শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শক্তি এবং কৌশলই সবকিছু নয়

গত ৬ জুন স্মরণকালের সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়ে গেল যুক্তরাষ্ট্রে। বর্ণবাদী হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে এদিন শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ হয় বিভিন্ন শহরে। এতে যোগ দেয় হাজার হাজার মানুষ। কালো মানুষ জর্জ ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে শুরু হওয়া বিক্ষোভ গড়িয়েছে তৃতীয় সপ্তাহে। বিক্ষোভকারীরা বর্ণবাদের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছেন উচ্চকণ্ঠে। বলছেন, এখনই সময় পরিবর্তনের। যুক্তরাষ্ট্রের বাইরেও বিভিন্ন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ লক্ষ্য করা গেছে। উল্লেখ্য যে, মার্কিন রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে হয়েছে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ। কালো, সাদা ও মিশ্রবর্ণের হাজার হাজার মানুষ শামিল হয়েছেন সেই বিক্ষোভে। প্রেসিডেন্টের সরকারি বাসভবন হোয়াইট হাউসের আশপাশের সড়কগুলো ভরে যায় জনস্রোতে।
যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি এবং ট্রাম্পের ভবিষ্যত নিয়ে এখন শুধু আলোচনা নয়, হচ্ছে নানা বিশ্লেষণও। এএফপির বিশ্লেষণে বলা হয়, মহামারি করোনাভাইরাস, অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অসন্তোষে এখন বিপর্যস্ত যুক্তরাষ্ট্রে। এই তিন সঙ্কট আগামী নবেম্বরে অনুষ্ঠেয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচনকে এক নতুন বাস্তবতায় দাঁড় করিয়েছে। দেশটির বর্ণবাদী বৈষম্যের বিষয়টি উঠে এসেছে নতুন মাত্রায়। এসব সঙ্কটের কারণে যুক্তরাষ্ট্র বড় ধরনের রূপান্তরের মাধ্যমে টিকে থাকবে, নাকি পদ্ধতিগত অসমতা লালন করেই চলবেÑ সেটাই এখন বড় প্রশ্ন। কিছুদিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন সাবেক ভাইস প্রেসিডেন্ট ও ডেমোক্রেট নেতা জো বাইডেন। তাঁরা একে অপরকে বিভিন্ন কৌশলে ঘায়েল করার নীতিতে এগোচ্ছেন। তবে গত কয়েক প্রজন্মের পর যুক্তরাষ্ট্র এবার একটার পর একটা সঙ্কটের মুখোমুখি। দার্শনিক কর্নেল ওয়েস্ট এটাকে ‘অতীতের ভুলের খেসারত হিসেবে উল্লেখ করেছেন। এএফপির বিশ্লেষণে আরো বলা হয়, ফ্লয়েড হত্যার প্রতিবাদে শুরু হওয়া অসন্তোষ থামাতে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে পারতেন। সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্যের বিধান প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রুতি দিতে পারতেন। কিন্তু তিনি এসব না করে বরং বিতর্কিত মন্তব্য করে বিক্ষোভকে আরো উস্কে দিয়েছেন। ট্রাম্প হয়তো বিভক্তির মাধ্যমেই আবারও ক্ষমতায় আসার স্বপ্ন দেখছেন।
এএফপির বিশ্লেষণে এখন আমেরিকার সঙ্কট হলো মহামারি করোনা, অর্থনৈতিক মন্দা ও সামাজিক অসন্তোষ। বিভক্তির রাজনীতি দিয়ে কি এসব সঙ্কট দূর করা সম্ভব হবে? যুক্তরাষ্ট্র এখন যে বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে তা আসলে অতীত ভুলের পরিণতি। তাই এখন প্রয়োজন ভুল উপলব্ধি এবং দেশকে সঠিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করানো।
যে কোন জিনিস টিকে থাকার জন্য ভিত্তি প্রয়োজন। ভিত্তি যথার্থ ও যৌক্তিক হবে এটাই স্বাভাবিক। লক্ষণীয় বিষয় হলো, অনেক দেশেই ক্ষমতাসীন দাম্ভিক নেতারা  ওই বিষয়টি মানতে চাইছেন না। তারা অর্থবিত্ত, শক্তি ও কৌশলকেই সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করছেন। দেশ চালাতে যে নাগরিকদের আশা-আকাক্সক্ষাকে গুরুত্ব দিতে হয়, ধর্ম বা বর্ণের কারণে তারতম্য করা যায় না, যে কোন পরিস্থিতিতে ন্যায় এবং নীতিকে সমুন্নত রাখতে হয়Ñ এই বিষয়গুলোকে তারা মানতে চাইছেন না। অথচ এই বিষয়গুলো হলো রাষ্ট্র পরিচালনার ভিত্তি। ভিত্তি নড়বড়ে হলে যেমন গৃহ টেকে না; তেমনি ভিত্তি বিনষ্ট হলে রাষ্ট্রেও দেখা দেয় বিপর্যয়। এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পান না নীতিভ্রষ্ট দাম্ভিক নেতারাও। তেমন একটা চিত্র লক্ষ্য করা যাচ্ছে এখন যুক্তরাষ্ট্রে।
যুক্তরাষ্ট্র এখন যে শুধু করোনা ভাইরাসে বিপর্যস্ত তা নয়; রাজনৈতিক অঙ্গনও উত্তাল। একটানা ১১ দিন ধরে অব্যাহত বিক্ষোভে কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। কঠোর হস্তে বিক্ষোভ দমনের বার্তা দিতে রাজধানীতে সামরিক বাহিনী নামিয়েছেন তিনি। গভর্নরদের নির্দেশ দিয়েছেন বিক্ষোভকারীদের সড়ক থেকে হটাতে। নিজের সমর্থন বাড়াতে আগুনে পুড়ে যাওয়া গির্জার সামনে বাইবেল হাতে ছবিও তুলেছেন তিনি। কিন্তু কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। সহিংসতা হ্রাস পেলেও বিক্ষোভ কমছে না। বরং সমালোচিত হচ্ছেন ট্রাম্প। নিজ দল এবং পুরনো সমর্থকদের মধ্যেও দেখা দিচ্ছে অসন্তোষ। ট্রাম্পের জন্য আরও বিপদ ডেকে এনেছে যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক শীর্ষ নেতা-কর্মকর্তাদের তীর্যক সমালোচনা। তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী জেনারেল জেমস ম্যাটস কোন রাখঢাক ছাড়াই ট্রাম্পকে অযোগ্য বলে অভিহিত করেছেন এবং দেশকে ঐক্যবদ্ধ করার বদলে বিভক্ত করার জন্য অভিযুক্ত করেছেন। উল্লেখ্য যে, মন্ত্রী সভা থেকে গত বছর পদত্যাগ করেন জেমস ম্যাটিস। এর আগে ট্রাম্প তাকে ‘মাই জেনারেল’ নামে পরিচয় করিয়ে দিতেই বেশি ভালোবাসতেন। এছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের জয়েন্ট চিপ অব স্টাফের সাবেক চেয়ারম্যান জেনারেল মাইকেল মালেনও ট্রাম্পের তীব্র সমালোচনা করেছেন। কৃষ্ণাঙ্গ জর্জ ফ্লয়েড হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রে বর্ণবাদ বিরোধী যে বিক্ষোভ অব্যাহত রয়েছে তা যেন মার্টিন লুথার কিং হত্যাকাণ্ডের ঘটনা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে। মাইকেল মালেন ‘আর নীরব থাকা সম্ভব নয়’ শিরোনামে এক নিবন্ধে চলমান বিক্ষোভকে এক বাঁক ফেরানো ঘটনা বলে অভিহিত করেছেন। গির্জার সামনে বাইবেল হাতে ছবি তোলার জন্য বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে যেভাবে রাবার বুলেট আর কাঁদানে গ্যাসের সেল নিক্ষেপ করা হয়েছে তার জন্য শুধু ট্রাম্প নয়, তার অধীন সেনা নেতৃত্বকেও দোষারোপ করেছেন তিনি। আর যে ইভানজেলিক্যালদের হাতে রাখতে ট্রাম্প গির্জার সামনে ছবি তোলার অভিনয় করেন, তারাও প্রেসিডেন্টের কর্মকাণ্ডে ক্ষুব্ধ। গত পৌনে চার বছরে ট্রাম্প প্রশাসনের কাছে সবচেয়ে বেশি সুবিধা পেয়েছে এই ইভানজেলিক্যালরা। অথচ সর্বশেষ জরিপ অনুসারে তাদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন কমে গেছে ১৫ শতাংশ। করোনা ভাইরাস মোকাবিলায় ট্রাম্পের ব্যর্থতা এই ধসের প্রধান কারণ। আর ক্যাথলিকদের মধ্যে ট্রাম্পের সমর্থন কমেছে ২৭ শতাংশ।
প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যেভাবে বল প্রয়োগ কিংবা ধর্মের ব্যবহার করছেন, তা কিন্তু তার পক্ষে যাচ্ছে না। জর্জ ফ্লয়েডের হত্যার প্রতিবাদে বিক্ষোভকারীদের আন্দোলনে বল প্রয়োগের ঘটনার সমালোচনা করে ইভানজেলিক্যাল নেতা প্যাট রবার্টসন বলেছেন, ‘আমরা সবাই একই গোত্রভুক্ত। আমাদের উচিত একে অপরকে ভালবাসা। আপনি যা করেছেন মিস্টার প্রেসিডেন্ট তা মোটেই ঠিক নয়।’ এমন বক্তব্যে ট্রাম্পের মধ্যে কোন বোধোদয় ঘটবে কিনা তা আমরা জানি না। তবে রাষ্ট্র পরিচালনায় যে যথার্থ ভিত্তির প্রয়োজন হয়, ন্যায় এবং নীতির প্রয়োজন হয়, তা তাকে উপলব্ধি করতে হবে। নইলে ক্ষতির মাত্রাই হয়তো বাড়তে থাকবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ