শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

বয়স্ক ইতালীয়দের কাছে একাকিত্বই বড় আতঙ্ক

২৫ মার্চ, ইন্টারনেট : কোভিড-১৯ নামের করোনা ভাইরাস বিশ্বজুড়ে এখন এক আতঙ্কের নাম। তবে কোনও কোনও বয়স্ক ইতালীয়র কাছে এখন তার চেয়েও বড় আতঙ্ক হলো একাকিত্ব। সেদেশে করোনা ভাইরাসের কারণে প্রাণ হারানোদের মধ্যে ৫৬ শতাংশেরও বেশি মানুষের বয়স ৮০ এর বেশি।

ইতালির উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ছোট্ট উপকূলীয় শহর লাভাগনা। প্রায় ১২ হাজার মানুষের বসবাস সেখানে। লাভাগনার ৮৭ বছর বয়সী সাবেক মৌমাছি পালক রেনাটা ক্যাফেরাটার বাড়িটি আড্ডার প্রাণকেন্দ্র। কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরাকে টেলিফোনে রেনাটা জানান, তিনি প্রতিদিন তার বাড়িতে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতেন। সেখানে একসঙ্গে চা ও মধু খেতেন তারা। করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে ইতালিতে এখন লকডাউন চলছে। রেনাটা ক্যাফেরাটার বাড়িটি এখন তাই একেবারেই ফাঁকা। এখন একাকিত্বের জীবন কাটাতে হচ্ছে এ বৃদ্ধাকে। ‘আমার জীবন পুরোপুরি পাল্টে গেছে। এ একাকিত্বের সঙ্গে মানিয়ে নেওয়াটা সত্যিই খুব কঠিন।’

চীনের উহান শহর থেকে করোনা ভাইরাসের সূত্রপাত হলেও এ প্রকোপে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি হয়েছে ইতালিতে। সেদেশে করোনায় প্রাণহানির সংখ্যা ৬ হাজারের বেশি। আক্রান্ত হয়েছে ৬৩ হাজারেরও বেশি মানুষ। সাধারণত, বয়স্ক মানুষ ও নাজুক স্বাস্থ্যের মানুষদেরকে বেশি ভুগতে হচ্ছে। ইতালির জাতীয় স্বাস্থ্য ইউনিটের (এনআইএইচ) তথ্য অনুযায়ী, সেদেশে করোনায় মৃতদের ৫৬ শতাংশের বেশি মানুষের বয়স ৮০ এর বেশি।

‘আমি জানি, আগে কিংবা পরে আমাদের সবাইকেই মরতে হবে। তবে এভাবে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরতে চাই না। আমি আরও কিছুদিন বাঁচতে চাই।’ বলেন ক্যাফেরাটা। ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্কের পাশাপাশি ধারাবাহিক একাকিত্বের ভীতি ভর করেছে তাকে। ‘আমি খুব একা বোধ করছি।’

জাতীয় পরিসংখ্যান ইন্সটিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ইতালিতে ৬৫ এর বেশি বয়সী মানুষদের ২৮ শতাংশ নিঃসঙ্গ। এরমধ্যে ১৩ লাখ মানুষ সোশ্যাল নেটওয়ার্কের সঙ্গে যুক্ত নয়। মিলানের ক্যাটোলিকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমার্জেন্সি সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক ফাবিও স্বাটেলা বলেন, ‘বয়স্ক মানুষরা খুব জটিল পরিস্থিতির মধ্যে আছেন।

করোনার কারণে জীবনধারা ও রুটিনে পরিবর্তন আসায় অবসরে যাওয়া বয়স্ক মানুষদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন স্বাটেলা। তিনি বলেন, ‘করোনার কারণে স্বাভাবিক কাজকর্ম করা যাচ্ছে না, ডাক্তারের কাছে না যেতে পারা কিংবা পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে দেখা না হওয়ার কারণে বয়স্কদের মানসিক চাপ ও অস্থিরতা দেখা দিতে পারে। এতে তাদের স্বাভাবিক পুষ্টি ব্যাহত হতে পারে। নিয়মিত ওষুধ খাওয়ার কথা তারা ভুলে যেতে পারেন। এর মধ্য দিয়ে হৃদরোগ বেড়ে যেতে পারে ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল হয়ে পড়তে পারে।’

স্বাটেলার আশঙ্কা, করোনা ভাইরাস পরিস্থিতিতে রুটিন পরিবর্তন হওয়ার কারণেও অনেক মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কারণ এসময় হাসপাতালগুলো করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়ার কাজে ব্যস্ত থাকবে, আর সেকারণে স্বাস্থ্যজনিত অন্য জটিলতাগুলো গুরুত্ব পাবে না।

ফাঁকা শহর, বন্ধ দোকান, মানুষের চলাফেরায় সীমাবদ্ধতা আরোপ করে জারি করা নতুন নিয়মের মধ্য দিয়ে যে থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করছে তাতে বয়স্ক মানুষদের কারও কারও মনে যুদ্ধকালীন স্মৃতি ফিরে আসছে।  এমনই একজন হলেন লোরেনজো ফেনোগলিও। ১৯২৩ সালে জন্মগ্রহণকারী এ ব্যক্তি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন নাৎসিদের বিরুদ্ধে ইতালীয় সেনাদের নেতৃত্বে ছিলেন। তিনি মনে করেন, তখনকার যুদ্ধের সঙ্গে এখনকার করোনাবিরোধী যুদ্ধের একটি পার্থক্য রয়েছে। লোরেনজো বলেন, ‘সেসময় (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) আমরা জানতাম শত্রু কারা এবং তাদেরকে মোকাবিলার জন্য কী প্রয়োজন। তবে এখন আমাদেরকে লড়াই করতে হচ্ছে এক অদৃশ্য শক্তির সঙ্গে।’

বয়স্ক লোকদের সেবাপ্রদানকারী সংগঠন এইউএসইআর-এর একটি স্বেচ্ছাসেবী দলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন এমানুয়েলা চাভেদাগনা। তিনি জানান, করোনা ভাইরাস নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং কবে এ সংকট থেকে মুক্তি মিলবে তা নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে বয়স্ক মানুষরা আতঙ্ক আর উদ্বেগের মধ্যে আছেন। ‘আমাদের কাছে অনেক বয়স্ক লোক ফোন করছেন, তারা শুনে আশ্বস্ত হতে চাইছেন যে তারা একা নন।’ বলেন এমানুয়েলা।

করোনার বিস্তার ঠেকাতে সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ। এরমধ্যেও বয়স্ক লোকদের সঙ্গে সমাজের বাকি অংশের সেতু তৈরি করতে কাজ করছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। শিক্ষার্থীরা স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ওষুধ বাড়িতে বাড়িতে পৌঁছে দিচ্ছে। স্থানীয় কাউন্সিল সদস্যরা ডেডিকেটেড ফোন লাইন তৈরি করেছেন যেন যাদের সাহায্য প্রয়োজন তারা তা জানাতে পারেন।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ