শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ভোক্তারা অজ্ঞ হলে আইন যায় বিফলে

নাবিল হাসান : বাংলাদেশে আইনের ব্যত্যয় ঘটলে প্রারম্ভেই যে মানুষগুলোর স্কন্ধে সবটা দায় চাপিয়ে দেয়া হয় তাঁরা হলেন আইনের মানুষগুলো। এখানে অস্বীকার করার কোনো জায়গা নেই যে আইনি বাস্তবায়নের অনেকক্ষেত্রেই তাদের সীমাবদ্ধতা দিনের আলোর মতন স্পষ্ট কিন্তু আইনের যথাযথ সুফল পাওয়ার পেছনের বৃহদাংশ কারণ যে জনগণের ওপরেও নির্ভরশীল এটা কি আমরা কেউ সূক্ষ্মভাবে ভেবে দেখেছি? ঠিক এমনি ‘ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইনের’ বর্তমান অবস্থা এবং এর সিদ্ধিলাভের পরিপন্থী হিসাবে জনগণকে দায়ী করার একাধিক কারণ আছে। প্রথমেই ভোক্তা কিংবা যাদেরকে দায়ী বলছি তাদের সঠিক সজ্ঞা জানা প্রয়োজন। ‘ভোক্তা’ বলতে সাধারণ অর্থে আমরা যেকোনো পণ্যের ক্রেতা বা গ্রহীতাকে বুঝি। কিন্তু ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ এ ভোক্তাকে সুনির্দিষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আইনটিতে বলা হয়েছে, ভোক্তা অর্থ এমন কোনো ব্যক্তি যিনি পুনঃবিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ ব্যতীত মূল্য পরিশোধে বা মূল্য পরিশোধের প্রতিশ্রুতিতে কোনো পণ্য ক্রয় করেন, যিনি ক্রেতার সম্মতিতে এ উল্লিখিত কৃত পণ্য ব্যবহার করেন। আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় প্রত্যেকেই কোনো না কোনোভাবে ভোক্তা। এখন জানা প্রয়োজন ভোক্তার ভোগ পণ্যগুলোর সীমা-পরিসীমা। ভোগ্য পণ্যগুলো ভোক্তার দ্বারা ব্যবহারের জন্য ক্রয় করা পণ্য এবং এর বিকল্প হিসাবে চূড়ান্ত পণ্য বলা হয়।পোশাক, খাদ্য এবং গহনাগুলি সমস্ত ভোগ পণ্যের উদাহরণ। এখন পরিষ্কার করার পালা যে এই আমরা ভোক্তাদের কারণেই যে অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যভেজাল, দূর্নীতি এমনকি উপর্যুপরি আইনভঙ্গের পায়তারা গুলো চলে আসছে। বিশ্ব সাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬০ কোটি মানুষ ভেজাল ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের কারণে অসুস্থ হয়। এর মধ্যে মারা যায় ৪ লাখ ৪২ হাজার মানুষ। অপরদিকে পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের ‘বিষাক্ত খাদ্য জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি’ শীর্ষক সেমিনারে বলা হয়, শুধু ভেজাল খাদ্য গ্রহণের ফলে বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৩ লাখ লোক ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছে। ডায়াবেটিস আক্রান্তের সংখ্যা ১ লাখ ৫০ হাজার, কিডনি রোগে আক্রান্তের সংখ্যা ২ লাখ। এ ছাড়া গর্ভবতী মায়ের শারীরিক জটিলতাসহ গর্ভজাত বিকলাঙ্গ শিশুর সংখ্যা দেশে প্রায় ১৫ লাখ। ভেজাল খাদ্যের শোচনীয় নজিরের ফলাফল ঘটে আসছে বছর বছর। ২০১৫ সালে দিনাজপুরে কীটনাশকমিশ্রিত লিচুর বিষক্রিয়ায় ৮ এবং ২০১২ সালে ১৪ জন শিশুর প্রাণহানি ঘটে। ২০১৩ সালে দিনাজপুর ও ঠাকুরগাঁওয়ে বিষাক্ত খাবার গ্রহণের ফলে ১৪ শিশুর মর্মান্তিক মৃত্যু হয়। ২০০৯ সালে ধামরাইয়ে ৩ শিশু মারা যায় বিষাক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে। এই হলো আমাদের দেশের চলমান নয়নাভিরাম চিত্রসমূহ আর এসব চলমান চিত্রের চিত্রকররা ছাড়া পেয়ে যাওয়ার কারণ জানেন কি? হ্যা, আমরা যারা আপামর জনতা এই দুর্ভোগ পোহাচ্ছি তারাই এই ভোক্তা-অধিকার আইন সম্পর্কে মোটেও সচেতন নই। যদি আমরা একটু সচেতন হই আর সঠিক সময়ে নির্দিষ্ট জায়গায় অভিযোগ আনতে পারি তাহলে আমি শতভাগ নিশ্চিত যে এই দূরাবস্থার সীমা সংকুচিত হয়ে যাবে কারণ এতে দুর্নীতি রোধ হবে, ভেজাল রোধ হবে এমনকি অভিযোগকারী আর্থিক সুবিধাও পাবেন বেশ করে। সর্বপ্রথম ‘ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন’ সম্পর্কে একটুআধটু জেনে নেওয়া যাক। বর্তমান সরকার ৬ এপ্রিল, ২০০৯ তারিখে ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯ প্রণয়ন করেন।এই আইন ভঙ্গের সরূপ কেমন হতে পারে তা দেখে নেই-সরকারের নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দামে কোনও পণ্য, ওষুধ বা সেবা বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করা, জেনেশুনে ভোজাল মেশানো পণ্য বা ওষুধ বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করা, স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক দ্রব্য মিশ্রিত কোন খাদ্য পণ্য বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করা, মিথ্যা বিজ্ঞাপন দিয়ে কোনো ক্রেতাকে প্রতারিত করা, প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রি বা সরবরাহ না করা,বাটখারা বা ওজনমাপার যন্ত্রে কারচুপি করা, দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপির মাধ্যমে ক্রেতাকে ঠকানো, নকল পণ্য বা ওষুধ প্রস্তুত বা উৎপাদন, মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রি বা বিক্রির প্রস্তাব করা, নিষিদ্ধ কোনও কাজ করা যাতে সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে, অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা ইত্যাদি। এসব নিয়ম ভঙ্গের শাস্তি হিসেবে অনূর্ধ্ব সাত বছরের কারাদণ্ড বা অনধিক ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে। পূনরায় একই অপরাধ করলে সাত বছর থেকে অনূর্ধ্ব ১৪ বছরের কারাদণ্ড বা অন্যূন ১০ লাখ টাকা জরিমানা। এসবের স্বীকার হওয়া যে কেউ অভিযোগ করতে পারবে আর অভিযোগের সময়সীমা হলো ঘটনা ঘটার দিন থেকে ৩০ দিন পর্যন্ত।মজার ব্যাপার হলো অভিযুক্তকে প্রমাণিত করতে পারলে জরিমানার শতকরা ২৫% পেয়ে যাবে অভিযোগকারী।সরসে বললে ‘যার কোনো চাকরী হয় না সে কিন্তু চাইলেই এসকল ভেজাল খুঁজে পুরষ্কার লুফে নিতে পারেন। একে তো ভেজাল দূর হলো পাশাপাশি বেকারত্বও ঘুচল। আপনার দায়েরকৃত অভিযোগ লিখিত উপায়ে ফ্যাক্স, ই-মেইল, ওয়েব সাইটের মাধ্যমে বা অন্য যেকোনও উপায়ে হতে পারে। অভিযোগের সঙ্গে পণ্য ক্রয়ের রশিদ বা রশিদের ছবি সংযুক্ত করতে হবে।
অভিযোগকারীকে অভিযোগে তার পূর্ণাঙ্গ নাম, পিতা ও মাতার নাম, ঠিকানা, ফোন, ফ্যাক্স ও ই-মেইল আইডি (যদি থাকে) এবং পেশা উল্লেখ করতে হবে। অভিযোগটি মহাপরিচালক, জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর, ১ কারওয়ান বাজার (টিসিবি ভবন-৮ম তলা), ঢাকা, মোবাইল : ০১৭৭৭-৭৫৩৬৬৮, ফ্যাক্স : +৮৮০২ ৮১৮৯৪২৫। অথবা ই-মেইল করতে পারেন [email protected] এই ঠিকানায়। অভিযোগ গ্রহণের পর একটি তারিখ দেয়া হবে শুনানির জন্য। উক্ত তারিখে উভয়পক্ষকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্রসহ উপস্থিত থাকতে হবে। সবশেষে কিছু কথা বলতে চাই।আমার কাছে আইন হলো একটি আয়নার মতন।যে আয়নায় আপনার কাক্সিক্ষত চেহারাটি তখনি দেখা যাবে ঠিক যখনি আপনি সাহায্যকারী হিসেবে সে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। তাই আমাদের প্রতিষ্ঠিত আইনকে সর্বদা সাহায্য করা প্রয়োজন। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার উপর অকস্মাৎ দোষ চাপানোর আগে দেখা উচিত যে আমরা আইনের প্রতি কতটা যত্নবান। এ

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ