শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রাজধানীর পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থায় হাজার কোটি টাকা ব্যয় ॥ সুফল পাচ্ছে না নগরবাসী

মুহাম্মদ নূরে আলম : ঢাকা ওয়াসার বিরুদ্ধে পানি ও পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা নিয়ে রাজধানীবাসীর অভিযোগের অন্ত নেই। তবে গত ১০-১৫ বছরে ওয়াসা পানি সরবরাহ ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অনেকটাই সাফল্য অর্জনে সক্ষম হয়েছে। এদিকে ৩ হাজার ৩১৭ কোটি ব্যয়ে ৫টি প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা রয়েছে ২০২১ সাল নাগাদ কিন্তু আফতাব নগরের দাশেরকান্দি প্রকল্প বাদে বাকী ৪টি প্রকল্প ২০২১ সালে বাস্তবায়ন নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। ওয়াসার পানি কতটা বিশুদ্ধ, জীবাণুমুক্ত ও সুপেয় তা নিয়ে প্রশ্ন আছে অবশ্যই। কেননা, রাজধানীর সর্বত্র স্যুয়ারেজ লাইন তথা পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থার অবস্থা অত্যন্ত শোচনীয়। যে কারণে অধিকাংশ স্থানে পানি ও পয়:লাইন ভেঙ্গেচুরে একাকার হয়ে গেছে। প্রায়ই বিশেষ করে অতি বৃষ্টি ও বর্ষার সময় জলাবদ্ধতায় সয়লাব ও একাকার হয়ে যায় তরল পয়:বর্জ্য ও পানির লাইন যা জনস্বাস্থ্যের জন্য রীতিমতো হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। দুর্বিষহ হয়ে ওঠে নগরজীবন। এ সময়ে মাত্রাতিরিক্ত তরল বর্জ্য যায় বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও বালু নদীসহ অন্যান্য খাল বিলে। যে কারণে এ নদীকে বড়সড় নর্দমা বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন দুর্গন্ধ তেমনি ময়লা আর্জনায় পরিপূর্ণ। এক্ষেত্রে ওয়াসার পাশাপাশি দুই সিটি কর্পোরেশনের দায়িত্বে অবহেলার বিষয়টিও অস্বীকার করা যাবে না। প্রতি বছরই বর্ষায় চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় রাজধানীবাসীকে। বর্ষা মানেই রাজধানীজুড়ে জলাবদ্ধতার এক তিক্ত অভিজ্ঞতা। এ মৌসুমে সামান্য বৃষ্টি হলেই নগরীর অলিগলি এবং ছোট পরিসরের রাস্তাগুলোতে জলাবদ্ধতা দেখা দেয়। একটু ভারী বর্ষণে রাজধানীবাসীর স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় ছন্দপতন হয়।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে ঢাকা মহানগরীর মাত্র ২০ শতাংশ এলাকায় পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা রয়েছে। বাকি ৮০ শতাংশ এ ব্যবস্থাপনা না থাকায় এসব এলাকার লেক, খাল ও নদীর পানি দূষিত হয়ে পরিবেশ বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। এতে করে এলাকাবাসীকে বসবাস করতে হচ্ছে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে। এর মধ্যে পরিকল্পিত ও স্বাস্থ্যসম্মত পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে ঢাকা ওয়াটার সাপ্লাই এন্ড স্যানিটেশন প্রকল্পের আওতায় সম্প্রতি সুয়েজ মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে। মূলত: রাজধানীর পানি নিষ্কাশন পথগুলো আবর্জনায় ভরাট হয়ে থাকা, ড্রেনেজ লাইন নিয়মিত পরিষ্কারের না করা, পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা ভালো না হওয়ায় সামান্য বৃষ্টিতেই তলিয়ে যায় রাজধানীর বিভিন্ন রাস্তা। ভারী বৃষ্টি হলে তাৎক্ষণিকভাবে পানি ধারণের জন্য শহরে উপযুক্ত জলাধার নেই। আর ভারী বৃষ্টির পানি টেনে নেয়ার পাম্পগুলোর ক্ষমতাও সীমিত। যে কারণে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা যথাযথ ও আধুনিকায়ন জরুরি।
স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের তত্ত্ববধানে দাশেরকান্দি পয়োশোধনগার প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ঢাকা ওয়াসা। তিন হাজার ৩১৭ কোটি ব্যয়ে প্রকল্পটির উদ্দেশ্যে ঢাকা ওয়াসার আওতাধীন প্রণীত স্যুয়ারেজ মাস্টারপ্ল্যান অনুযায়ী ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে পাগলা, দাশেরকান্দি, রায়েরবাজার, উত্তরা এবং মিরপুর এলাকায় মোট পাঁচটি পয়োশোধনাগার নির্মাণ করা হবে। এরমধ্যে দাশেরকান্দি পয়:শোধনাগার প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে পয়:শোধনাগার চালু হওয়ার কথা রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় পয়:শোধনাগারের মাধ্যমে গুলশান, বনানী, বারিধারা, বারিধারা ডিওএইচএস, বসুন্ধরা, বাড্ডা, ভাটারা, বনশ্রী, কুড়িল, সংসদ ভবন এলাকা, শুক্রাবাদ, ফার্মগেট, তেজগাঁও, আফতাব নগর, নিকেতন, সাঁতারকুল, হাতিরঝিল এবং আশেপাশের এলাকার সৃষ্ট পয়:বর্জ্য পরিশোধন করে বালু নদীতে নিষ্কাশিত হওয়ার মাধ্যমে পানি ও পরিবেশ দূষণ রোধ করা সম্ভব হবে। এছাড়া হাতিরঝিল প্রকল্পের গুণগতমান উন্নয়নসহ সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার ফেজ-১ ও ফেজ-২ এর ইনটেক পয়েন্ট শীতলক্ষ্যা নদীর পানি দূষণ কমানো সম্ভব হবে।
প্রকল্পটির পরিচালক প্রকৌশলী মহসিন আলী মিয়া গণমাধ্যমকে জানান, জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে সর্বমোট ৬২ দশমিক ৬১ একর ভূমি অধিগ্রহণের কার্যক্রম সম্পন্ন করে ঢাকা ওয়াসা বরাবর দখল হস্তান্তর করা হয়। আশা করা যায় স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক প্রকল্পের নির্মাণ কাজ শেষ করে চালু করা সম্ভব হবে। ঢাকা ওয়াসা বলে আসছে, ড্রেন দেখভালের দায়িত্ব সিটি করপোরেশনের। আর সিটি করপোরেশন বলছে, ওয়াসার ম্যান্ডেটের মধ্যেই ড্রেনের মালিকানা দেয়া আছে।
বাংলাদেশ ইনস্টিউট অব প্ল্যানার্সের (বি আইপি) সাধারণ সম্পাদক এবং নগর উন্নয়ন পরিকল্পনাবিদ আদিল মুহাম্মদ খান এক গবেষণা প্রতিবেদনে তুলে ধরে গণমাধ্যমকে বলেন, ঢাকাবাসীর মলমূত্র ত্যাগে প্রতিদিন যে পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হচ্ছে তার বেশিরভাগই যাচ্ছে আশপাশের নদীতে, যার প্রভাব পড়ছে ঢাকায় পানি সরবরাহে। ঢাকার চারপাশের বুড়িগঙ্গা, বালু, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীতে এসব বর্জ্য গিয়ে পানি দূষিত করছে। যে কারণে পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থা যথাযথ ও আধুনিকায়ন জরুরি। বি আইপির তথ্য অনুযায়ী, প্রতিদিন ঢাকায় ১৫ লাখ ঘনমিটার পয়োবর্জ্য উৎপন্ন হয়, যার ২০ শতাংশ রয়ে যায় উৎসে। আর মাত্র সাড়ে ৪০ হাজার ঘনমিটার যায় পাগলা পয়:শোধনাগারে। বাকি ১১ লাখ ৬০ হাজার ঘনমিটার বর্জ্য অপরিশোধিত অবস্থায় নিঃসরিত হয়ে নদীতে যাচ্ছে।
আদিল মুহাম্মদ খান আরও বলেন, নতুন করে যুক্ত হওয়া ৩৬টি ওয়ার্ড বাদ দিয়ে ঢাকার ৯৩টি ওয়ার্ডের মধ্যে ৫৮টি ওয়ার্ডে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ৪০০ জন মানুষ বসবাস করছে। অথচ আধুনিক নগর পরিকল্পনা অনুযায়ী, নগরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে সর্বোচ্চ ১৫০ জনের বসবাসের কথা বলা আছে। যে কারণে জনসংখ্যার চাপে ঢাকায় নগর উন্নয়নের সব পরিকল্পনা ভেস্তে যাচ্ছে। সে হিসেবে ঢাকা শহর অনেক আগেই তার ভারবহন ক্ষমতা হারিয়েছে।
ঢাকা ওয়সা সূত্রে জানা গেছে, পয়:বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যানের আওতায় দাশেরকান্দি, মিরপুর, উত্তরা, রায়ের বাজার, পূর্বাচল, পাগলা, নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জ, সাভার, টঙ্গী ও গাজীপুরে মোট ১১টি স্যুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট স্থাপনে প্রকল্পের কাজ হাতে নেয়া হয়েছে। এছাড়া ঢাকা ওয়াসা ঢাকা মহানগর ও নারায়ণগঞ্জ শহরের ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় এক কোটি ৭০ লক্ষ নাগরিকের জন্য সুপেয় পানি সরবরাহ করছে। দৈনিক দুইশ ২০ কোটি লিটার পানির চাহিদার বিপরীতে বর্তমানে ২৪২ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করছে। ঢাকা ওয়াসার সিস্টেমলস বর্তমানে শতকরা ২০ ভাগের নিচে নেমে এসেছে। ভূ-উপরিভাগের পানির উৎস হতে পানি সরবরাহের লক্ষ্যে ৪৫ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে পদ্মা-যশোলদিয়া পানি শোধনাগার প্রকল্প, ৭০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয়ে গন্ধর্বপুর পানি শোধনাগার ও ৫ কোটি ৫ লক্ষ মার্কিন ডলার ব্যয়ে তেঁতুলঝরা-ভাকুর্তা ওয়েফিল্ড প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে।
অন্যদিকে ঢাকা ওয়াসার আওতায় প্রণীত স্যুয়ারেজ মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ঢাকা শহরের অভ্যন্তরে ৫ এলাকায় পাঁচটি পয়োশোধনাগার নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে ঢাকা ওয়াসা। এরমধ্যে আফতাব নগর সংলগ্ন দাশেরকান্দি পয়:শোধনাগার নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্পের সামগ্রিক অগ্রগতি হয়েছে (ডিপিপি অনুসারে) বাস্তব ৪৭ দশমিক ২৩ শতাংশ এবং আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৩৩ দশমিক ১৭ শতাংশ। স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে পয়:শোধনাগার চালু করা যাবে বলে আশা করছে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে ঢাকার প্রায় ১৫ লাখ মানুষের পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে ১৭ কোটি ডলারের ঋণ সহায়তা অনুমোদন করেছে বিশ্ব ব্যাংক। বর্তমান বিনিময় হার অনুযায়ী বাংলাদেশি মুদ্রায় এই অর্থের পরিমাণ ১ হাজার ৪৪৫ কোটি টাকা। চার বছরের রেয়াতকালসহ ৩৪ বছরে ২ শতাংশ সুদসহ এই ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এতে বলা হয়, এই ঋণ দিয়ে ঢাকার ১৫ লাখ মানুষের পয়:নিষ্কাশন ব্যবস্থার উন্নয়নে চলমান একটি প্রকল্পে অর্থায়ন করা হবে। ঢাকা স্যানিটেশন ইম্প্রুভমেন্ট প্রজেক্ট শীর্ষক ওই প্রকল্পের মাধ্যমে ঢাকার দক্ষিণ অংশের সাধারণ মানুষের জন্য নিরাপদ পয়:নিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ