শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

যৌতুকের অভিশাপ থেকে মুক্তি চাই

আজিজ ইবনে মুসলিম : যৌতুক একটা অনৈতিক অন্তর্ঘাত অনুষঙ্গ। দেশব্যাপী এখন এ সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। মূলত, আমাদের সমাজে ও সমাজ ব্যবস্থায় ধর্মীয় প্রজ্ঞাপ্রসূত জ্ঞানের বিস্তর অনুপস্থিতিতে এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় মতাদর্শ স্বাধীন হওয়াতে এ অবস্থার উদ্রেক করেছে সীমাহীনভাবে। অবশ্য বর্তমান সরকার যৌতুক নিরসনে নিশ্চিদ্র প্রচেষ্টা ও দণ্ডনীয় অপরাধ আইন প্রণয়ন করে কঠোরভাবে বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ‘যৌতুক দেয়া নেয়া দণ্ডনীয় অপরাধ’ স্লোগানের প্রচার-প্রচারণাও তুঙ্গে। তারপরও পত্রিকার পাতা খুললেই চোখে পরে যৌতুকের বলি, নারী নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি। প্রসঙ্গত, সূরা রুমের একুশ আয়াতের ভাবার্থ নিয়ে প্রভাবশালী একটি মাসিক পত্রিকায় আট লাইন কবিতা লিখেছিলাম। আল্লাহ্ বলেন, আমার নিদর্শনগুলোর মাঝে/এটা একটা দৃষ্টান্ত যে/আমি তোমাদেরকে স্বামী-স্ত্রী/জোড়ায় জোড়ায় সৃষ্টি করেছি/একের প্রতি অপরের নিশ্ছিদ্র/প্রেম, ভালোবাসা, মমতা গড়েছি/যেন তোমরা একজন অন্যের সন্নিকটে/মানসিক শান্তির মোহ মহাস্ফূর্তি ঘটে। সংসারে যত সুখ নারীর কারণে উন্মুখ।
আল্লাহ্ এবং আল্লার রসূল (সঃ) নারী জাতির প্রতি সুসংবাদ প্রদান করেছেন। যার দুই মেয়ে সন্তান তার জন্য আগাম জান্নাতের সুসংবাদ। শ্রদ্ধার অনুবর্তনও একাধিকবার মার প্রতি তিনবার ইঙ্গিত হয়েছে। তারপরও মেয়েরা নিগৃহীত, নিষ্পেশিত। আলোচনার জেরে বলতে হয়, ক’দিন আগে একটা উচ্চবিত্ত পরিবারে বিয়ের আমন্ত্রণে উপস্থিত হয়েছিলাম। বাড়ি থেকে চল্লিশ কি.মি দূরবর্তী উপজেলা শহরে। যৌতুকবিহীন বিয়ে এটা। আমন্ত্রিত অতিথির মধ্যে কবি, সাংবাদিক এবং বহু গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত থেকে বিয়ে সম্পন্ন হয়। বর, ডাঃ মাইনুল হাসান, বিধিসম্মত শশ্রুমণ্ডিত এম.বি.বি.এস, কলাপাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, পটুয়াখালী। কনে, মোসাম্মৎ মাহমুদা সুলতানা, এম.বি.বি.এস পড়ুয়া ৪র্থ বর্ষ, পিতা মোঃ সালাউদ্দিন ফরাজী, কর্মকর্তা সোনালী ব্যাংক, পাথরঘাটা শাখা, বরগুনা। গ্রামের বাড়ি গলাচিপার পাতাবুনিয়া। অনুসন্ধানে জানা যায়, এরা মূলত যৌতুকবিরোধী মানসিকতায় ও প্রচারণায় অনঢ় অবস্থানে। এ নজির স্থাপনে উদ্দীপনায় উৎসাহী। গাড়িতে যাচ্ছিলাম অনুষ্ঠানস্থলে, পথে রাস্তার পাশে একটি ছাড়াভিটা জঙ্গল ও গুল্মলতার আচ্ছাদনে এক নারীর কবর। যৌতুকের বলি, মেয়েটির অপমৃত্যু। আমি তখন ঐ এলকায় কৃষি ব্যাংকের মাঠ কর্মকর্তা। মেয়েটির স্বামীর বাড়ি আমার পার্শবর্তী গ্রামে। বরের অবস্থা ভাল। পিতা সরকারি চাকরি করেন। ছেলেটি ও ছেলেটির মা (স্বামী) বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের চাপ অব্যাহত রাখে গ্রাম্য সরলা নববধূর প্রতি। অবশ্য মেয়েটিকে বিয়ের সময় মা-বাবা সাধ্যমত জেওর গহনা প্রদান করেছিল। তারপরও দফায় দফায় মারপিট এবং নগদ টাকা চায়। প্রণয়না মেয়েটিকে ঝেঁটিয়ে বাবার বাড়ি রেখে যায়। মেয়েটি স্বামীর জন্য হাপিত্যেশ করে, কান্নাকাটি করে, আসতে খবর পাঠায়। কিন্তু স্বামী স্ত্রীর কাছে আসেনি কোনদিনই। এসেছিল একটি পত্রবাহক। হাতে চিরকুট অনুঢ়া বধূ চিঠি হাতে না নিলেও পাশের এক ব্যক্তি কাগজটি পাঠ করে শোনায়। ‘তালাকনামা’। মেয়েটা দাঁড়িয়ে নিবিষ্ট মনে পাঠ শুনছেন। অনিমিখ দু’টি আঁখি নিষ্পলক। উপরে বসন্তের সুনীল আকাশ, নীচে মর্তের ধূসর ধুমল জমিন, বাড়ির উঠোন। সহসা মেয়েটি মূর্ছনা গেল। মুদে গেল আঁখি, দিনান্তের পাখি উড়ে গেল নির্লিপ্ত পাখায়। যৌতুকের বলি বিথীকার শাখা-প্রশাখায়, অনুরিত। বাড়ির লোকের আর্তচিৎকার শুনে গিয়ে দেখি ঘুমের অঘোরে লীন, নিস্তব্ধ নিথর, মাটিতে পড়ে আছে সুকোমল ধর। লক্ষ্য করি নিষ্প্রাণ দেহটি ধুলোয় লুটিয়ে রয়েছে। চুলগুলো অগোছালো। দরিদ্র পরিবারে মেয়েটি রাস্তার পাশের্^ পারিবারিক গোরস্থানে ঘুমন্ত। যৌতুকের নিঠুর কষাঘাতে স্বামীর তালাকনামার শাব্দিক ধ্বনিগুলো তাকে না ফেরার দেশে যেতে করাঘাত করেছে। তবে ঐ পাষণ্ড স্বামীর সাথে মাঝেমধ্যে পথে এখনও দেখা হয়। সেতো বর্তমানে মানসিক প্রতিবন্ধী। অদ্যাবধি কেউ তাকে আরেকটি মেয়ে দেয়নি। আমাদের সমাজ থেকে যৌতুকপ্রথা নির্মূলে ধর্মীয় শিষ্টাচার ও নিয়ম-নীতি সংঘবদ্ধভাবে শহর ও লোকালয়ে প্রচার চালাতে হবে। সরকারি আইন তো বর্তমানে রয়েছেই, তবে এর স্বার্থক প্রয়োগের উন্মেষ ঘটাতে হবে সরকার পক্ষকে যথাযথভাবে। আর আমরা যারা কন্যা দায়গ্রস্ত, যৌতুক প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যেকে প্রত্যাখ্যান করলে যৌতুক প্রথা নির্মূল হবে নিঃসন্দেহে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ