বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

মুসলিম বিশ্ব আজীবন ইমাম গাজ্জালী (র:)-কে স্মরণ করবে

এইচ এম আব্দুর রহিম : ইমাম আল গাজ্জালী ১০৫৮ সালে (৪৫০ হিজরি) মধ্য এশিয়ার সবচেয়ে উর্বর ভূমি যেখানে অনেক মুসলিম মনিষী জন্মেছেন সেই খোরাসানের তুস শহরে অথবা তার পাশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এমন এক পরিবারে জন্ম নিয়েছিলেন যার পূর্বসূরি ইরানের এবং সূফী আকিদার প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা ছিল। ইমাম আল গাজ্জালীর পিতা নিজে একজন পণ্ডিত ব্যক্তিত্ব না হলেও উনি পণ্ডিত ব্যক্তিদের অনেক কদর করতেন এবং উনার মনে এই আশা লালিত ছিল যে উনার ছেলেরা বড় হয়ে পান্ডিত্ব অর্জন করবেন। ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক টি উইন্টার মনে করেন যে গাজ্জালী ছিলেন মানব জাতির এক অগ্রদূত এবং এই কথা বলা যায় যে উনার পিতার লালিত স্বপ্ন একটু বেশি পরিমাণে পূরণ হয়েছিল। গাজ্জালীর পিতা উনার খুব অল্প বয়সে ইহলোক ত্যাগ করেন এবং শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগের পূর্বে উনি উনার সঞ্চিত টাকা উনার এক ধার্মিক বন্ধুকে দিয়ে যান ইমাম গাজ্জালী এবং তার ভাইয়ের লালন পালনের খরচ বাবদ।
গচ্ছিত টাকা শেষ হবার পর তার বাবার বন্ধু তাদেরকে মাদ্রাসাতে দাখিল করেন এবং সেখানে তিনি কৃতিত্বের সাথে সব বিষয়ে অধ্যায়ন শেষ করেন। মাদ্রাসাতে অধ্যায়ন শেষ করে তিনি ১৫ বছর বয়সে জুরযান নামক স্থানে যান ফিক নিয়ে পড়াশুনা করার জন্য। সেখানে তিনি ইমাম আল ইসমাইল নামে একজন শিক্ষকের কাছ থেকে জ্ঞান অর্জন করেন এবং কিছু পরেই তুস নগরিতে ফিরে আসেন নিজে নিজে অধিক অধ্যায়ন করার জন্য। তিন বছর যাবত নিজের সমস্ত বিদ্যা অধ্যায়ন শেষে করে তার জ্ঞান পিপাসু হৃদয়ের পিপাসা আর ও বেশি বৃদ্ধি করেন এবং তার পিপাসা মিটানর জন্য নিশাপুরে যান। সেখানে তিনি ইমাম আল জুয়াইনি যে ছিলেন সেই সময়ের শাফি মাজাহাবের অনেক মর্তবাপূর্ণ আলেম তার কাছে ফিকাহ, যুক্তিবিদ্যা এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় বিষয়ে অগাধ জ্ঞান অর্জন করেন।
বিখ্যাত মনিষী সক্রেটিস তার রিপাবলিক গ্রন্থে পিতার চেয়ে শিক্ষকের গুরুত্বের যে অনেক বেশি সেই বিষয়ে আলোকপাত করেছিলেন। পিতার অবদান অনেক বেশি আমাদের এক দুনিয়াবি জীবনে আনার জন্য কিন্তু শিক্ষকের আমাদের শিক্ষায় যে কিভাবে এই দুনিয়াবী জীবনে আসল সাফল্য পাওয়া যায় এবং ইমাম গাজ্জালী এমন কিছু গুণীজনের সান্নিধ্য পেয়েছিলেন যারা উনাকে শিখিয়েছিলেন যে কিভাবে দুনিয়াবি জীবনের সাথে সাথে মৃত্যুর পরের জীবনে  ও সাফল্যমণ্ডিত হতে পারে এবং কিভাবে লক্ষ কোটি মানুষের হেদায়াতের নূর হিসাবে জ্বলজ্বল করা যায় হাজার বছর ধরে। জ্ঞান অর্জনের জন্য এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ভ্রমন করা তৎকালীন সময়ে শিক্ষাবিদদের জন্য একটি প্রথা কিংবা  আর কিছুই ছিল না। লক্ষ্য পূরণে সচল কারও আশেপাশে যদি সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকে তবে তার লক্ষ্যের দিকে ধাবিত হওয়া অনেকটা সহজ হয়। ইমাম আল গাজ্জালীর ক্ষেত্রে কিছুটা এমন হয়েছিল। তবে জ্ঞান তাপস হবার লক্ষ্য পূরণের দিকে অগ্রমান হতে গিয়ে তিনি অপরিচিত কেউ থেকে হচ্ছিলেন এমন এক নাম যা গুণীজনেরা বিনীতভাবে উচ্ছারণ করে। ইমাম আল গাজ্জালী আজ শুধু একটি নাম হয়, অনেক দর্শন শাস্ত্রের লুকায়িত জ্ঞানের উন্মুক্তকারী। ইমাম আল জুয়াইনির কাছে তিনি জ্ঞান অর্জনের পাশা পাশি তাকে অধ্যাপনা করতে সাহায্য করতেন। ১০৮৫ সালে আল জুয়াইনির যখন মৃত্যু হয় তখন ইমাম আল গাজ্জালীর বয়স ছিল ২৮ বছর। তখন তিনি নিজাম আল মুল্ক (সেলজুক-এর মন্ত্রী) এর সুনজরে আসেন এবং তিনি তাকে কোর্টে নিযুক্ত করেন। সেখানে তিনি ছয় বছর অতিবাহিত করেন এবং সেখানে তিনি বিভিন্ন রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি বিভিন্ন সমস্যার সমাধান নিয়ে আলোচনা করতেন। অতপর তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসাতে শিক্ষা দান শুরু করেন এবং সাথে সাথে নিজের লেখা লেখির প্রসার বাড়াতে থাকেন। এমন সময়ে তিনি একটি ইসলামিক মতভেদের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিলেন আর তা হল দর্শন শাস্ত্র এবং ইসলাম কে নিয়ে। উনি ইসলামের পক্ষে মত দান এবং মতবাদ দেন যে যে দর্শন ইসলামের সাথে সামঞ্জস্য শুধুই তাহাই গ্রহণযোগ্য কারণ সত্যিকারের সত্য হল ইসলাম যা সারা জাহানের প্রভু হতে আগত। তিনি গ্রীক দর্শনবিদদের লেখা সব বইয়ের উপর প্রচুর পরিমাণে অধ্যায়ন করেন এবং ইসলামি দর্শনবিদ ইবনে রুশদ এর বইয়ের উপর ও অনেক চর্চা করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হন। তিনি নিজে সিরিজ আকারে অনেক বই লেখেন এবং তার মধ্যে একটি হল ফাদাহ আল বাতিনিয়াহ ওইয়াহ ফাদিল আল মুস্তাজহিরিয়াহ। এই বইতে তিনি দুইটি প্রধান বিষয়ে আলোকপাত করেন আর তা হল ইমামদের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং ইসলামী শরিয়ার সঠিক বর্ণনা। উনি মূলত উনার যুক্তি দিয়ে ইমামদের বিশ্বাসযোগ্যতাকে পরোক্ষভাবে আঘাত করেন কিন্তু বরাবরের মত তিনি খুব বেশি সফল হতে পারেননি।
১০৯৫ সালে ৩৮ বছর বয়সে  আল গাজ্জালী আধ্যাতিক খরায় ভোগেন যার মূল কারণ ছিল যুক্তিতর্ক এবং আধ্যাতিকতার মধ্যে সামঞ্জস্য করতে না পারা। উনার এই খরা উনাকে শারীরিকভাবে অনেক অসুস্থ করে ফেলে এবং উনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন তাই শিক্ষাদান থেকে দূরে থাকেন। আল গাজ্জালী মনে করতেন যে প্রতিটি কাজের একটি আধ্যাতিক প্রভাব আছে। যেমন শাফি মাযাহাবে ওযুর পানি অন্য কোন কাজে ব্যবহার নিষিদ্ধ কারণ তারা মনে করেন যে ওযুর পানির সাথে আমাদের পাপ ধুয়ে পরে আর এইটাই হল আধ্যাতিক রূপ। বিখ্যাত ইসলামিক চিন্তাবিদ হামজা  ইউসুফের মতে, যে উনি এমন এক আরব পরিবারকে চিনেন যারা বেনামাজি দোকানির কাছ থেকে কোন খাবার কিনেন না এমনকি যে পশুর মাংস তারা খায় তাও তারা অতি যত্নসহকারে লালন করে কারণ তারা মনে করে যে প্রতিটি কাজের ই একটা আধ্যাত্মিক প্রভাব আছে। সেই বাসাতে আহার করার পর তার মনে হয়েছিল যে এত বরকত পূর্ণ খাবার তিনি কখনই আর কোথায় পান নি। ইমাম আল গাজ্জালী যে ১২ হাজার পাতা মুখস্ত না করে দর্শন শাস্ত্র নিয়ে কিছু বলতেন না সেই তিনি বাকরুদ্ধ অবস্থায় নিজেই নিজেকে খুঁজছিলেন। ইমাম আল গাজ্জালীর উপর সুফি দর্শনের প্রভাব অনেক বেশি পরিমাণে ছিল। কারণ উনার পিতা সুফি দর্শনের প্রতি অনেক প্রেমাসক্ত ছিলেন এবং উনার ভাই ছোটবেলা থেকেই সূফীতত্ত্বের একজন অনুগামী ছিলেন। জর্জ ওইয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামিক স্টাডিজের অধ্যাপক হুসাইন নাসের বলেন যে, ছোটবেলা থেকেই আল গাজ্জালী ছিলেন প্রথাগত জ্ঞানের প্রতি আসক্ত এবং উনার ভাই ছিলেন সূফীমতবাদের প্রতি অনুরাগী। উনার অধিকাংশ শিক্ষক ছিলে সুফি তরিকার অনুসারি এবং নিজাম আল মুক্ল ও ছিলেন সুফি ভক্ত। আল গাজ্জালী সুফি মতবাদের প্রতি বিস্তর অধ্যয়ন শুরু করেন এবং নিজে থেকেই বুজতে পারেন যে এই মতবাদ কোন গ্রন্থগত বিদ্যা নয় যা মুখস্ত বা অত্মস্থ করা যায় বরং ইহা এমন এক যাত্রা যেখানে মানুষ নিজেকে সত্যিকারের মানুষরূপে গড়ে তোলে। কিছু রীতিনীতি, সাধনার মাধ্যমে আত্মশুদ্ধি হল সুফি তরিকার যা কুরআন এবং হাদিস বহির্ভূত নয়। কুরআনে মানুষকে আশরাফুল মাখলুকাত বলে অভিহিত করা হয়েছে আর যদি তাই হবে তবে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি কিভাবে একে অন্যের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।
কিভাবে ধর্ষণের মত ক্ষতিকর কাজে লিপ্ত হয় যেখানে যদি আল্লাহর অনুমতি থাকত তবে মাটি ধর্ষণকারী কে গ্রাস করত। নিজেকে সত্যিকার মানুষ বানানোর এই যাত্রায় আল গাজ্জালী তার সবচেয়ে সমাদৃত উলমে আল দ্বীন গ্রন্থটি লিখেন। যার চারটি খণ্ড আছে এবং মুলত এই বইতে ইসলামী অনুশাসনের অনুশীলন এবং তার গুরুত্ব খুব দক্ষতার সাথে আলোচনা করেন। অনেকের ইসলামিক চিন্তাবিদগণের মতে কুরআনএবং হাদিসের পর  ইসলামের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল উলমে আল দ্বীন গ্রন্থটি। যেহেতু সুফি মতবাদ নিয়ে কথা হয়েছে তাই অনেকে নাক ছিটাতে পারেন। তাই একটু নিজের স্বপ্ন জ্ঞানের ধারনা নিয়ে আলোচনা করি। আমরা আজকাল আমাদের দেশে সে রকম পীর ফকির দেখে থাকি যারা মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ার অভিনব পন্থা করেন তারা কখনই আসল সুফি মতবাদ দ্বারা তাড়িত নন। মাজার পূজা এবং বিভিন্ন ধরনের  বেশরিয়াতী কাজ কারবার দ্বারা যারা নিজেকের আবাসস্থান পূর্ণ করে রেখেছেন এবং নিজেদের কে সুফি মতবাদের ধারক দাবী করেন তারা সুফিমতবাদ হতে অনেক অনেক দূরে আছেন। সুফি বা তাসাউফ (আত্তশুদ্ধি) কখনই মানুষকে  ইসলামের শরীর মানে শরীয়ত থেকে দূরে সরায় না বরং শরিয়াতের পূর্ণতা দান করে।
 ১০৯৭ সালে আল গাজ্জালী বাগদাদে প্রত্যবর্তন করেন এবং খুব স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে থাকেন। তিনি নিজামিয়া মাদ্রাসাতে আবার ও কিছুদিনের জন্য অধ্যাপনা করেন এবং পরে তিনি তুস শহরে চলে যান এবং স্বাভাবিক জীবন যাপন করেন। দশ বছর পর সেলজুগর মন্ত্রি ফখর আল মুল্কর অনুরোধে আবার ও নিজামিয়া মাদ্রাসাতে শিক্ষাদান করেন এবং ৫ বছর পর নিজের জন্মভূমিতে চলে যান। সেখানে জীবন যাপনের সময় তিনি তার অতি গুরুত্বপূর্ণ বই মিনহাজ আল আবেদিন লিখেন। আই বইটি ছিল মূলত কিভাবে জীবন যাপন করা উচিত এবং কিভাবে নিজ সত্তাকে আবাদ করা যায়। তিনি ১১১১ (হিজরি ৫০৫) সালে এই দুনিয়া থেকে বিদায় নেন।
জ্ঞান চর্চায় ইমাম গাজ্জালী (র:) টার্নিং পয়েন্ট
তীক্ষè মেধা ও অসাধারণ প্রতিভার পরিচয় শিক্ষকদের কাছে প্রকাশ পাওয়ায় শিক্ষকরা তাঁকে পুত্রবৎ স্নেহে রাখতেন এবং বিশেষ উৎসাহে তাকে শিক্ষাদানে প্রবৃত্ত হন। তৎকালে ছাত্রদেরকে পাঠ্যবিষয়ে শিক্ষকদের দেয়া ব্যখ্যা ও বক্তব্য হুবহু লিপিবদ্ধ করতে বাধ্য করা হতো এবং এ লিখিত নোটগুলিকে “তালিকাত” বলা হত। এরূপে ইমাম গাজ্জালী র:-এর কাছে তালিকাতের এক বিড়াট ভান্ডার তৈরি হয়েছিল। একবার যখন জুরজানে অধ্যয়ন শেষ করে ইমাম গাজ্জালী র: জন্মভূমি তাহেরান যাত্রা করেন। পথিমধ্যে এক ডাকাত দল তার সর্বস্ব লুণ্ঠন করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন তিনি তাদের পিছু হাটতে লাগলে ডাকাতরা তাকে বাঁধা দেয়। তিনি তাদের কাছে তার টাকা পয়সা ফেরত না চেয়ে শুধুমাত্র অন্তত তাহার সমস্ত অর্জিত বিদ্যার সঞ্চয় সম্ভার “তালিকাত” গুলি ফেরত দেয়ার জন্য অনুরোধ করেন। দস্যু সরদার তাকে উপহাসের স্বরে বলল, “তুমিতো বেশ বিদ্যা অর্জন করেছ! সবই কাগজে রয়েছে, মনে কিছু নেই”। এই কথা বলে সে তার সমস্ত তালিকাত ফিরিয়ে দিল। কিন্তু সরদারের ব্যঙ্গোক্তি ইমাম গাজ্জালী র: এর মনে দাগ কাটল। এর পর থেকে তিনি সমস্ত তালিকাত মুখস্থ করে নেয়ার সিদ্ধান্ত নেন এবং তখন থেকে যা শিখতেন তা আর তালিকাত নির্ভর না থেকে মুখস্থ করে নিতেন।
প্রাথমিক লেখাপড়া করেন তুস শহরে উস্তাদ ছিলেন ইমাম রাদাখানি এবং পরে চলে যান জুরান শহরে সেখানে উস্তাদ ছিলেন হযরত ইমাম আবু নসর ইসমাইল (র:)। তৎকালীন যুগের শ্রেষ্ঠতম ধর্মতত্ত্ববিদ আলেম ইমামুল হারামাইন আল জুয়াইনি, আল্লামা আবু হামিদ আসকারায়েনি, আল্লামা আবু মুহম্মদ যোবায়নি প্রমুখ মহাজ্ঞানী উস্তাদের নিকট তিনি শিক্ষা লাভ করেন। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের সকল দার্শনিকদের মতবাদও তিনি অত্যন্ত মনোযোগের সাথে অধ্যয়ন করেন নিজেকে সে সব  বিষয়ে নিজেকে বিশেষজ্ঞ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন।
ইমাম গাজ্জালী নিজামুল মুলক তুসী মালিক শাহ সালজুকী ও বাগদাদের খলিফার দরবারে যোগ্য আসন লাভ করে সমকালীন রাজনীতিতে এত বেশী প্রভাব বিস্তার করেন যে, সালজুকী শাসক ও আব্বাসীয় খলিফার মধ্যে সৃষ্ট মতবিরোধ দূর করতে সক্ষম হন। বাগদাদে তিনি যখন তৎকালীন দুনিয়ার বৃহত্তম বিশ্ববিদ্যালয় নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ পদে যখন নিযুক্ত হন তখন তাঁর মনে প্রশ্ন দেখা দিল তার এই ইলম ও জ্ঞানচর্চার খ্যাতি তথা তখনকার যশস্বী জীবন (celebraty life) যেন তাকে আল্লাহর নৈকট্য ছেড়ে দুনিয়ার মোহে না জড়িয়ে দেয়। জ্ঞানচর্চা যেন ভুল নিয়াতের কারণে ঈমান ধ্বংসের কারণ না হয়। তিনি লিখেন, “ইলম ও জ্ঞানচর্চার দ্বারা যদি তোমার উদ্দেশ্য হয়ে থাকে আত্মগৌরব ও বড়াই-অহংকার করা, সমকালীন লোকদের উপর প্রাধান্য বিস্তার করা, আপন প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠা করা, বিশ্ববাসীর নিকট প্রিয়পাত্র অথবা ভক্তিভাজন হওয়া, পার্থিব গৌরব অর্জন করা এবং রকমারী ধন-সম্পদ কুক্ষিগত করা, তাহলে জেনে রাখো-এই জ্ঞান অর্জনের দ্বারা তুমি তোমার দ্বীন ও ঈমান ধ্বংস করছ, স্বীয় মূল্যবান জীবন বিনষ্ট করছ। নশ্বর এই পৃথিবীর বিনিময়ে আখিরাতের অনন্ত জীবনকে বিক্রয় করে দিচ্ছ। নিঃসন্দেহে এটা অত্যন্ত গর্হিত ও ক্ষতিকর কাজ। এই ব্যবসায় তোমার বৃহৎ লোকসান ছাড়া লাভের কিছু অবশিষ্ট থাকছে না।”
অতপর নেজামিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকুরি ছেড়ে বাগদাদ হতে বের হয়ে দীর্ঘ প্রায় একযুগ (দশ বছর) তিনি বহু জনপথ ও মরুপ্রান্তর পরিভ্রমন করেন। মক্কা মদীনায় গমন করেন এবং পবিত্র হজ্জ পালন সমাপ্ত করেন।
ইমাম গাজ্জালী (রা:) মাত্র ৫৩ বছর বয়সে মারা যান। বর্তমান যুগের সম্ভাব্য আয়ুষ্কাল বিবেচনা করলে তিনি অতি স্বল্প বয়সেই ইন্তেকাল করেছেন বলা যায়। কিন্তু এই স্বল্প জীবনে তিনি যা অর্জন করেছেন বা ইসলামের যে পরিমান খেদমত করে যেতে পেরেছেন তা অভাবনীয়! এখানেই বুঝা যায় আল্লাহ মহান ব্যক্তিদের জীবনকে কিভাবে “বারাকা” পূর্ন করেন। আরবী শব্দ বারাকার অর্থ হচ্ছে পর্যাপ্ত পরিমাণ, অতিরিক্ত দান বা নিয়ামা দেয়া (bounty and more)। তাই আল্লাহ যাকে দিয়ে তার দ্বীনের খেদমত নিতে চান তাঁর জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে কাজে লাগাবার সুযোগ করে দেন তার জীবনকে বারাকা” পূর্ণ করেন। ইমাম গাজ্জালী (রা:) জীবনে সেটাই হয়েছে বলা যায়।
 ইতিহাস প্রমাণ দেয়, সলজুক বংশীয় তুর্কীগণ যখন ইসলাম গ্রহণ করেন এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করেন তখন থেকে ইসলামী স্বভাব চরিত্র ও মূল্যবোধে বিরাট পরিবর্তন সাধিত হয় এবং তাদের মাধ্যমে এক অনুপম সভ্যতা গড়ে। সলজুক সুলতানদের যুগে মুসলমানদের বিদ্যার্জন স্পৃহা অত্যন্ত বৃদ্ধি পায়। মুসলিমরা তখনকার ইহুদী, খৃস্টান ও পারসিকদের প্রচলিত জ্ঞানার্জন করার পর প্রাচীন গ্রীক দর্শন, মিশরীয় ও ভারতীয় জ্ঞান সংগ্রহ করেন। এ সবের মধ্যে ছিল জ্যোতিসশাস্ত্র, জড়বাদ, নাস্তিকতা ইত্যাদি বিভিন্ন প্রকারের মতবাদ। তবে এই বিভিন্ন মতবাদের প্রসার মুসলমান সমাজে বহু মতানৈক্যের এবং ইসলামী বিশ্বাস ও জ্ঞানের সাথে নানারকম মারাত্বক অনৈসলামিক ধর্ম-বিশ্বাস ও জ্ঞান মিশে যাওয়ার পর খাটি ইসলামী বিশ্বাস ও অনইসলামী বিশ্বাসের মধ্যে পার্থক্য করাই কঠিন হয়ে পড়ে। অত্যধিক পরিমাণে পার্থিব জড়বাদের প্রভাবে ধর্ম জ্ঞানের উপর বিরাট নেতিবাচক প্রভাব পড়তে থাকে। মুসলমান সমাজে ইসলামী বিশ্বাস ও ধর্মকার্যের ক্ষেত্রে এক চরম বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়। এদিকে প্রাচীন গ্রীক দর্শনের প্রভাবেও ইসলামকে সঠিকভাবে বুঝার ব্যপারে নানা বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়। ইমাম গাজ্জালী র: এই সমস্যা থেকে সমাজকে মুক্ত ও রক্ষা করার দায়িত্ব নেন। অতুলনীয় প্রতিভা ও নিপুণতার সাথে তিনি এই বিভ্রান্তিকর পরিবেশ থেকে মুসলিম সমাজকে রক্ষা করতে সক্ষম হন।
পরিশেষে বলা যায় বর্তমান মুসলিম বিশ্বে মুসলিম উম্মাহ ভিতর একদিকে তথাকথিত “ভাষাভিত্তিক আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদ” ও “ধর্মনিরপেক্ষতা” এবং অন্যদিকে ইসলামের নামে সন্ত্রাসী কার্যকলাপসহ যাবতীয় ইসলাম বিরোধী মতাদর্শ অনুপ্রবেশ করে মুসলিমদের চিন্তা চেতনাকে যেভাবে কলুষিত করে রেখেছে তা থেকে মুক্ত হতে ইমাম আল-গাজ্জালীর মত বুদ্ধিভিত্তিক এবং দার্শনিক চিন্তা ভাবনার একজন মুসলিম স্কলারের খুবই দরকার। ইসলামী চিন্তার জগতে আল গাজ্জালী হচ্ছেন সর্বশ্রেষ্ঠ ও মৌলিক চিন্তাবিদ। তিনি ছিলেন ইসলামী মতবাদের একজন বড় সংস্কারক ও দার্শনিক মতবাদের একজন সমালোচক। ধর্ম, দর্শন ও সুফীবাদে তার মৌলিক অবদানের জন্য তিনি একজন শ্রেষ্ঠ সৃষ্টিধর্মী চিন্তাবিদ বলে মুসলিম দর্শনে স্বীকৃত ও প্রশংসিত। তার চিন্তাধারা মুসলিম ধর্মতত্ত্বের উচ্চতম বিবর্তন বলে।
আল গাজ্জালী অধিবিদ্য, যুক্তিবিদ্যা, নীতিবিদ্য, ধর্মতত্ত্ব, সুফীবাদ প্রভৃতি বিষয়ে চারশোর অধিক মুল্যবান গ্রন্থ রচনা করেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো-তাহাফাতুল ফালাসিফা, এহইয়াউল উলুমুদ্দিন, মাকসিদ উল ফালাসিফা। তবে তার গ্রন্থগুলোর মধ্যে এহইয়াউল উলুমুদ্দিন সর্বশ্রেষ্ট। অনেক পন্ডিতের মতে যদি সকল মুসলিম চিন্তাধারা বিলুপ্ত হয় এবং উক্ত গ্রন্থ সংরক্ষিত থাকে তবে ইসলামের পক্ষে সে ক্ষতি সামান্য মাত্র।
আল গাজ্জালী জ্ঞান বিষয়ক আলোচনায় মূল্যবান অবদান রেখে গেছেন। তিনি সন্দেহাতীত ভাবে বিশ্বাস করেন যে, ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে পরম সত্যের জ্ঞান লাভ করা সম্ভব নয়। কারণ ইন্দ্রিয়ানুভূতি ও প্রজ্ঞার জ্ঞান প্রতারণামূলক হতে পারে। এগুলো ছাড়াও মানুষের একটা শক্তি আছে যাকে বলা হয় স্বজ্ঞা। তার মতে মানুষের হৃদয়ে এমন একটি শক্তি আছে যার মাধ্যমে সে সত্যের জ্ঞান লাভে সমর্থ হয়। তিনি দ্বার্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেন যে, এমাত্র স্বজ্ঞা মাধ্যমেই পরম সত্তার জ্ঞান লাভ সম্ভব। কাজেই স্বজ্ঞাই হলো জ্ঞান লাভের প্রকৃত উৎস ও পথ।
কার্যকারণ তত্ত্বে বর্ণনা ও ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে গাজ্জালী ছিলেন তার সময়ের তুলনায় অনেক বেশী অগ্রগামী। অভিজ্ঞতাবাদী ডেভিড হিউম-এর ন্যায় অনুরূপ মত পোষণ করেন প্রায় সাত শত বছর পূর্বে। এ ব্যাপারে গাজ্জালী বলেন যে, কার্যকারণের মধ্যে কোন অনিবার্য সম্পর্ক নেই। কার্যকারণ সম্পর্ক হলো ঘটনার পূর্বাপর সম্পর্ক মাত্র। গাজ্জালী এ বিষয়ে বলেন যে, কোন প্রাকৃতিক বস্তু বা ঘটনা অন্য কোন বস্তু বা ঘটনার কারণ হতে পারে না। তিনি যে কোন একটি কার্যের কারণ হিসাবে একটি আদি কারণকে বিশ্বাস করতেন। এই আদি কারণ হল খোদা স্বয়ং।
আত্মা সম্পর্কে আল গাজ্জালীর আলোচনা লক্ষণীয়। আত্মা সম্পর্কে অনেক দার্শনিক কেবল আত্মাকে অমর বলেছেন। কিন্তু গাজ্জালী আত্মা ও দেহ-উভয়কে অমর বলেছেন। জন্মের সময় খোদা আদি আত্মার সাথে দেহের পুনঃমিলন ঘটিয়ে মানুষকে সৃষ্টি করতে পারেন। তার মতে আত্মা হলো আধ্যাতিক দ্রব্য। আত্মার ব্যাস বা বিস্তৃতি নেই।
ধর্মতত্ত্বে আল গাজ্জালীর অবদান সুদূরপ্রসারী। তিনি চরমপন্থী মুতাজিলা ও দার্শনিকদের তথা গ্রীক দর্শনের অশুভ প্রভাব থেকে ইসলামকে রক্ষা করেন। তিনি ধর্ম ও দর্শনের মধ্যে পার্থক্য দেখান এবং ধর্মকে দর্শনের উপর প্রাধান্য দেন। তিনি আশারিয়া মতবাদের সংস্কার সাধন করেন এবং মুসলমানদের কোরআন ও হাদীছের দিকে ফিরিয়ে আনেন এবং কোরআন ও হাদীছের মাহাত্ম পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।
আল গাজ্জালীর প্রচেষ্টায় সুফীতত্ত্ব মজবুত ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হয়। আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে তা অর্জন করা সম্ভব। তিনি শরীয়তের সাথে মারেফতের সংযোগ সাধন করেন এবং যথার্থ জীবন ধারার রূপায়ন করেছেন। ডি বোয়ার-এর মতে আল গাজ্জালীর প্রভাবে সুফীবাদ ইসলামের জ্ঞানভান্ডারে মূল্যবান অবদান রাখতে সমর্থ হন।
ইমাম আল গাজ্জালী তদানিন্তন শাসক ও প্রশাসনিক কর্মকর্তার উদ্দেশ্যে সরাসরি নৈতিক ও রাজনৈতিক চিন্তাপ্রসূত পত্রাবলী বিনা দ্বিধায় প্রেরণ করতেন। কারণ তিনি অনুধাবন করেছিলেন যে, আধ্যাতিক পরিবর্তনের সাথে সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং জনকল্যাণমূলক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার বিশেষ প্রয়োজন। তিনি তার রাষ্ট্রদর্শনে রাষ্ট্রের প্রকৃতি, আইন, শাসনতন্ত্র ও ধর্ম, রাজস্ব আদায়, প্রাদেশিক শাসন ব্যবস্থা, জ্ঞানীদের পরামর্শ গ্রহণ, শাসক ও প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের কর্তব্য প্রভৃতি বিষয়ে জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছেন।
মুসলিম দর্শনের ইতিহাসে গাজ্জালী এত ব্যাপক বিষয়ে প্রাঞ্জল ও যুক্তিযুক্ত আলোচনা করেছেন, তা অন্যকোন মুসলিম দার্শনিকের বেলায় তা অনুপস্থিত। অধ্যাপক ম্যাকডোনান্ড এর মতে “আল গাজ্জালী ইসলামের শ্রেষ্ঠ ও সর্বাপেক্ষা সহনশীল চিন্তাবিদ। তার মতবাদসমূহ তার ব্যক্তিত্বেরই অভিব্যাক্তি।” আরেক চিন্তাবিদ ইকবাল গাজ্জালী সম্পর্কে বলেন, “অষ্টাদশ শতাব্দীর জার্মানীর ইমানুয়েল কান্টের (দার্শনিক) এর মত গাজ্জালীর মহান উদ্দেশ্য ছিল প্রেরিত পুরুষের মতই।” গাজ্জালীর খ্যাতি শুধু মুসলিম জগতেই সীমাবদ্ধ ছিল না, তা ছিল বিশ্বব্যাপী। তার মূল্যবান গ্রন্থ পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় অনুদিত হয়েছে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ