাম্মদপুর, লালমাটিয়া, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, পূর্ব মনিপুর, দক্ষিণ মনিপুর, আমতলা, পিরেরবাগ, মিরপুর ১০, মিরপুর ১৩, বাংলামোটর বিয়াম ভবনের গলি, মধুবাগ প্রধান সড়ক, শাহসাহেববাড়ি, কাওরানবাজার টিসিবি ভবন সংলগ্ন এফডিসি থেকে সার্ক ফোয়ারা, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ সরণি, নিকুঞ্জ-১, নিকুঞ্জ-২, পশ্চিম নাখালপাড়া, পাগলারপুল, পূর্ব রাজাবাজার, পশ্চিম রাজাবাজার, বসুন্ধরা সিটির পেছনে তেজতুরী বাজারের গার্ডেন রোড, গ্রিন রোড এবং উত্তরা ৪ নম্বর সেক্টর।
সমস্যা সমাধানে পানি নামার লাইনগুলোর সংস্কার কাজ সেভাবে হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে।
এরমধ্যে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পের কারণে বিমানবন্দরের সামনে থেকে বনানী ২৭ নম্বর সড়ক পর্যন্ত অংশের পানি নিষ্কাশন নালা নষ্ট হয়ে পড়েছে। নালাটি সচল করার জন্য ডিএনসিসি থেকে সিভিল অ্যাভিয়েশনকে বারবার অনুরোধ করা হলেও তাদের বরাদ্দ না থাকায় সেই কাজ করার উদ্যোগ নিয়েছে ডিএনসিসি নিজেই। তিন কোটি টাকা ব্যয়ে গ্রহণ করা প্রকল্পটির কাজ শেষ হতে আরও দুই মাস সময় লাগতে পারে। মিরপুর সাংবাদিক কলোনি এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে গত বছর খালটি পরিষ্কার করে ডিএনসিসি। পাশাপাশি খালটির সঙ্গে বাউনিয়া খালের সংযোগ স্থাপন করে সংস্থাটি। বর্তমানে খালটি আবারও ময়লা আবর্জনায় ভরে গেছে। ফলে এ বর্ষায়ও আবার পুরনো চিত্র দেখা দেওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা। কাজীপাড়া ও শেওড়াপাড়া এলাকার পানিবদ্ধতা নিরসনে প্রকল্প গ্রহণ করেছে ঢাকা ওয়াসা। তবে এখনও কাজ শেষ হয়নি। ফলে এই বর্ষায়ও স্থানীয় এলাকাবাসীকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে।
১৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর মো. ইসমাইল মোল্লা বলেন, আমার এলাকার অবস্থা খুবই খারাপ। এখানে বৃষ্টি না হলেও রাস্তা ডুবে থাকে। আর বৃষ্টি হলে তো বুঝেন কেমন অবস্থা হয়।
এদিকে হাতিরঝিল সংলগ্ন আশপাশের এলাকাগুলোর সঙ্গে হাতিরঝিল প্রকল্পের সংযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় বর্ষায় তীব্র পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। ভারি বৃষ্টি হলে এই কাঁঠালবাগান, কলাবাগান ও ধানমন্ডি পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া শাশাববাড়ি এলাকার ড্রেন পরিষ্কার করার জন্য ডিএনসিসি থেকে ওয়াসাকে চিঠি দেয়া হলেও ওয়াসা সেই ড্রেন পরিষ্কার করতে পারবে না বলে জানিয়ে দেয় ডিএনসিসিকে।
বৃষ্টির পানি নামার ব্যবস্থা করতে ডিএনসিসি বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নিয়েছে জানতে চাইলে ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের যেসব পথ রয়েছে সেগুলো একেকটি একেক সংস্থার। এখন অন্য সংস্থাগুলো তাদের মালিকানাধীন খাল বা নালা সচল রাখতে কোনও ব্যবস্থা নিচ্ছে না। যে কারণে পানিবদ্ধতা দেখা দেয়। মেয়র ওয়াসার বিরুদ্ধে অভিযোগ করে বলেন, মগবাজার শাহ সাহেববাড়ি এলাকায় ঢাকা ওয়াসার একটি ড্রেন আছে। আমি তাদের চিঠি দিয়েছি ড্রেনটি পরিষ্কারের জন্য। তারা আমাদের জানিয়েছে তারা ড্রেন পরিষ্কার করতে পারবে না। এখন অন্য সংস্থার খালে এবং ড্রেনও আমাদের পরিষ্কার করতে হচ্ছে। অথচ তারা আমাদের কোনও টাকা দিচ্ছে না।
ঢাকা ওয়াসার পরিচালক একেএম সহিদ উদ্দিন বলেন, পানিবদ্ধতা নিরসনে আমরা এবছর অনেক কাজ করেছি। দুই সিটি করপোরেশনকে নিয়ে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। ফলে এবার পানিবদ্ধতা অনেকাংশে কম হবে বলে মনে করছি।
সূত্র মতে, ডিএসসিসির তালিকা অনুযায়ী ৩০টি স্থান হচ্ছে ১৫ নম্বর ওয়ার্ডের ধানমন্ডি ২৭ নম্বর রোড ও পশ্চিম ধানমন্ডি ঈদগাহ রোড; ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের নিউমার্কেট সাইকেল স্ট্যান্ড; ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাসভবনের সামনের ইস্কাটন রোড; ২০ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যালয় এলাকা; ২৭ নম্বর ওয়ার্ডের নাজিমউদ্দিন রোড ও ঢাকা কারাগার সদর দফতরের সামনের অংশ; ২২ নম্বর ওয়ার্ডের গণকটুলী সিটি কলোনির সামনের এলাকা; ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের নবাবগঞ্জ পার্ক; ১৪ নম্বর ওয়ার্ডের ঝিগাতলা কাঁচাবাজার মসজিদের পাশের এলাকা; ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বঙ্কাল ২৮ কে পি ঘোষ স্ট্রিট কসাইটুলী; ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আগাসাদেক রোড, আগামাসি লেন, আব্দুল হাদি লেন, বাংলাদেশ মাঠের সামনের রাস্তা, মাজেদ সরদার রোড ও সিক্কাটুলী; ৩৪ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী আলাউদ্দিন রোড, নাজিরা বাজার, সিদ্দিক বাজার ও আলু বাজার; ৩৬ নম্বর ওয়ার্ডের আওলাদ হোসেন লেন ও নবরায় লেন; ৭, ৩৯ ও ৪৯ নম্বর ওয়ার্ডের মিয়াজান গলি, মাদরাসা গলি, ঋষি পাড়া, কে এম দাস লেন সংলগ্ন রাস্তা, আরকে মিশন রোড ও অভয়দাস লেন গোপীবাগ বাজার রোড এবং ৩৯ নম্বর ওয়ার্ডের ধলপুর স্টাফ কোয়ার্টার ও ১৪ নং আউটফল ধলপুর ওয়াসা রোড।
জানা গেছে, এসব এলাকার মধ্যে পানি নিষ্কাশনে এরইমধ্যে প্রকল্প গ্রহণ করে ড্রেন নির্মাণের কাজ চলছে। ডিএসসিসির প্রধান নগর পরিকল্পনাবিদ সিরাজুল ইসলাম বলেন, আমরা ছোট প্রকল্পের মাধ্যমে সমস্যাপ্রবণ কয়েকটি এলাকার পানিবদ্ধতা দূর করেছি। এর মধ্যে শান্তিনগর, নাজিম উদ্দিন রোড, সচিবালয় এলাকা অন্যতম। এছাড়া প্রায় প্রতিটি এলাকার অলিগলিতে ড্রেন নির্মাণ করা হয়েছে। তবে পানি নিষ্কাশনের বড় বড় ড্রেনের মালিক ঢাকা ওয়াসা। আমাদের ড্রেনের মাধ্যমে ওয়াসার ড্রেনে গিয়ে পানি প্রবাহিত হয়। এখন পানিবদ্ধতা হবে নাকি হবে না তা নির্ভর করছে ওয়াসার ড্রেন বা বক্স কালভার্টের ওপর।
নগরবিদরা বলেছেন, পানি নামার বিভিন্ন লাইন ও নালা পরিষ্কার করা হচ্ছেতবে ভারী বর্ষণ হলে পরিস্থিতি ভয়াবহ আকার ধরণ করতে পারে।  তারা জানান, ঢাকা দক্ষিণে গোপীবাগে ঢাকা ওয়াসার তিনটি পাম্প রয়েছে। এগুলোর প্রতিটির সক্ষমতা প্রতি ঘণ্টায় ১৮ হাজার কিউবিক মিটার। সচিবালয়, গুলিস্তান ও বঙ্গভবনসহ আশপাশের এলাকায় ঘণ্টায় ৩০ থেকে ৩৫ মিলিমিটার বৃষ্টি হলেও এসব পাম্প দিয়ে যে পরিমাণ পানি অপসারণ করা যায় তাতে পানিনিনজট হবে না। তবে এর বেশি বৃষ্টি হলে হবে। এজন্য ঢাকা ওয়াসার পাম্পের সক্ষমতা বাড়ানোর সুপারিশ করেছে তারা।
জানা গেছে, ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে ৭৮১ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার রাস্তা ও ২১৭ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার ফুটপাত, ৪৬৬ দশমিক ৪৩ কিলোমিটার খোলা ও ৪৯৫ দশমিক ৪৪ কিলোমিটার পাইপ ড্রেন রয়েছে। এছাড়া ঢাকা ওয়াসার ১০ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট, ৬৫ কিলোমিটার খাল, ৪টি পাম্পিং স্টেশন, ৫১টি স্লুইস গেট, ৩৪৬ কিলোমিটার পাইপ ড্রেন রয়েছে। এসবের মাধ্যমে ধানমন্ডি লেক, জিরানী-নন্দিপুর খাল, খিলগাঁও-বাসাবো খাল-১, ২ ও ৩, জিরানী খাল, হাজারীবাগ খাল, ধোলাইখাল, সেগুনবাগিচা খাল-১ ও ২ এবং মাণ্ডা খাল রয়েছে। এসব খাল দিয়েই বুড়িগঙ্গা ও বালু নদীতে যায় ঢাকা দক্ষিণের পানি। তবে বড় বড় এই খালের মালিক ঢাকা ওয়াসা। বর্তমানে এসব খালে পানির প্রবাহ নেই। যে কারণে বৃষ্টি হলে পানিবদ্ধতা দেখা দেয়।
রাজধানীতে বৃষ্টির পানি নিষ্কাশনের জন্য সাড়ে ৮ কিলোমিটার বক্স কালভার্ট এবং ৩৫০ কিলোমিটার স্টর্ম সুয়ারেজ লাইন রয়েছে। বৃষ্টির পানি এই দুই মাধ্যমে বিভিন্ন নিচু এলাকা, জলাশয়, খাল বা নদীতে গিয়ে পড়ে। বক্স কালভার্ট ও ড্রেন দেখাশোনার দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসার। পাশাপাশি ঢাকায় প্রায় ২ হাজার ৪০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। এর মধ্যে দুই সিটি করপোরেশনের ২ হাজার এবং ওয়াসার ৪০০ কিলোমিটার ড্রেন রয়েছে। এই ড্রেনের মাধ্যমেই বৃষ্টির পানি বক্স কালভার্ট বা স্টর্ম সুয়ারেজ লাইনে নিয়ে ফেলা হয়।
জানতে চাইলে নগর পরিকল্পনাবিদ বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বি আইপি) সাধারণ সম্পাদক ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, ঢাকাকে পানিবদ্ধতামুক্ত করতে হলে বৃহৎ কর্মপরিকল্পনা নিতে হবে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পরিকল্পনা দিয়ে পানিবদ্ধতার সাময়িক সমাধান হলেও টেকসই সমাধান হবে না। কোন এলাকার পানি কোন পথ দিয়ে কীভাবে আউট করতে হবে সে বিষয়ে আগে সব সংস্থার যৌথ পরিকল্পনা করতে হবে। এরপর কাজ শুরু করতে হবে। তা না হলে একেক এলাকা নিয়ে একেক বছর সমস্যায় থাকতে হবে।
সাবিক পরিস্থিতির বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা ওয়াসার এমডি ইঞ্জিনিয়ারি তাকসিম এ খান বলেন, আমরা রাজধানীর পানিবদ্ধতা নিরসনে কাজ করছি। এটা একটি চলমান প্রক্রিয়া। স্বাভাবিক বৃষ্টি হলে সমস্যা হবে না। কিন্তু ভারী বৃষ্টিপাত হলে পানি সরতে একটু সময় লাগবে। সিটি করপোরেশনের দোষারোপের বিষয়ে তিনি বলেন, সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করলে সুফল পাওয়া যাবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ