বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

সিলেটে চিকিৎসা না পেয়ে বাড়ছে মৃত্যু ॥ ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ

সিলেট ব্যুরো : করোনা উপসর্গ নিয়ে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর সংখ্যা ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে সিলেট জুড়ে। দু’দিন পর শনিবার আবারো বিনা চিকিৎসায় একজনের মৃত্যুতে মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৩ জনে। করোনাকালীন এই দু:সংবাদ হতবাক করেছে সিলেটবাসীকে। খবরগুলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও দ্রুত ভাইরাল হচ্ছে। এই অবস্থাকে সিলেটের সাথে বেমানান মনে করে অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন সাধারণ জনগণ। সেই সাথে হাসপাতাল ব্যবসায়ীদের ব্যবসায়ী মনোভাবকে ধিক জানিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা।
জানা যায়, চিকিৎসা না পেয়ে মৃত্যুর ঘটনায় সিলেটে শনিবার কফিন মিছিল করা হয়েছে। ‘প্রাইভেট হসপিটালে সবাই চিকিৎসা নিবে, না হয় হসপিটালের গেইটে তালা ঝুলবে!’-এই দাবিকে সামনে নিয়ে সিলেটে বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে চিকিৎসা না পেয়ে রোগী মৃত্যুর তিনটি ঘটনার প্রতিবাদে ও প্রতিটি হাসপাতালে রোগীদের সুচিকিৎসার নিশ্চিত দাবিতে সিলেট নগরীতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে গতকালের কফিন মিছিল অনুষ্ঠিত হয়।
জানা যায়, সিলেটে গত শুক্রবার একদিনে মৃত্যু ঘটে দুই রোগীর। এর মধ্যে একজন সিলেটের পরিচিত এবং স্বনামধন্য বন্দরবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর এল ইলেকট্রনিক্সের মালিক হাজী ইকবাল হোসেন খোকা এবং অপরজন কুচাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আখতার হোসনের স্ত্রী।
কুচাই ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. আখতার হোসেন জানান, ‘গত বৃহস্পতিবার (৪ জুন) দুপুরে আমার স্ত্রীর বুকে প্রচণ্ড ব্যথা ও শ্বাসকষ্ট শুরু হয়। স্ত্রীকে তখন চিকিৎসার জন্য দক্ষিণ সুরমার নর্থ-ইস্ট মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসি। হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার তখন দুটি টেস্ট রিপোর্ট হাতে ধরিয়ে দিয়ে বাসায় পাটিয়ে দেন। কর্তব্যরত চিকিৎসক এ সময় টেস্টগুলোর রিপোর্ট আসার পরে রোগীকে নিয়ে শুক্রবার পুনরায় হাসপাতালে নিয়ে আসার কথা জানিয়ে দেন।’
নর্থ-ইস্ট থেকে ফিরে আসার পরদিন শুক্রবার ভোরেই রোগীর শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটে। তখন আখতার হোসেন নর্থ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আবারো ছুটে আসেন এবং সেখানে স্ত্রীকে ভর্তি করাতে চান। কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ‘সিট নেই’ বলে রোগীকে এই অজুহাতে ভর্তি করেনি। অগত্যা আখতার হোসেন শুক্রবার দুপুর পর্যন্ত সিলেট নগরীর পার্ক ভিউ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, শামসুদ্দিন আহমদ হাসপাতাল ও ইবনে সিনা হাসপাতালে চেষ্টা করেও স্ত্রীকে ভর্তি করাতে ব্যর্থ হন।
পরে আখতার হোসেন বাধ্য হয়ে প্রতিবেশী এক নার্সের সহযোগিতায় প্রায় ২০ হাজার টাকা দিয়ে একটি অক্সিজেন বতল কিনে বাড়িতে নিয়ে গিয়ে স্ত্রীকে দিতে শুরু করেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রয়োজনীয় চিকিৎসাসেবা না পেয়ে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে স্বামী-সন্তান ও প্রিয়জনদের ছেড়ে পরপারে পাড়ি জামান আখতার হোসেনের স্ত্রী।
একই দিনে মারা যান নগরীর বন্দরবাজারের বিশিষ্ট ব্যবসায়ী আর এল ইলেকট্রনিক্সের মালিক হাজী ইকবাল হোসেন খোকা। মৃত ব্যবসায়ীর ছেলে তিহাম জানান,শুক্রবার ভোররাতে তার বাবার হঠাৎ বুকে ব্যথা অনুভব করেন। তারা জরুরী ভিত্তিতে একটি এম্বুলেন্স কল করে এনে প্রথমে নগরীর সোবহানীঘাটে একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে যান। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার চিকিৎসা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন এবং অন্য একটি ক্লিনিকে নিয়ে যাবার কথা বলেন। ডাক্তারের কথামত ওই ক্লিনিকেও নিয়ে যান। সেখানে নেয়ার পর ডিউটিতে থাকা নার্স বলেন এখানে সিট নেই আপনারা সামসুদ্দিনে যান।
সেখান থেকে শহিদ সামসুদ্দিন হাসপাতালে আসেন। হাসপাতালে দরজায় প্রায় ১০ মিনিট দাড়িয়ে থাকার পর ভেতর থেকে একজন এসে বলে সবাই ঘুমে। আপনারা ওসমানী হাসপাতালে যান।সেখান থেকে ওসামনী হাসপাতালে গেলাম সেখানে গিয়েও একই অবস্থা। জরুরী বিভাগ গেলাম সেখানের ডাক্তার বলেন, দুতলায় সিসিউতে যান, সিসিউতে যাওয়ার পর উনারা বারান্দায় শুয়ে রেখে বলে এক্সরে করে নিয়ে আসেন । এর কিছুক্ষণ পর ডাক্তার বলেন আমার বাবা নেই।
এভাবেই চারটি হাসপাতাল ঘুরার বর্ননা করে কান্নাজড়িত কন্ঠে তিহাম বলেন, আমার বাবাকে বাচাঁতে পারলামনা।একজন চিকিৎসক যদি কোনধরনের চেষ্টা করতেন মনকে শান্তনা দিতে পারতাম।বিনা চিকিৎসায় আমার বাবা মারা গেলেন। আর কারো বাবা যেন এভাবে বিনা চিকিৎসায় রাস্তা রাস্তায় ঘুরে মৃত্যু না ঘটে।
এদিকে, সিলেটের হাসপাতালগুলোতে বিনা চিকিৎসায় মৃত্যুর ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন। তিনি শুক্রবার (৫ জুন) এসব হাসপাতাল ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সিলেটের দায়িত্বে নিয়োজিত পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের সচিব লোকমান হোসেন মিয়াকে নির্দেশ দিয়েছেন।
এক চিঠিতে মন্ত্রী বলেন, ‘সিলেটের বেসরকারী হাসপাতালগুলো নানা অজুহাতে কোনো রোগী গ্রহণ করছেন না। ভর্তি বা চিকিৎসা প্রত্যাখ্যান করায় দ্বিতীয় রোগী অ্যাম্বুলেন্সে মারা গেছেন। বিষয়টি নিয়ে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সাথে একটি বৈঠক করুন। সাধারণ রোগীদের চিকিৎসা নিশ্চিত করার সরকারের যে স্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে সেটি জানিয়ে দেন। সাধারণ ও গুরুতর রোগীদের চিকিৎসা প্রদানে অস্বীকারকারী হাসপাতালগুলোর লাইসেন্স প্রয়োজনে স্থগিত করার ব্যবস্থা গ্রহন করুন।
সিলেটের সিভিল সার্জন প্রেমানন্দ মণ্ডল এ বিষয়ে বলেন, বিনা চিকিৎসায় যাদের মৃত্যু হয়েছে, তাদের পরিবার থেকে এখনো কোনো লিখিত অভিযোগ পাওয়া যায়নি। তবুও গণমাধ্যমে খবরগুলো জানার পর পরই আমরা হাসপাতাল গুলোতে একটি নির্দেশনা পাঠিয়ে দিয়েছি। নির্দেশনায় চিকিৎসা বঞ্চিত করা হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়টি উল্লেখপূর্বক মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর বিষয়ে আরো তৎপর থাকার নির্দেশনা প্রদান করা হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ