শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

লিবিয়ায় এখনো আড়াইশ বাংলাদেশী আটক থাকার তথ্য গোয়েন্দাদের কাছে

নাছির উদ্দিন শোয়েব : লিবিয়ার বেনগাজীতে মানবপাচারকারী চক্রের অন্তত ৫০টি নির্যাত ক্যাম্পের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। গত ২৮ মে লিবিয়ায় ২৬ বাংলাদেশীকে গুলী করে হত্যার পর দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মানবপাচারকারী চক্রের সদস্যদের খোঁজে সাঁড়াশি অভিযানে নামে। এ ঘটনায় দেশে একাধিক মামলা করা হয়। এই মামলায় পুলিশের পাশাপাশি র‌্যাব, সিআইডি ও গোয়েন্দা পুলিশ অভিযান চালিয় অন্তত দেড় ডজনেরও বেশি মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারকৃত পাচারকারীদের জিজ্ঞাসাবাদে গোয়েন্দারা জানতে পেরেছে, লিবিয়ার বেনগাজীসহ বিভিন্ন শহরে ১০টি ক্যাম্পে অন্তত আড়াইশ শ্রমিক আটক আছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে ওই সব আস্তানা থেকে আটক শ্রমিকদের উদ্বারের চেষ্টা চলছে।
ডিবির একটি সূত্র জানায়, মানবপাচার করতে লিবিয়ায় নোয়াখালীর কাজী ইসমাইলের নেতৃত্বে ৪৫ জনের একটি বাংলাদেশী দালাল চক্র সক্রিয় রয়েছে। তাদের মালিকানায় রয়েছে অন্তত ২২টি নির্যাতন ক্যাম্প। দেশের ভেতরে ১১টি অঞ্চলে ভাগ হয়ে দালাল চক্রটি চারটি আন্তর্জাতিক রুট ব্যবহার করে ইউরোপে মানবপাচার করে আসছে। লিবিয়ার মিসদাহ মরুভূমিতে ২৬ বাংলাদেশীকে হত্যার ঘটনায় ৬ জনকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ-ডিবি। পরে আরও কয়েকজনকে গ্রেফতারের পর নির্যাতন ক্যাম্পের সন্ধান পায় পুলিশ। তবে আরও কয়েকজন পাচারকারীকে গ্রেফতারের পর গোয়েন্দারা জানতে পারে লিবিয়ার বেনগাজীতে অন্তত ৫০টি নির্যাতন ক্যাম্প আছে। বাংলাদেশের পাচারকারীচক্র এই ক্যাম্পগুলো পরিচালনা করছে। বাংলাদেশের প্রায় অর্ধশত পাচারকারী এর সঙ্গে যুক্ত।
গোয়েন্দা পুলিশ এরআগে আরও ছয় মানবপাচারকারীকে গ্রেফতার করে। এরা হলো- বাদশা মিয়া, জাহাঙ্গীর মিয়া, আকবর আলী, সুজন, নাজমুল হাসান ও লিয়াকত শেখ ওরফে লিপু। এ সময় তাদের হেফাজত হতে চারটি পাসপোর্ট, দুইটি মোবাইল ফোন ও টাকার হিসাব সম্মলিত দুইটি নোটবুক উদ্ধার করা হয়। গ্রেফতার পাচারকারীদের কয়েকজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। সম্প্রতি সিআইডি এ চক্রের আরও চার সদস্যকে গ্রেফতার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করছে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার মাহবুব আলম জানান, গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক টিম মানবপাচারকারী চক্রকে ধরতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে অভিযান অব্যাহত রেখেছে। গ্রেফতারকৃত কয়েকজনের স্বীকারোক্তি ও ডিবির তদন্তে অনেক গোপন কাহিনী বেরিয়ে আসছে। এদিকে লিবিয়ার বেনগাজীসহ বিভিন্ন শহরে ১০টি ক্যাম্পে আড়াইশ শ্রমিক আটক আছে। তাদের নির্যাতন চালিয়ে মুক্তিপণ আদায়ের চেষ্টা চলছে। ইন্টারপোলের মাধ্যমে ওই সব আস্তানা থেকে আটক শ্রমিকদের উদ্বারের চেষ্টা চলছে। ডিবির টিমগুলো এখন পাচারকারী দেশীয় চক্রের পলাতকদেরকে ধরতে অভিযান অব্যাহত রেখেছেন। প্রায় অর্ধশত মানবপাচারকারী গোয়েন্দা জালে আছে।
পাচারের প্রক্রিয়া সম্পর্কে ডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, লিবিয়ার বিভিন্ন এস্টেটে কাজ ও লিবিয়া থেকে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে নেওয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বাংলাদেশি দালালরা অন-অ্যারাইভাল ও ট্যুরিস্ট ভিসার মাধ্যমে লোকজনকে লিবিয়ায় পাচার করে। পাচারের পর ভিকটিমদের লিবিয়ার বিভিন্ন ক্যাম্পে আটক রেখে শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন করে। ভিকটিমদের কান্নাকাটি, আকুতি-মিনতি করা অডিও অথবা সরাসরি মোবাইলে কথাবর্তা বাংলাদেশে অবস্থানরত ভিকটিমদের স্বজনদের পাঠিয়ে অর্থ আদায় করে।
গোয়েন্দারা জানায়, লিবিয়াতে যে মিলিশিয়া গ্রুপ আছে তাদের সহযোগিতায় এ ক্যাম্পগুলো চালায় তারা। বাংলাদেশ থেকে অর্থের বিষয়ে একটা লেনদেন তৈরি করে থাকে। আমরা সেই বিষয়টি তদন্ত করবো। যারা এর সঙ্গে জড়িত, যারা ইতোমধ্যে লিবিয়াতে আছে এবং লিবিয়া থেকে যারা এই অর্থের লেনদেন করে তাদের ধরার জন্য আইনী প্রক্রিয়ায় আমাদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। এরআগে ২৬ বাংলাদেশিকে হত্যার ঘটনায় বাংলাদেশে ভিকটিমদের আত্মীয়-স্বজন মাদারীপুর রাজৈর থানা, কিশোরগঞ্জের ভৈরব থানায় মানবপাচার বিরোধী আইনে দুটি মামলা হয়। এরপর দেশের বিভিন্ন স্থানে আরও কয়েকটি মামলা করেন নিহতদের স্বজনেরা। র‌্যাব-৩ ছায়া তদন্ত করে নিশ্চিত হবার পর মানবপাচারের সাথে জড়িত চক্রটির অন্যতম হোতা কামাল হোসেন ওরফে হাজি কামালকে রাজধানীর গুলশান শাহজাদপুর থেকে গ্রেফতার করে। তিনি বর্তমানে কারাগারে আছেন। 
র‌্যাবের জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, কামাল হোসেন ওরফে হাজি কামাল মিথ্যা আশ্বাস প্রদান করে বিদেশে কর্মসংস্থানের প্রলোভন দেখিয়ে দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর যাবত এই অপরাধের সাথে সম্পৃক্ত আছে মর্মে স্বীকার করেন। এই সংঘবদ্ধ চক্রটি বিদেশি চক্রের যোগসাজসে অবৈধভাবে বাংলাদেশি নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে প্রেরণ করে আসছিল। চক্রটি তিনটি ধাপে মানবপাচারের কাজ সম্পন্ন করত। চক্রের দেশীয় এজেন্টরা প্রত্যন্ত অঞ্চলের স্বল্প আয়ের মানুষদের অল্প খরচে উন্নত দেশে পাঠানোর প্রলোভন দেখিয়ে আকৃষ্ট করে থাকে। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় অনেকেই তাদের প্রস্তাবে সাড়া দেয়। ইচ্ছুকদের বিদেশে গমনের ক্ষেত্রে পাসপোর্ট তৈরি, ভিসা সংগ্রহ, টিকেট ক্রয়- প্রভৃতি কার‌্যাবলী এই সিন্ডিকেটের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়ে থাকে। পরবর্তীতে তাদের এককালীন বা ধাপে ধাপে কিস্তি নির্ধারণ করে ইউরোপের পথে পাড়ি দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ