বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

ভোট দিলেও যে ফল, না দিলেও...!

মোহাম্মদ আবু নোমান : প্রাণের পরশ বা উৎসবমুখর পরিবেশ ছাড়াই শেষ হলো ঢাকার দুই সিটি নির্বাচন। নির্বাচনী মাঠে সর্বত্র দৃশ্যমান ছিলো একপক্ষীয় প্রাধান্যের ছাপ। রাজনৈতিক দলের কাজ ভোটারদের সঙ্গে, জনগণের সঙ্গে। ভোটারদের বিমুখ হওয়াটা চিন্তার বিষয়। নির্বাচন নিয়ে প্রত্যাশার চেয়ে শঙ্কার দাগটাই বেশি মোটা হয়ে উঠেছিল এবং বাস্তবে এরই প্রতিফলন দেখা গেল। নির্বাচনে কে জিতবে; কে হেরেছে; কে হবেন নগরসেবক; ভাই-ভগ্নি; এসব বিষয় এখন আর মোটেই মুখ্য নয়। নির্বাচনী ফলাফল মানুষ কেবল আগাম বোঝেই না, জেনেও যায়! সাধারণ ভোটাররা এখন মনে করছেন, ভোট দিলেও যে ফল হবে, না দিলেও তাই হবে। আওয়ামী লীগের সাধারণ ভোটাররাও মনে করেন, ভোট দিতে না গেলেও তাঁদের প্রার্থী জয় পাবেন। ফলে তাঁরাও ভোট দিতে যাচ্ছেন না।
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) কথায় ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ভোটদাতার সংখ্যা ২৫ শতাংশের কিছু বেশি। আর দক্ষিণে ২৯ শতাংশ। কোনো গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে এত কম সংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। প্রধান নির্বাচন কমিশনার কেএম নূরুল হুদা বলেছেন, ‘এমন নির্বাচন তিনি চাননি।’ তাহলে প্রশ্ন আসে, তিনি কেমন নির্বাচন চেয়েছিলেন? খামোখা ইলেকশন নিয়ে এতে হৈ-চৈ ঢামাঢোল করে, আমাদের জীবনের নিরাপত্তা সংশয়ে ফেলে, পরিবেশ দুষণ করে, রাস্তাতে জ্যাম বাড়িয়ে, বিপুল অর্থ ব্যয় করে ভোটের আয়োজন করার পর মানুষ যদি ভোট দিতে না চায়, তাহলে এ নির্বাচন দিয়ে কী হবে? অনেক বড় অংকের নির্বাচনি ব্যয়ের সাথে জনভোগান্তি করে তামাশা করার কেনো অর্থ হয় না! বাস্তবতা হলো মানুষ নির্বাচন বিমুখ হয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রত্যাখ্যান করেছে। স্বাধীন গণতান্ত্রিক কোনো সভ্য দেশে নাগরিক অধিকার হরণের এমন প্রদর্শনী মোটেই কাম্য নয়। ভোটের প্রতি মানুষের অনাগ্রহ বা অনাস্থা সেটা কোনোভাবেই ভালো লক্ষণ নয়। সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে নির্বাচন কমিশনের ওপর জনআস্থা ধ্বংস হওয়ার যে উদ্বেগজনক বার্তা ক্রমেই পুষ্ট হচ্ছে, তা কোনোভাবেই স্বস্তির বিষয় নয়।
নির্বাচন কমিশনার নিজেও বলেছেন, ‘সিটি নির্বাচনে আশানুরূপ ভোটার আসেননি।’ আমরা মনে করি, নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হতে পারত। কিন্তু রাজনৈতিক দল, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশন- সবাই এ ব্যাপারে আন্তরিকতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছেন। সাধারণ ভোটারদের মনোভাব রাজনৈতিক দলগুলোর জন্য ভালো কিছু নয়। এক ধরনের আস্থাহীনতা, অবিশ্বাসের প্রকাশ ঘটিয়েছে মানুষ নির্বাচন কমিশনের প্রতি। বিএনপি কর্মীরা কেন্দ্রে যাননি মামলা-হামলার ভয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগের সমর্থকরা কেন যাবেন, যখন তারা বুঝে গেছেন, ভোট দিতে না গেলেও তাঁদের প্রার্থী জয় পাবেন।
এক সময় বাংলাদেশে যে নির্বাচনকে তুলনা করা হতো উৎসবের সঙ্গে, তা এখন উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলীয় মনোনয়ন, প্রতীক ও টাকা-পয়সার ভূমিকাই এখন মুখ্য। চারদিকে সব সুযোগ-সন্ধানীর ভিড়। ঘাটে ঘাটে এখন সুবিধাভোগীদের উৎপাত। এই সুবিধাবাদীরা কথায় কথায় আদর্শিক নীতিমালা ঝাড়ে। নানা চেতনার বুলি আওড়ায়। বাস্তব জীবনে তাদের টার্গেট বাণিজ্য করে যাওয়া। এতে সর্বনাশটা হয় দেশের। অনেকটা দলেরও। মানুষ আস্থা হারিয়েছে সরকারি নানা সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সাংবিধানিক কতিপয় ইনস্টিটিউটগুলোর প্রতি। সে প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি সর্বসাধারণের আস্থা হারালে রাষ্ট্র ভীষণভাবে দীর্ঘমেয়াদে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেই সময়টা চলছে এখন। গণতন্ত্রে নির্বাচনকে উৎসবে রূপ দেয়ার নজির বিশ্বের অন্যান্য গণতান্ত্রিক দেশের মতো বাংলাদেশেও ছিলো। কিন্তু আমরা সে রকমটি দুর্ভাগ্যবশত কী কারণে এখন আর তেমনভাবে প্রত্যক্ষ করতে পারছি না? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে সংশ্নিষ্ট দায়িত্বশীল সবাইকে, দেশ-জাতির বৃহৎ স্বার্থ ও প্রয়োজনেই। ভোটারদের কম উপস্থিতিটা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত। ভোটের প্রতি আস্থাহীনতা তৈরির দায়ভার কারও একার নয়। এখানে সবার ভুলই কমবেশি দায়ী। আমরা একটা জটিল সময় পার করছি। বর্হিবিশ্বের আমরা বর্বর জাতিতে পরিণত হচ্ছি। রাষ্ট্র, সরকার, সমাজের বিভিন্ন স্তর এখন প্রশ্নবিদ্ধ। সাধারণ মানুষ হতাশ।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার ভোট দিতে গিয়ে এজেন্টদের ক্ষমতা প্রয়োগের কথা বলেছেন। অথচ বিরোধী দলের এজেন্টদের বের করে দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। ভোটার উপস্থিতি সম্পর্কে সিইসি বলেন, সকাল থেকে যা দেখলাম, এখন পর্যন্ত (বেলা সোয়া ১১টা) ভোটার উপস্থিতি ভালো না। দেখলাম এই কেন্দ্রে (উত্তরার আইইএস স্কুল অ্যান্ড কলেজে) ২৭৬ জন ভোটার এখন পর্যন্ত এসেছেন। আশা করছি, পরে আরো আসবেন। তিনি বলেন, সকালের দিকে যে দুই-একটি কেন্দ্র পরিদর্শন করেছি সেখানেও লোকজন কম ছিল। তিনি আরো বলেন, আমরা ভোটের পরিবেশ সৃষ্টি করেছি। আমাদের দিক থেকে প্রস্তুতির কোনো ঘাটতি নেই। যারা প্রার্থী, নির্বাচনে অংশগ্রহণ করছেন ভোটার আনার দায়িত্ব তাদের বেশি। সিইসি কে এম নুরুল হুদা বলেন, এজেন্টদের কেন্দ্রে টিকে থাকার সামর্থ্য থাকতে হবে। প্রতিরোধ করার ক্ষমতা থাকতে হবে। কেউ বলল বেরিয়ে যাও, অমনি চলে যেতে হবে? তিনি বলেন, সেখানে এজেন্ট মারামারি করবেন না, তবে তিনি প্রতিরোধ করবেন। বলবেন, আমি যাব না। তারপরেও যদি তাকে বের হয়ে যেতে হয় তিনি পরবর্তী ব্যবস্থায় যাবেন। কিন্তু আমাদের জিজ্ঞাসা হলো, এজেন্টদের সুরক্ষা দেয়া এবং তাঁদের দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত করার দায়িত্বটা নির্বাচন কমিশনের নয় কী? ভোটকেন্দ্রের বাইরে ব্যাজ পরা লোকজনের মহড়ার মধ্য দিয়ে নির্বাচনী আইনের ব্যত্যয় ঘটেনি কী? এদের কারও বিরুদ্ধেতো ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি।
আমরা জানি নির্বাচন সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ, কিংবা প্রশ্নমুক্ত করার জন্য ইসির সংবিধান-প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগে কারও মুখাপেক্ষী হয়ে থাকারও কথা নয়। এই অপসংস্কৃতির গণ্ডিমুক্ত হতে না পারাটাও আমাদের অমঙ্গলের কারণ। নাগরিক সংগঠন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) ইতিপূর্বে এক বিবৃতিতে বলেছে, ‘প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ সব কমিশনারের আশু অপসারণ ও নির্বাচন কমিশনকে নতুন করে ঢেলে সাজানোর বিকল্প নেই’ উল্লেখ করে বিষয়টিতে রাষ্ট্রপতির হস্তক্ষেপ কামনা করেছে। কারণ হিসেবে টিআইবি বলেছে, একটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেভাবে একের পর এক কেলেঙ্কারির জন্ম দিচ্ছে, তা অভূতপূর্ব ও গোটা জাতির জন্য বিব্রতকর। ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে যে জাতীয় নির্বাচন হয়েছিল, সেই নির্বাচন বাংলার মানুষ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখেছে। ৩০ ডিসেম্বরের ভোট কীভাবে ২৯ ডিসেম্বর রাতেই সম্পন্ন হয়েছিল, তা ইতিহাসের কদর্য অধ্যায়। তখনও এই নির্বাচন কমিশনই দায়িত্বরত ছিল। তারও আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি যে জাতীয় নির্বাচন হয়, তাতে ১৫৪ জন বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় জাতীয় সংসদের সদস্য হলেন।
নির্বাচন কমিশন ও তাদের সহযোগীদের মুখ্য দায়দায়িত্ব হচ্ছে ভোটারের ভোটাধিকার সুরক্ষা করা। কিন্তু তা করতে দায়িত্বশীলরা ইতিপূর্বে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন বলেই আজ নির্বাচন নিয়ে এত নেতিবাচক কথা। ভোটারের ভোটাধিকার প্রয়োগে উৎসাহ হারিয়ে ফেলাটা মোটেও স্বস্তির কোনো বিষয় নয়। অতীতের নির্বাচনগুলোতে যেভাবে অনিয়ম হয়েছে, তাতে ইসি ও আমাদের নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রতি জনআস্থা একেবারে তলানীতে ঠেকেছে। ভোটকেন্দ্রের মধ্যে বুথের গোপন কক্ষে বহিরাগতের উপস্থিতি  ইভিএমের সাফল্য অনেকটাই ম্লান করে দিয়েছে বলে সংশ্নিষ্টরা মনে করছেন। পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বাধাদান, প্রকাশ্যে ভোট দিতে বাধ্য করা ও হুমকি-ধমকি দেওয়ার অভিযোগেও প্রশাসনের ভূমিকা যথাযথ ছিল না বলে অভিযোগ উঠেছে। ফলে সুষ্ঠু ভোটের বিষয়ে ইসির ওপর জনগণের আস্থাহীনতা এই ভোটের পরও একই অবস্থায় রয়েছে বলে মনে করেন নির্বাচন বিশ্নেষকরা।
গত ১০০ বছরের যেকোনো নির্বাচনের তুলনায় এবারের সিটি করপোরেশন নির্বাচন সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ হয়েছে বলে মন্তব্য করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। যদিও বাংলাদেশের একশো বছরের ইতিহাস নেই! স্বাধীনতা লাভের ৪৯তম বছরে আমরা। বাকি ৫১ বছরের হিসেব কীভাবে মেলালেন ক্ষমতাসীন নেতাই তা জানেন। রাজনৈতিক নেতাদের মনে রাখতে হবে, অন্যায়, অনাচার, অবিচার, অত্যাচার জন্ম দেয় জাতির জীবনে অনাকাঙ্খিত ঘটনা।
যে নির্বাচনটা হয়ে গেল, তা স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হলেও খুবই গুরুত্বপূর্ণ স্থানীয় সরকার নির্বাচন। একটি দেশের রাজধানী বলে সরকারের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সরকারের প্রমাণ করার সুযোগ ছিল, একটা স্বচ্ছ নির্বাচন করা গেছে এবং ইভিএমের ব্যবহারে বিভ্রান্তির কোনো অবকাশ নেই। এটা তারা প্রমাণ করতে পারেনি। সারাদেশের মানুষের দৃষ্টি ছিল এই নির্বাচনের দিকে। বিদেশিদেরও দৃষ্টি কম ছিল না। বিগত জাতীয় নির্বাচনের তুলনায় বিভক্ত ঢাকার সিটি করপোরেশনের ভোটের প্রচার-প্রচারণা অনেক ক্ষেত্রেই নির্বিঘ্ন থাকলেও শেষ পর্যন্ত ভোট গ্রহণ পর্বে সেই ধারা অব্যাহত থাকেনি। ভোটারদের কাঙ্খিত মাত্রায় ভোটকেন্দ্রমুখী না হওয়াটাও কোনো সুবার্তা বহন করে না। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট আয়োজনে ইসি সাংবিধানিক দায়িত্ব প্রশ্নমুক্তভাবে পালন করতে না পারায় নতুন করে নানা প্রশ্ন দেশব্যাপী ঘুরপাক খাচ্ছে।
পরিশেষে কথা হলো, নির্বাচন নিয়ে নানা রকম সমালোচনা চলবে, বিএনপি ইতোমধ্যে এই নির্বাচন প্রত্যাখ্যানও করেছে। পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞরা নানা মতামত দেবেন। কিন্তু তাতে ভোটের ফলাফল বদলাবে না। কিন্তু তাপরপরও আমরা আশা করবো, ঢাকাকে ঐতিহ্যের ঢাকা, সুন্দর ঢাকা, সচল ঢাকা, সুশাসিত ঢাকা ও উন্নত ঢাকা গড়া এবং মানুষের দোরগোড়ায় নাগরিক সেবা পৌঁছে দেয়ার যে বার্তা প্রার্থীরা দিেেয়ছিলেন, প্রতিশ্রুতিগুলো তারা মনে রাখবেন। প্রার্থীরা তাদের দায়বদ্ধতা থেকে একটি পরিকল্পিত নগরী নির্মাণের প্রত্যয় ও ঢাকাকে একটি মানবিক শহরে পরিণত করার যে অঙ্গীকার তারা করেছিলেন, আমরা আশা করি সেভাবে কাজ করবেন। নির্বাচিত মেয়রদ্বয়কে অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা জানিয়ে বলার কথা এটাই, আপনারা ভোটের আগে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা অনুগ্রহ করে মনে রাখবেন। ভোটের ত্রুটিবিচ্যুতি নিয়ে যে সমালোচনা তা মানুষ ভুলে যাবে যদি আপনারা নাগরিক জীবনকে স্বস্তিময় করতে পারেন। আপনারা ব্যর্থ হলে, আপনারা অঙ্গীকার ভুলে গেলে, ক্ষতি হবে দেশের, বদনাম হবে দলের।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ