শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

দিল্লীতে বিজেপির ভরাডুবি

ভারতের রাজধানী দিল্লীর রাজ্য বিধানসভা নির্বাচনে রীতিমতো চমক দেখিয়েছেন আম আদমি পার্টির নেতা ও মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল। পরপর তিনবার জিতে হ্যাটট্রিক করেছেন তিনি। অন্যদিকে লজ্জাকর ভরাডুবি ঘটেছে মাত্র আট মাস আগে দ্বিতীয়বারের মতো বিরাট ভোটের ব্যবধানে জিতে কেন্দ্রে সরকার গঠনকারী দল বিজেপি। গত ১১ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত দিল্লী বিধানসভা নির্বাচনে ৭০টির মধ্যে ৬২ আসনে জিতেছেন আম আদমি পার্টির প্রার্থীরা। এর বিপরীতে ভোটের হার ৬ শতাংশের মতো বাড়াতে পারলেও বিজেপি জিতেছে মাত্র ৮টি আসনে। ওদিকে তৃতীয় প্রধান দল এবং ১৯৪৭ থেকে দফায় দফায় ক্ষমতায় থাকা ন্যাশনাল কংগ্রেস একটি আসনেও জিততে পারেনি। 

বিরাট গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের রাজধানীকেন্দ্রিক নির্বাচনের এই ফলাফল বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। একে শুধু বিজেপি বা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির নয়, দারুণ ক্ষমতাধর হিসেবে পরিচিত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহরও পরাজয় বলে ধরে নেয়া হচ্ছে। উল্লেখ্য, দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মোদি-অমিত শাহ জুটির নেতৃত্বে ভারতে নতুন পর্যায়ে হিন্দুত্ববাদের অভিযান শুরু হয়েছে। ২০১৯ সালে লোকসভা নির্বাচনের প্রচারণা শুরু হওয়ার পর থেকেই মোদি-অমিত শাহ জুটি এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন, যেগুলো প্রত্যক্ষভাবেই মুসলিম বিরোধী। তারা ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে ভারতের অধিকৃত কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক মর্যাদার অবসান ঘটিয়ে মুসলিম অধ্যুষিত রাজ্যটিকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনে নিয়ে এসেছেন। একযোগে শুরু করেছেন এনআরসি বা নাগরিকপঞ্জি তৈরির কার্যক্রমÑ যার অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে ভারত থেকে বিতাড়িত করা। এনআরসির পাশাপাশি সিএএ ধরনের আরো কিছু আইনগত পদক্ষেপও মোদি-অমিত শাহ জুটি নিয়েছিলেন, যেগুলোর আড়াল নিয়ে ভারতীয় মুসলিমদের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া এবং তাদের সকলকে ভারত থেকে তাড়িয়ে দেয়া সম্ভব হবে। এ ধরনের প্রতিটি বিষয়ে সরকার তথা বিজেপিকে সমর্থন যুগিয়েছে আরএসএস বা রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘÑ সশস্ত্র কর্মকান্ডে নিয়োজিত যে দলটিকে ব্রিটিশ আমল থেকেই কট্টর মুসলিম বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। 

মোদি-অমিত শাহ জুটি একই সঙ্গে দেশের শিক্ষা ক্ষেত্রেও নৈরাজ্যের সৃষ্টি করেছিলেন। মুসলিমরা তো বটেই, এই কর্মকান্ডে ধর্মনির্বিশেষে গরীব তথা সাধারণ শিক্ষার্থীরাও আক্রান্ত ও ক্ষতিগ্রস্ত হতে শুরু করেছিল। অনেকের জন্য এমনকি লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়াও অসম্ভব হয়ে পড়েছিল। ঠিক এ পর্যায়ে এসেই প্রচন্ড বিরোধিতা ও আন্দোলনের সম্মুখীন হয়েছিলেন মোদি-অমিত শাহ জুটি। দিল্লির জেএনইউ বা জওয়াহেরলাল নেহরু ইউনিভার্সিটি থেকে শুরু করে সারা ভারতেই শিক্ষার্থীদের সে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। রূপ নিয়েছিল গণঅভ্যুত্থানের। এই গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ করে দেয়ার জন্য বিজেপি সরকার ছাত্র-জনতার ওপর গুলি পর্যন্ত চালিয়েছে। হতাহত হয়েছেন অনেকেই। কিন্তু থেমে যাওয়ার কিংবা স্তিমিত হওয়ার পরিবর্তে গণঅভ্যুত্থান বরং আরো বেগবান হয়েছে। ফলে প্রমাদ গুনতে হয়েছে মোদি-অমিত শাহ জুটিকে। একেবারে বাতিল না করলেও এনআরসি ও সিএএ ধরনের কার্যক্রম চালানো থেকে সাময়িকভাবে  পিছু হঠেছেন তারা।

দেশজুড়ে প্রচন্ড হয়ে ওঠা সে গণঅভ্যুত্থানের সুযোগ নিয়েই সামনে এগিয়েছিলেন অরবিন্দ কেজরিওয়াল। খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল তার প্রচারণার কৌশল। সরকার বিরোধী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে জনপ্রিয়তা অর্জনের পথে পা না বাড়িয়ে পানি গ্যাস ও বিদ্যুৎসহ শস্তায় ও বিনামূল্যে জনগণকে পরিষেবা দেয়ার ব্যাপারেই সচেষ্ট ও তৎপর থেকেছেন কেজরিওয়াল। ২০০ ইউনিট পর্যন্ত বিদ্যুৎ এবং ১০০০ লিটার পর্যন্ত পানির জন্য কোনো বিল বা মূল্য নেননি তিনি। কেজরিওয়াল বরং পরিষেবার পরিধি বাড়ানোর চেষ্টা করবেন বলে অঙ্গিকার ব্যক্ত করেছেন। পর্যালোচনায় দেখা গেছে, মূলত এ ধরনের পরিষেবা এবং গণঅভ্যুত্থানসহ সরকার বিরোধী কার্যক্রম থেকে সুকৌশলে নিবৃত্ত থাকার কারণেই আম আদমি পার্টি বিজয়ী হয়েছে।

বিরাট দেশ ভারতে দিল্লি একটি ক্ষুদ্র রাজ্যমাত্র হলেও অরবিন্দ কেজরিওয়াল এবং তার দল আম আদমি পার্টির এই বিজয়কে ভারতীয় রাজনীতির পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন বিজেপির জন্য সতর্ক বার্তা হিসেবে মনে করছেন। কারণ, তীব্র বেকার সমস্যা থেকে শুরু করে সকল সমস্যাকে এক পাশে ঠেলে রেখে কেবলই মুসলিম এবং পাকিস্তান বিরোধী প্রচারণায় ব্যস্ত হয়ে ওঠায় লোক সভা নির্বাচনের পর মাত্র আট মাসের মধ্যেই বিজেপি রাজস্থান, ছত্তিশগড়, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র এবং ঝাড়খন্ডের বিধানসভা নির্বাচনে হেরে গেছে। এবার হেরেছে দিল্লিতে। এর পরপর আসছে বিহার, আসাম, তামিল নাড়–, কেরালা এবং পশ্চিম বঙ্গ বিধানসভার নির্বাচন। 

বলা হচ্ছে, এসব রাজ্যের নির্বাচনেও বিজেপি তথা মোদি-অমিত শাহ জুটি বড় ধরনের ভরাডুবির শিকার হতে পারেন। প্রায় নিশ্চিত সে ভরাডুবি এড়ানোর জন্য পরামর্শও দিয়েছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী মোদিকে অবশ্যই মুসলিম বিরোধী প্রচারণা ও কর্মকান্ডের অবসান ঘটাতে হবে। এখন দেখার বিষয়, প্রধানমন্ত্রী মোদি হিংসা ও সংঘাতের পথ ছেড়ে শান্তি ও গণতন্ত্রের পা বাড়ান কি না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ