শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

প্রবীণদের জন্য বৃদ্ধাশ্রম নয় ‘আনন্দ আশ্রয়’ দরকার

এম. এ. কাদের : অসহায় প্রবীণদের স্মরণ ও সন্মান দেখানোর জন্য ১৯৯০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ সভায় আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস  পালন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সেই সিধান্তে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতিবছর এ দিনটি (১ অক্টোবর) প্রবীণ দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। মানুষের গড় আয়ু বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবীণদের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, ১৯৯০ সালে বিশ্বে প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৫০ কোটি। বর্তমানে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ১১০ কোটিতে। ২০৩০ সালে এর সংখ্যা হবে ১৫০ কোটি এবং ২০৫০ সালে প্রবীণদের সংখ্যা ২০০  কোটি ছাড়িয়ে যাবে। বাংলাদেশে বর্তমান প্রবীণের সংখ্যা প্রায় দেড় কোটি। ২০২৫ সালে প্রবীণ সংখ্যা দাঁড়াবে প্রায় ২ কোটিতে। ২০৫০ সালে প্রবীণসংখ্যা হবে প্রায় সাড়ে চার কোটি এবং ২০৬১ সালে এ সংখ্যা গিয়ে দাঁড়াবে প্রায় ৬ কোটিতে। প্রবীণের সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাচ্ছে, এর ফলে একসময় শিশুর চেয়ে প্রবীণের সংখ্যাই হবে বেশি। এসময় পরিচর্যাহীন বার্ধক্যই দেশের একটি  প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে। এক বেসরকারি জরিপে জানা গেছে বর্তমান বাংলাদেশে প্রায় ৫০ লক্ষ প্রবীণ অসুস্থ, অসহায়, অবহেলিত, নিঃসঙ্গ ও সেবাহীন জীবন যাপন করছেন। বর্তমান সমাজে সবচেয়ে অবহেলার শিকার এখন অসহায় প্রবীণরাই কিন্তু ক্রমবর্ধমান বার্ধক্যের অসহায়ত্ব মোকাবিলা করার মত প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি আমাদের নাই। একারণে এখন থেকেই প্রবীণদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্মসূচী বাস্তবায়নে সরকারি নীতিনির্ধারকদের এগিয়ে আসা একান্ত প্রয়োজন।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় এবং ধর্মীয় অনুশাসনের অভাবে আমাদের দেশে বৃদ্ধ পিতা-মাতা কত যে অসহায় অবস্থায় জীবন যাপন করছেন বাইরে থেকে সেটা বোঝা যায় না। অনেক সময় বৃদ্ধ পিতা মাতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাড়ি পাহারা, সন্তান দেখাশোনা, বাজার করানো, সন্তানকে স্কুলে পাঠানো, ধমক দিয়ে কথা বলা, অপমান জনক আচরণ করা, চিকিৎসা না করানো, বৃদ্ধ পিতা মাতাকে আলাদা রাখা, এমনকি শেষ সম্বল পেনশনের টাকা, জমি-জায়গা বাড়িটুকু পর্যন্তও জোর করে লিখে নেওয়া হচ্ছে। অনেক বাবা-মা সন্তান ও পুত্রবধূর  কাছ থেকে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এমনকি মাদকাসক্ত ছেলে মেয়ে, বাবা-মাকে হত্যা পর্যন্ত করছে।
অনেক সন্তান বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়িতে রেখে তালা বন্ধ করে নিয়মিত স্বামী-স্ত্রী তার কর্মস্থলে চলে যায়। অনেক সময় অনেকে বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে একাকী রুমে আটকা রেখে ৫/৭ দিনের জন্য বাইরে বেড়াতে চলে যায়। তাছাড়া পারিবারিক বা সামাজিক বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বা দাওয়াতে পরিবারের সকল সদস্য অংশ গ্রহণ করলেও বৃদ্ধ পিতা মাতাকে ঝামেলা মনে করে সঙ্গে নিতে চায় না। অনেকর থাকার জায়গাও নিম্নমানের হয়ে থাকে। যেমন বাড়ীর নিচতলায়, বারান্দায়, চিলেকোঠায়, খুপরীঘরে, গোয়ালঘরে এমনকি বাড়ির কাজের লোকের সাথে অমানবিক ভাবে থাকতে দেওয়া হয়। অনেক সন্তানের সামর্থ্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন অজুহাতে অসুস্থ পিতা-মাতার এতটুকু খোঁজ খবর পর্যন্ত নিতে চায় না। তাছাড়া অনেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্রতার কারনেও বাবা-মার যত্ন নিতে পারেন না। অসুস্থ বৃদ্ধ পিতা-মাতা তাদের এই কষ্টের কথা কাউকে বলতে পারেন না। এত কষ্টের পরেও কেউ ভাল মন্দ জানতে চাইলে সন্তানের মুখ উজ্জ্বলের জন্য বলেন, “আমি খুব ভাল আছি”।
অসহায় প্রবীণদের কল্যাণের বিষয়ে এখনই আমাদের উদ্যোগী হওয়া জরুরী। কেননা বার্ধক্য হচ্ছে মানুষের অবধারিত সমস্যা। আজকের নবীনই আগামী দিনের প্রবীণ। তাই শ্রদ্ধার সংগে প্রবীণদের দেখভাল করতে হবে। আর এখন থেকেই নিজেদের স্বস্তিময় বার্ধক্যের প্রস্তুতি নিতে হবে। দয়া দাক্ষিণ্য বা করুনার দৃষ্টিতে নয়, মানবাধিকারের ভিত্তিতে এবং প্রাপ্য মর্যাদার যুক্তিতে প্রবীণদের চাওয়া পাওয়া সমাধান করা প্রয়োজন। এর জন্য দরকার গণসচেতনতা, আর এই গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রবীণদের অবহেলা, অযত্ন, দুর্ব্যবহার, নির্যাতনের ঘটনা এবং সবার করণীয় বিষয়গুলো সব শিক্ষা পাঠ্য সূচিতে এবং গণমাধ্যম কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করতে পারলে প্রবীণদের প্রতি কিছুটা হলেও সম্মান প্রদর্শন করা হবে। বার্ধক্য মানেই নানাবিধ দুর্বলতা।  বার্ধক্য পীড়িত প্রবীণের প্রতি যত্নবান হওয়া ও সহানুভুতিশীল থাকা খোদার বিধান। শুদ্ধাচার ও শিষ্টাচার মানব জীবনের অলংকার। আল্লাহ তায়ালা আদেশ দিয়েছেন, পিতা-মাতার প্রতি সদ্বব্যবহার করতে। তাদের একজন অথবা উভয়ই তোমার জীবদ্দশায় বার্ধ্যকে উপনিত হলে তাদেরকে উহ্ বলোনা এবং তাদের কে ধমক দিয়ো না; তাদের সঙ্গে সন্মানসুচক কথা বলো। মমতাবশে তাদের সামনে বিনয়াবনত করো এবং বলো “হে আমার প্রতিপালক আমার পিতা-মাতার প্রতি দয়া করো যেভাবে শৈশবে আমাকে প্রতিপালন করেছিলেন”।(সুরা-১৭বনি ইসরাইল, আয়াত : ২৩-২৪)। মানবতার মহান শিক্ষক বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ(সাঃ) বলেছেন, যে প্রবীণকে সন্মান করে না  সে আমার উন্মত নয়। (আবু দাউদ ও তিরমিজি)
যে প্রবীণ যৌবনে তাঁর মেধা, মনন, দক্ষতা দিয়ে সমাজের অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করেছেন, জীবনের সকল সুখ বিসর্জন দিয়ে সন্তানদের মানুষ করেছেন, মানব কল্যাণে অবদান রেখেছেন, বৃদ্ধ হওয়ার সাথে সাথে সেই মানুষটি অযত্ন অবহেলার আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। আপাতদৃষ্টিতে সমাজের বা সরকারের নুন্যতম দায়ীত্ব তাঁদের উপর বর্তায় না। শিশুদের উজ্জল ভবিষ্যত ও সুন্দর জীবন গড়ার জন্য  পিতা-মাতা ও সরকারের যেমন দায়িত্ব আছে অনুরূপ ভাবে প্রবীণদের জন্য সন্তান, সমাজ ও সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে।
প্রবীণদের এই অসহায় দুর্দশা এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই। এর সমাধান না করলে প্রত্যেককেই বৃদ্ধ বয়সে এই অবহেলা ও কষ্টের স্বাদ নিতে হবে। অনেক সন্তান তাদের কর্মব্যস্ততার কারণে কর্মস্থল ত্যাগ করে বাবা-মার পরিচর্যা বা সেবা যত্ন করতে পারেনা। অনেক পিতা-মাতা নিজের ভিটা মাটি ছেড়ে বিদেশে
সন্তানের সাথে থাকতে পছন্দ করে না। এই সব নানা কারণে দিনদিন সন্তানদের সাথে বাবা-মা’র সু-সম্পর্ক নষ্ট হচ্ছে। তাছাড়া অনেক পিতা-মাতার পুত্র সন্তান না থাকায় জামাই-মেয়ের বাড়িতে থাকতে পছন্দ করেন না। এ থেকে পরিত্রান পাওয়ার একটাই উপায়; কষ্টের বৃদ্ধাশ্রম নয়, প্রত্যেক উপজেলায় আনন্দের সাথে বসবাস করার জন্য “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তুলতে হবে। যেখানে স্ব-ইচ্ছায় প্রবীণরা থাকতে চাইবেন।
প্রত্যেক উপজেলার শহরের কাছাকছি কমপক্ষে পাঁচ একর জমির উপরে এই “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তুলতে হবে। আনন্দ আশ্রয়ে থাকবে প্রবীণদের সুচিকিৎসার জন্য হাসপাতাল, থাকবে ভাল নার্সিং ব্যবস্থা, থাকবে ভাল মানের খাবার, থাকবে বিনোদনের ব্যবস্থা, থাকবে প্রার্থনার জন্য মসজিদ, মন্দির, খেলার মাঠ, ব্যায়ামাগার ইত্যাদি। থাকবে ভাল আবাসনের ব্যবস্থা। এখানে যে কোন প্রবীণ স্ব-ইচ্ছায় থাকতে পারবেন। যাদের দেখার কেউ নেই, স্বামী-স্ত্রী এক সাথে বা একা একা থাকতে পারবেন। ধনী প্রবীণরা ভাড়া বা খরচ দিয়ে থাকতে পারবেন। একই বয়সে অনেকে এক সাথে থাকার কারণে প্রবীণরা আনন্দে থাকতে পারবেন। এতে সন্তান, আপন জনেরা  দেশে বিদেশে যেখানেই থাকুক না কেন বাবা-মা ভালো আছেন ভেবে তারা নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। প্রয়োজনে সন্তান, আপনজন বিদেশ থেকে এসে কিছুদিন আনন্দ আশ্রয়ে বাবা-মাকে সঙ্গ দিতে পারবেন। গরীব অসহায় প্রবীণরা সরকারী খরচে থাকবেন। প্রয়োজন হলে স্ব-ইচ্ছায় কিছুদিন বাড়ীতে, কিছুদিন “আনন্দ আশ্রয়ে” থাকতে পারবেন। অসহায় প্রবীণদের বিষয়টি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত করে, জনসচেতনতা ও প্রচারের মাধ্যমে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ  করে “আনন্দ আশ্রয়” গড়ে তোলার জন্য নিজ দায়িত্বে সকলে এগিয়ে আসলেই সত্বর বাস্তবায়ন সম্ভব হবে। ইতিমধ্যে এই মহৎ উদ্যোগকে  বেশীরভাগ সচেতন মানুষ ও ভুক্তভোগী প্রবীণরা স্বাগত জানিয়েছেন। গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়কে বাস্তবায়নের জন্য সমাজে দানশীল ও বিত্তবানেরা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে চায়। এখন সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে সরকার ও জন প্রতিনিধিদেরকে এগিয়ে আসতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ