শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ফ্রান্সে ৫ দিনের প্রার্থনা সভা হয়ে উঠল ‘ভাইরাস বোমা’

 

৩১ মার্চ, রয়টার্স : “আমরা প্রভুর মহিমা কীর্তন করতে যাচ্ছি! আপনারা কি এই রাতে সেই আনন্দ অনুভব করতে পারছেন?”

এই বলে ফ্রান্সের একটি চার্চের সান্ধ্য প্রার্থনা শুরু করলেন যাজক।

সমস্বরে আওয়াজ এল- ‘হ্যাঁ’।

গত ১৮ ফেব্রুয়ারি ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর চার্চে সেই প্রার্থনায় সমবেত হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ।

জার্মানি ও সুইজারল্যান্ডের সীমান্তবর্তী মিলুজ শহরে সপ্তাহব্যাপী ওই প্রার্থনায় যোগ দিতে অনেকে গিয়েছিলেন হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে।

বিশ্বজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই চার্চের অনুসারীদের কাছে বার্ষিক এই উৎসব সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় আসর।

কিন্তু এবারের সমাবেশে কোনো একজন বহন করছিলেন প্রাণঘাতী নভেল করোনাভাইরাস।

স্থানীয় কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, ওই চার্চের জমায়েত থেকেই ফ্রান্সে কোভিড-১৯ সংক্রমণের সবচেয়ে বড় বিস্তৃতিটা ঘটেছে। আড়াই হাজারের মত মানুষের করোনাভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পেছনে ভূমিকা রয়েছে ওই সমাবেশের।

চার্চে প্রার্থনায় যোগ দেওয়া ব্যক্তিরা নিদের অজ্ঞাতেই ভাইরাসটি বয়ে নিয়ে গেছেন পশ্চিম আফ্রিকার বুরকিনা ফাসো, ভূমধ্যসাগরের দ্বীপ কোরসিকা, লাতিন আমেরিকার গায়ানা, সুইজারল্যান্ড, একটি ফরাসি পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র এবং ইউরোপের সবচেয়ে বড় গাড়ি নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ওয়ার্কশপে।

এর কয়েক সপ্তাহ পরে জার্মানি আংশিকভাবে ফ্রান্সের সঙ্গে সীমান্ত বন্ধ করে দেয়, স্থগিত করে ২৫ বছর ধরে চলা অবাধ চলাচল চুক্তি।

জার্মানির ওই সিদ্ধান্ত গ্রহণে সম্পৃক্ত দুজন রয়টার্সকে বলেছেন, করোনাভাইরাস ছড়ানোর ক্ষেত্রে ওই চার্চকেন্দ্রিক গোষ্ঠীটি একটি ‘প্রধান ফ্যাক্টর’ হিসেবে কাজ করেছে।

চার্চের কর্মকর্তারা বলেছেন, সমাবেশে উপস্থিতদের মধ্যে ১৭ জন এরইমধ্যে কোভিড-১৯ এ মারা গেছেন।

বিশ্বে মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া অতি সংক্রামক এই ভাইরাসের বিস্তারের পেছনে অন্যান্য ধর্মীয় সমাবেশেরও ভূমিকা রয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় খ্রিস্টানদের একটি বিশেষ সম্প্রদায়ের চার্চ থেকেই পাঁচ হাজারের বেশি মানুষ সংক্রমিত হয়েছে।

ফ্রান্সের ক্রিশ্চিয়ান ওপেন ডোর চার্চে প্রার্থনাসভায় উপস্থিত ব্যক্তি এবং দেশটিতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় সম্পৃক্ত কর্মকর্তারা রয়টার্সকে যে কাহিনী শুনিয়েছেন তা এই ভাইরাস সংক্রমণের গতি ও ভয়াবহতার বড় প্রমাণ।

সেদিন ছিল মঙ্গলবার, বিকালের আবহাওয়াও ছিল চমৎকার। পুরনো একটি শপিং সেন্টারকে আড়াই হাজার আসনের অডিটোরিয়ামে পরিণত করে শুরু হয় ওপেন ডোর চার্চের প্রার্থনাসভা। করোনাভাইরাসকে তখন দূর দেশের ঘটনা বলেই মনে হচ্ছিল।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, সে সময় ফ্রান্সে মাত্র ১২ জনের করোনাভাইরাস ধরা পড়েছিল। মিলুজ এলাকায় কেউ তখনও সংক্রমিত হননি।

উত্তর ইউরোপের অন্যান্য দেশের মতো ফ্রান্সেও সে সময় বড় সমাবেশে কোনো বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়নি। ওই চার্চে সমবেতদের হাত পরিষ্কার করার জন্য হ্যান্ড স্যানিটাইজার ছিল না; করমর্দনেও কোনা নিষেধ ছিল না।

চার্চের প্রধান যাজকের ছেলে জনাথন পিটারস্মিট বলেন, “সে সময় আমরা কোভিডকে দেখতাম অনেক দূরের কিছু হিসেবে।”

তার দাদাই ছিলেন এই চার্চের প্রতিষ্ঠাতা। তার বাবা স্যামুয়েলকে কথা বলার জন্য পাওয়া যায়নি। কারণ তিনিও করোনাভাইরাস আক্রান্ত।

২৯ ফেব্রুয়ারি চার্চের সমাবেশকেন্দ্রিক প্রথম করোনাভাইরাস রোগী শনাক্ত হওয়ার পর স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা সাধারণ প্রটোকল অনুযায়ী কার কাছ সংস্পর্শে এসে তার ভাইরাস সংক্রমণ ঘটেছে তা শনাক্ত করার চেষ্টা করেন। তখন চার্চের দেওয়া একটি তালিকা ধরে স্বাস্থ্য কর্মকর্তারা প্রথমে সমাবেশের সময় শিশু সেবা কেন্দ্রে দায়িত্বরতদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। কিন্তু ততোক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

সেখানকার আরও কয়েকজন কর্মী তখন অসুস্থ হয়ে পড়েছিল বলে ফ্রান্সের জাতীয় পাবলিক হেলথ এজেন্সির মহামারী বিশেষজ্ঞ মাইকেল ভারনে জানান। 

“আমরা বিচলিত হয়ে পড়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম যে, আমাদের সামনেই একটি টাইম বোমা ছিল।”

চার্চে সমবেতদের মধ্যে ছিলেন স্থানীয় এলি উইডমার, ৩৭ বছরের এই যুবক একটি আবাসন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার। তার বাবা-মাও ১৯৬৬ সালে জ্যঁ পিটারস্মিটের প্রতিষ্ঠিত এই চার্চের সদস্য ছিলেন।

দোকানি পিটারস্মিটের স্ত্রী একবার অপ্রত্যাশিতভাবে অসুস্থতা থেকে আরোগ্য লাভ করায় তিনি ইভানজেলিজম চর্চা শুরু করেন, গড়ে তোলেন এই চার্চ।

উইডমার জানান, কৈশোরে চার্চ থেকে দূরে সরে গেলেও আবার ফিরে এসেছেন। বার্ষিক এই সমাবেশের জন্য এখন সারা বছর অপেক্ষা করেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ