মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

সূরাতুল ফাতিহা একটি শাশ্বত মানপত্র

-আয়মানা সওদা

অনুবাদ : পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে।
সমস্ত প্রশংসা সারা বিশ্বের পালনকর্তা আল্লাহর জন্য।
যিনি পরম দয়ালু ও মেহেরবান।
যিনি প্রতিদান দিবসের মালিক।
আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য চাই।
আমাদেরকে সরল সঠিক পথ দেখাও।
তাদের পথ যাদের তুমি অনুগ্রহ করেছ, যাদের উপর গজব পড়েনি এবং যারা পথভ্রষ্ট হয়নি। (হে আল্লাহ কবুল করো) সূরা আল ফাতিহা সম্পূর্ণ।
নামকরণ : পবিত্র কোরআনের ১১৪টি সূরার মধ্যে ১১২টি সূরার নামকরণ করা হয়েছে ঐ সূরার কোন একটি শব্দ দিয়ে। মাত্র দুটি সূরা এর ব্যতিক্রম। একটি হলো ‘ইখলাস’ যে শব্দটি সূরা মধ্যে নাই। আর অন্যটি আলোচ্য সূরা অর্থাৎ ‘ফাতিহা’ এই শব্দটিও সূরার কোথাও নাই।
ফাতিহা শব্দের অর্থ খোলা, (open) সূচনা, (Introduction) বা উদ্বোধন করা। এই সূরার মাধ্যমে বান্দাহ নামাজে তার রবের সাথে সম্পর্কের সূচনা করে। এই সূরার দ্বারা মহান আল্লাহর বিধি-বিধান, হুকুম আহকাম হালার হারামসহ যাবতীয় দিক-নির্দেশনার ভান্ডার আল কোরআন শুরু হয়েছে। আর এ কারণেই সূরাটির নামকরণ করা হয়েছে সূরাতুল ফাতিহা। একই কারণে সূরাটি প্রথমে কোরআনের প্রথমে স্থান দেয়া হয়েছে।
নাযিলের সময়কাল : নবুওয়াতের প্রথম দিকেই মক্কায় এই সূরাটি নাযিল হয়। পূর্ণাঙ্গ সূরা হিসেবে এই সূরাটি প্রথম নাযিল হয়েছে।
ঐতিহাসিক পটভূমি : যে সমাজে রাসূল সা: এর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, সেখানে যত খারাপ রীতি-নীতি, ও কাজকর্ম চালু ছিল, রাসূল সা: এর আচার আচরণ ও চালচলন তা থেকে আলাদা ছিল বলে তিনি এসব পছন্দ করতেন না। তিনি সবসময় ভাবতেন কিভাবে খারাপগুলো দূর করে  সমাজের ভালো করা যায়। তিনি অনুধাবন করলেন
সমাজের অসৎ নেতা, কর্তা, ধনী, প্রভাবশালীদের মন্দ চরিত্রের কারণেই সমাজে এতো খারাবী চালু আছে।
তাদের অন্যায়, অবিচার, শোষণ ও যুলুমের ফলেই সমাজে এতো অশান্তি ও দুঃখ দেখা যায়।
সাধারণ মানুষ যালিম নেতাদের তৈরী আইন ও নিয়ম কানুনে এমনভাবে বাঁধা যে, এসব মুসিবত থেকে মুক্তির কোন পথই তারা পাচ্ছেনা। এসব চিন্তা তাসূল সা:কে পেরেশান করতে লাগল। তিনি একা একা নীরবে এবং একাগ্রচিত্তে এসব ভাবতেন আর পরিত্রাণের জন্য আল্লাহকে ডাকতেন। এমন অবস্থা ও পরিবেশেই সর্বপ্রথম জিব্রাইল আ: হেরা গুহায় সূরা আলাকের প্রথম পাঁচটি আয়াত নিয়ে আসেন। এর কিছুদিন পর পর সূরা ‘মুদাস্সিরের’ প্রথমদিকের আয়াতগুলো এবং সূরা ‘মুজাম্মিলের’ প্রথমদিকের আয়াতগুলো নাযিল হয়। এভাবে কয়েকটি সূরার অংশ নাযিলের পর রাসূল সা: ওহীর সাথে যখন পরিচিত হলেন, তখন পরিপূর্ণ সূরা হিসেবে সূরাতল ফাতিহা নাযিল হয়।
বিষয়বস্তু : মূলত: এটি একটি দোয়া। আর স্বয়ং আল্লাহ মানুষকে এই দোয়া শিক্ষা দিয়ে যেন জানিয়ে দিতে চাচ্ছেন সত্য পথের সন্ধান লাভের জন্য এ কিতাবটি পড়ি। অর্থাৎ বান্দাহ মহান আল্লাহর কাছে এই সূরা মাধ্যমে সৎ পথের সন্ধান চেয়ে আরজি পেশ করেন আর জবাবে আল্লাহ বান্দার সামনে সমগ্র কোরআন তুলে ধরেন। মহগান আল্লাহ বান্দাহকে শিখিয়ে দেন যে বান্দার ইহকালীন ও পরকালীন সফলতার জন্য কী দরকার আর তা সে কার কাছে চাইবে এবং কীভাবে চাইবে।
ব্যাখ্যা : ১.‘পরম করুণাময় মেহেরবান আল্লাহর নামে’
কোন কাজ শুরু করার আগে আল্লাহর নাম স্মরণ করা ইসলামী সভ্যতা ও সংস্কৃতির রীতি। এর সুফল নিম্নরূপ:
মানুষ অনেক খারাপ কাজ করা থেকে নিষ্কৃতি পাবে।
বৈধ, সঠিক ও সৎকাজ শুরু করতে গিয়ে আল্লাহর নাম নিলে মানুষের মনোভাব  ও মানসিকতা সঠিক দিকে মোড় নিবে।
আল্লাহর সাহায্য, সহায়তা ও সমর্থন তার সহযোগী হবে। শয়তানের বিপর্যয় ও ধ্বংসকারিতা থেকে তাকে সংরক্ষিত রাখা হবে । কেননা বান্দা যখন আল্লাহর দিকে ফিরে আসে আল্লাহও তখন বান্দার দিকে ফিরেন।
২. ‘ সকল প্রশংসা একমাত্র আল্লাহর, যিনি নিখিল বিশ্ব জাহানের রব” যেহেতু সূরা ফাতিহা একটি দোয়া/ প্রার্থনা, তাই যে সত্তার কাছে আমরা প্রার্থনা করছি, প্রথমে তার গুণগান ও প্রশংসা করেই নিজের প্রয়োজন ও আরজি পেশ করার শিক্ষা এখানে দেয়া হয়েছে। সাধারণত: দুটি কারণে কারো প্রশংসা করা হয়ে থাকে
* কেউ যদি প্রকৃতিগতভাবেই কোন বিশেষ গুণ বা বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়, তার ঐ গুণ বা বিশেষ বৈশিষ্ট্যের প্রভাব প্রশংসাকারীর উপর পড়ুক বা না পড়ুক।
* কেউ যদি আমাদের উপর কোন অনুগ্রহ করে, আমরা তা অনুগ্রহের স্বীকৃতিস্বরূপতার প্রশংসা করে থাকি।
মহান আল্লাহ এই উভয় কারণে উভয় দিক দিয়েই প্রশংসা পাওয়ার দাবীদার। আমরা সবসময় শুধু তারই প্রশংসা করব এটা তার অপরিসীম মর্যাদা ও আমাদের প্রতি তার অশেষ অনুগ্রহের দাবী।” প্রশংসা একমাত্র আল্লাহরই” এই কথাটির স্বীকৃতি সমস্ত “ সৃষ্টি পূজার” মূলে আঘাত হানা হয়েছে। দুনিয়ার যেখানে যে বস্তুতে, যে প্রকৃতিতেই  যে সৌন্দর্য, বিশেষত্ব ও শ্রেষ্ঠত্ব বিরাজিত আছে আল্লাহর সত্তাই তার মূল উৎস।
আর রাব্বুল আলামীন বলতে, সারা জাহনের মালিক ও প্রভু , প্রতিপালনকারী, সংরক্ষণকারী, প্রয়োজন পূরণকারী, সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী, শাসনকর্তা যে একমাত্র আল্লাহ এ কথার স্বীকৃতি আদায় করা হচ্ছে। সেই সাথে একথাও স্মরণ করানো হচ্ছে যে, মহান আল্লাহ এসব ক্ষমতার একমাত্র অধিকারী বলেই সমস্ত প্রশংসা একমাত্র তারই পাওনা।
৩. “পরম দয়ালু ও মেহেরবান”
আরবী ভাষায় “রহমান” একটি বিপুল আধিক্যবোধক শব্দ। কিন্তু সৃষ্টির প্রতি আল্লাহর রহমত ও মেহেরবানী এতো বেমী ও ব্যাপক এবং সীমা সংখ্যকহীন যে, তার বর্ণনা করার জন্য আধিক্যবোধক শব্দ ব্যবহার করার পরও মন ভরেনা। তাই তার আধিক্য প্রকাশের হক আদায় করার জন্য ‘রাহীম’ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেমন সাদার আধিক্য পরিমাণের জন্য আমরা ধবধবে সাদা, আর লালের আধিক্য বুঝাতে লাল এর পর টকটকে লার ব্যবহার করে থাকি।
কোন কোন তাফসীরকারকগণ মনে করেন’ “রহমান” শব্দটি সমগ্র সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য চাই তারা আল্লাহর অনুগত হোক বা না হোক। আর শুধু আল্লাহর অনুগত  মুমিন বান্দাদের জন্য “রাহীম” শব্দটি প্রযোজ্য।
৪. “প্রতিদান দিবসের মালিক”
অর্থাৎ যেুদিন পূর্ববর্তীও পরবর্তী প্রত্যেক মানুষকে একত্র করে তার পূর্ণ কর্মফল প্রদান করা হবে, তিনি সেই দিনের একচ্ছত্র অধিপতি। আল্লাহর প্রশংসায় ‘রাহমান’ ও রাহীম শব্দ ব্যবহার করার পর ” প্রতিদান দিবসের মালিক” বলে এ কথা স্মরণ করিয়ে দেয়া হয়েছে যে, তিনি শুধু দয়ালু ও মেহেরবানই নন বরং সেই সাথে তিনি ন্যায় বিচারকও বটে। অর্থাৎ দুনিয়াতে যারা তিল পরিমাণ ভালো কাজ করেছে তার প্রতিদান ও তাদেরকে দেয়া হবে। আর যারা তিল পরিমাণ খারাপ কাজ করেছে তার জন্য তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে। আর বান্দার সারা জীবনের হিসাব্ তিনি সেই দিন পুঙ্খানুপুঙ্খ রূপে আদায় করবেন। সূতরাং প্রত্যেককে তার নিজের কাজের ব্যাপারে যেন সতর্ক করে দেয়া হয়েছে।
৫. “আমরা একমাত্র তোমারই ইবাদত করি এবং তোমার কাছেই সাহায্য চাই”
‘ইবাদত’ শব্দের অর্থ-পূজা উপাসনা করা, আনুগত্য করা, হুকুম মেনে চলা, বন্দেগী ও দাসত্ব করা। আমরা তোমারই ইবাদত করি বলে এ কথা বুঝানো হয়েছে যে, হে আমাদের রব! তুমি ছাড়া আমরা কারো উপাসনা করিনা, আর কারো অনুগতও নই, অন্য কারো হুকুম মানতে, বন্দেগী ও দাসত্ব করতে আমরা রাজী নই। অর্থাৎ এ সম্পর্কগুলো আমরা একমাত্র তোমার সাথেই রাখি। অন্য কেউ আমাদের মাবুদ নয়। আর তোমার  সাথে আমাদের সম্পর্ক কেবল ইবাদাতের নয়। বরং আমাদের সাহায্য প্রার্থনার সম্পর্কও কেবল তোমার সাথেই রয়েছে। তুমি একাই যাবতীয় নেয়ামত ও অনুগ্রহের মালিক। তাই আমাদের যাবতীয় অভাব ও প্রয়োজন পূরণের জন্য আমরা একমাত্র তোমারই দরবারে ধরণা দেই। আমাদের এই আবেদন নিয়ে আমরা তোমার দুয়ারে হাজির হই। এবং তোমার সাহয্যের উপর নির্ভর করি।
৬. “আমাদের সরল সঠিক পথ দেখাও”
জীবনের প্রত্যেকটি দিক ও বিভাগে, চিন্তা ও কর্মে, আচরণে আমাদের এমন বিধি-ব্যবস্থা শিখিয়ে দাও যেন আমরা জীবন চলার পথে যথার্থ সাফল্য ও সৌভাগ্যের অধিকারী হতে পারি। যে পথ একেবারেই নির্ভুল, যেখানে ভুল কাজ করার আশঙ্কা নেই। যার জন্য অশুভ পরিণাম ভোগ করতে হবেনা। যে পথে চললে আমরা চিরস্থায়ী সফলতা অর্জন করতে পারব, এমন পথ তুমি আমাদের দেখিয়ে দাও।
৭.“তাদের পথ, যাদের উপর তুমি অনুগ্রহ করেছ। যাদের উপর গজব পড়েনি, যারা পথভ্রষ্ট হয়নি”
মহান আল্লাহর কাছে আমরা যে পথটি চাচ্ছি এটি হলো তার পরিচয়। অর্থাৎ আমরা মহান আল্লাহর কাছে  আকুল হয়ে আবেদন করি যে, সে নির্ভুল পথটির সন্ধান আমাদের দাও, অতি প্রাচীনকাল থেকে লোক বা যে দল সেই পথে চলেছে, তারা তোমার অনুগ্রহ লাভ করেছে। আর সেই অনুগ্রহ সাময়িক নয় বরং স্থায়ী এবং যথার্থ। অর্থাৎ যারা সাময়িকভাবে আপাতদৃষ্টিতে সাফল্য লাভ করেছে ঠিকই  কিন্তু তোমার গযব ও শাস্তির অধিকারী হয়েছে তাদের পথ নয়। বরং যে পথে চললে তোমার সন্তুষ্টি অর্জন করা যায় সেই  যথার্থ, সুন্দর ও সঠিক পথটিতে আমাদের চলার তৌফিক দাও। হে আল্লাহ আমাদের এই প্রার্থনা তুমি গ্রহণ কর।
দুনিয়ার জীবনে কোন বিশেষ চাহিদার জন্য যখন আমরা  কোন স্থানীয় প্রশাসন বা কোন ক্ষমতাধরদের শরণাপন্ন হই তখন তার উদ্দেশে মানপত্র রচনা করে থাকি। এই বিশেষ মানপত্রের তিনটি অংশ থাকে। ১ম অংশে উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য দাতা ব্যক্তির প্রশংসা লিপিবদ্ধ করা হয় যদিও উক্ত ব্যক্তি প্রশংসা পাওয়ার যোগ্য না হয়। আর ২য় অংশে থাকে তার গুণাবলীর বর্ননা ও পরিচয়। আর সবশেষে ৩য় অংশে থাকে চাওয়া।
মহান আল্লাহ তায়ালা সূরা ফাতিহার মাধ্যমে তার বান্দাদের এমন একটি শ্বাশত, যথোপযুক্ত মানপত্র রচনা করা শিক্ষা দিয়েছেন যা পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে যথাস্থানে পেশ করতে পারলে আমাদের জীবনের কোন চাহিদাই অপূর্ণ থাকবেনা। আর এই মানপত্রের মাধ্যমে আমরা মহান এবং মেহেরবান দাতার কাছ থেকে যা পাব তা যদি বাস্তব জীবনে প্রয়োগ করতে পারি অর্থাৎ আমাদের চাওয়ার জবাবে আল্লাহ আমাদের সামনে গোটা জীবনের গাইড বুক আল কোরআন দান করেছেন। কোরআনের শিক্ষা যদি আমরা বাস্তবায়ন করতে পারি তাহলে তিনি আমাদের চিরস্থায়ী সফলতার পুরস্কার জান্নাত দান করবেন। আল্লাহ যেন আমাদের প্রত্যেককে এ মানপত্রের মান উপলব্ধি করার তৌফিক দান করেন। অমা তৌফি কি ইল্লা বিল্লাহ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ