কি পেয়েছি স্বাধীনতার
-তাসলিমা কবির
কোথায় তুমি স্বাধীনতা
আজকে তোমায় খুঁজি
দিনের শেষে এই আশাতে
আবার দু’চোখ বুজি।
স্বাধীনতা! এই শব্দটার সাথে মিশে আছে গভীর হৃদয়াবেগ, উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনা! স্বাধীনতা যেন চৈত্রের প্রখরতায় পোড়া মাঠের উপর এক পশলা বৃষ্টির ছোঁয়া; সবুজাভার প্রশান্তি। স্বাধীনতা সবার একান্ত কাম্য। মানুষ ছাড়াও জল স্থলের সকল প্রাণী স্বাধীনতা চায়; চায় সত্যিকার অর্থে বাঁচতে! পরাধীনতায় বেঁচে থাকা মরে যাওয়ার চেয়েও ভয়াবহ হয়ে যায় কখনও কখনও!
সবুজে শ্যামলে ঘেরা আমাদের এই প্রিয় জন্মভূমি, মাতৃভূমি বাংলাদেশও স্বাধীন হয়েছে বার বার! ১৯৪৭ সালে আমরা ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীন হই, ১৯৭১ সালে আবার পশ্চিম পাকিস্তানীদের কাছ থেকে পরিপূর্ণ স্বাধীনতা লাভ করি। কিন্তু যে প্রত্যয় নিয়ে আমদের দেশের সাধারণ মানুষ জীবন দিয়েছিলো এই স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো ৪৯ বছর পরেও কি তা পূরণ হয়েছে!
আজ একটা মহল “মুক্তিযুদ্ধ”কে তাদের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত করেছে! মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে তারা দেশকে “ধর্মনিরপেক্ষ” বানাতে চায়! এ মুক্তিযুদ্ধ এখন তাদের নিজস্ব দলীয় স্লোগানে পরিণত হয়েছে! মুক্তিযুদ্ধকে সাইনবোর্ড করে ধর্মনিরপেক্ষতার যে গলাবাজি তার আড়ালে রয়েছে মূলত ইসলাম নির্মূলের গভীর ষড়যন্ত্র ও পাঁয়তারা; যার ইন্ধন যোগাচ্ছে কিছু তথাকথিত প্রতিবেশি বন্ধু (!)! তারা বলছে মুক্তিযুদ্ধ ইসলামের সাথে সাংঘর্ষিক! আজও এ দেশে যে কোনো যে কোনো খারাপ চরিত্রকে দাঁড়ি, টুপি, পাঞ্জাবী পরে উপস্থাপন করা হয়! অথচ মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনাই ছিলো ইসলাম। ধর্মনিরপেক্ষতা নয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের আসল চেতনাই হলো ধর্মকেন্দ্রিক। মুক্তিযুদ্ধের সময় যোদ্ধাদেরকে ইসলামের কথা বলেই উজ্জীবিত করা হতো। মুক্তিযোদ্ধা জনাব এ্যাডভোকেট নূরুল কাদির তাঁর দুশো ছেষট্টি দিনে স্বাধীনতা বইয়ের ৭১ পৃষ্ঠায় খুব সুন্দর করে এই বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। তিনি বলেছেন, “অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান অত্যন্ত দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তাঁর অগাধ পান্ডিত্যের সাথে মুনশিয়ানার সাথে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ইসলামের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেছিলেন। ইসলামকে সকলের কাছে যথার্থরূপে তুলে ধরেছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান সাহেবের সেই ধারাবাহিক ‘ইসলামের দৃষ্টিতে’ কথিকা আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় অত্যন্ত সময়োপযোগী ও উপকারী হয়েছিল।”
একথা আজ দিবালোকের মত স্পষ্ট যে, প্রতিবেশি রাষ্ট্র মুক্তিযুদ্ধে সহযোগীতার বাহানায় আমাদের দেশের যে কোনো অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে চলেছে! এভাবে বন্ধু সেজে সর্বস্ব লুটে নেয়া তাদের পুরোণো বৈশিষ্ট্য। মুক্তিযুদ্ধে তারা যে সহযোগীতা করেছিলো তাও ছিলো তাদের পরিকল্পনার অংশ। তৎকালীন ভারতীয় সেনা প্রধানের একটি কঠিন মন্তব্য উল্লেখ করছি। ১৯৮৮ সালের ২৯ এপ্রিল ‘স্টেটসম্যান’ ভারতের সাবেক সেনাবাহিনী প্রধান ফিল্ড মার্শাল মানেক শ’ এর মন্তব্যটি প্রকাশ করে। সেখানে তিনি বলেছেন-
“যদি বাংলাদেশকে একটি ইসলামী প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষণা করা হয় তাহলে ভারতের আশ্চর্য হবার কিছু নেই। যেদিন আমার সৈন্যরা বাংলাদেশকে মুক্ত করে সেদিনই আমি এ কথা উপলব্ধি করি। বাংলাদেশীদের কখনই ভারতের প্রতি তেমন ভালবাসা ছিল না। আমি জানতাম ভারতের প্রতি তাদের ভালবাসা অস্থায়ী। অনুপ্রেরণা লাভের জন্য ভারতের দিকে না তাকিয়ে তারা মক্কা ও পাকিস্তানের দিকে দৃষ্টিপাত করবে। আমাদেরকে সত্যাশ্রয়ী হতে হবে। বাংলাদেশীদের প্রতি আমরা সঠিক আচরণ করিনি। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর জন্য আমাদের সব রকমের সাহায্য করা উচিত ছিল, কিন্তু আমাদের রাজনীতিবিদরা তা করেননি। তারা বেনিয়ার মতো আচরণ করেছেন।”
আজকে গণতন্ত্রের জন্য আমরা মাথা খুঁড়ে মরছি! কোথায় সেই গণতন্ত্র! ইতিহাসের কালো অধ্যায়ে কবেই তো ডুবে মরেছে সে! এ দেশে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না!
মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার মেজর আব্দুল জলিল এই কথাগুলো বলার কারণে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজবন্দী হওয়ার গৌরব অর্জন করেছিলেন। সে জন্যই অত্যন্ত দুঃখ করেই লিখলেন একটি বই- ‘অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা’।
তিনি বলেছিলেন, “আজকে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশের সরকার গঠন করবে কে? এটা নির্ধারণ করে দেয় নাকি অন্য কোন দেশ! একটা স্বাধীন দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি নিয়ন্ত্রণ করবে অন্য কোন দেশ এটা কেমন কথা! এই জন্যই কি আমরা লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম? স্বাধীনতার ৪৩ বছর পরেও আমরা রাজনৈতিক ক্ষেত্রে না নিজস্ব কোন সংস্কৃতি চালু করতে পেরেছি আর না ধার করা গণতন্ত্রের পুরোপুরি অনুসরণ করতে পেরেছি, এই হলো আমাদের প্রাণের স্বাধীনতা! আর এই কথা বলতে গেলেই আমি হয়ে যাই স্বাধীনতা বিরোধী।”
মেজর জলিল আজ নেই কিন্তু তার অনেক উত্তরসূরীরা এই ঠিক কথাটা বলতে গিয়ে আজও রাজবন্দী হয়, আজও গুম হয়, আজও ফাঁসিতে ঝোলে!
আজও এ জনপদে প্রকাশ্যে মানুষকে সাপের মত পিটিয়ে মারা হয়; অনেকেই যা দাঁড়িয়ে উপভোগ করে! বিশ্ববিদ্যালয়ের নম্র, ভদ্র, নামাজী ছেলেটাকে জঙ্গি খেতাব দিয়ে নিজের স্বার্থ চরিতার্থ করা হয়! একটা মহল রাজনীতির নামে নগ্নতা, উচ্ছৃঙ্খলতা, বেহায়াপনার জোয়ার বইয়ে দিচ্ছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে! অপসংস্কৃতির সয়লাবে দেশ ও জাতির আজ টালমাটাল অবস্থা! খুন, রাহাজানি, হল দখল, ধর্ষণ এসব নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার এখন! কারণ বিবেক এখানে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে!
এই নীরব বিবেকের কানে কানে একটা কথাই বলে যেতে চাই, আর বেশি দেরি নেই, প্রতিবেশীর দেয়া জিঞ্জির গলায় পরার জন্য আপনার প্রজন্মকে প্রস্তুত করে যান!
কিংবদন্তী ছড়াকার আবু সালেহ- এর এই ছড়াটা না হয় কেঁদেই মরুক ... ...
“ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার এমন স্বাধীনতা!
যার পিছনে জানটা দিলাম যার পিছনে রক্ত
সেই রক্তের বদল দেখো বাঁচাই কেমন শক্ত,
ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার মরার স্বাধীনতা!
বাঁচতে চেয়ে খুন হয়েছি বুলেট শুধু খেলাম
উঠতে এবং বসতে ঠুঁকি দাদার পায়ে সেলাম,
ধরা যাবে না ছোঁয়া যাবে না বলা যাবে না কথা
রক্ত দিয়ে পেলাম শালার আজব স্বাধীনতা!”