শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

শেয়ারবাজার মহাধসের ৯ বছরেও বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ থামেনি

* চলতি বছর ডিএসই মূলধন হারিয়েছে ৭৮ হাজার কোটি টাকা
* বাজার ছেড়েছে দুই লাখের বেশি বিনিয়োগকারী
মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান : দেশের শেয়ারবাজারে মহাধসের ৯ বছর পার হলেও সেই ক্ষত এখনো শুকায়নি। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানা ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলেও তার প্রভাব পড়েনি বাজারে। ফলে ২০১০ সালের ধসে পুঁজিহারা বিনিয়োগকারীরা এখনো আটকে আছেন লোকসানের বৃত্তে। বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ থামেনি। বিচারের আওতায় আনা হয়নি তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা অভিযুক্ত ব্যক্তিদেরও। ফলে কারসাজিকারীরা রয়ে গেছে এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। এর ফলশ্রুতিতে চলতি বছরেও পতনের ধারা থেকে বের হতে পারেনি শেয়ারবাজার। চলতি বছর ডিএসই মূলধন হারিয়েছে প্রায় ৭৮ হাজার কোটি টাকা। শেয়ারবাজার ছেড়েছে দুই লাখেরও বেশি বিনিয়োগকারী। চলতি বছরের নতুন ধসে ২৮ লাখের বেশি বিনিয়োগকারী পুঁজি হারিয়েছেন। সরকারের কোনো উদ্যোগই শেয়ারবাজার ভালো করতে পারেনি। ফলে চলতি বছরের প্রায় পুরো সময়টা ধরে পতনের মধ্যে হাবুডুবু খেয়েছে বাজার। আর বছরজুড়েই পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীদের আর্তনাদ করতে হয়েছে।
জানা গেছে, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির তদন্তে গঠিত কোনো তদন্ত প্রতিবেদন আলোর মুখ দেখেনি। ২০১০ সালে ঘটা শেয়ার কেলেঙ্কারির ঘটনা তদন্তে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি দোষীদের সনাক্ত করে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে কিন্তু সে প্রতিবেদন আজও প্রকাশ করেনি সরকার। থলের বিড়াল বেরিয়ে আসার শঙ্কা ও জনরোষের ভয়ে তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হচ্ছে না বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, দুর্নীতিবাজদের শাস্তি না হওয়ায় একের পর এক আর্থিক দুর্ঘটনা ঘটেই চলেছে। সরকার তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ না করায় সরকারের নিজেদের লোক জড়িত থাকার সন্দেহ জনগণের মনে দানা বেঁধেছে।
জানা গেছে, দেশের শেয়ারবাজারে দু’বার মহা ধসের ঘটনা ঘটেছে। আর এ দুবারই ঘটেছে বর্তমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে। একটি হলো ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ প্রথম যখন ক্ষমতায় আসে। আর দ্বিতীয়টিও বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার এক বছর পর ২০১০ সালে।  শেয়ারকারসাজির মাধ্যমে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিকট থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়া হয়েছে। এতে পুঁজি হারিয়ে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী পথে বসেছে।
টাকা হারানোর যন্ত্রণা সইতে না পেরে অনেক বিনিয়োগকারী আত্মহত্যা করে। সেই দুর্বিষহ স্মৃতি আর ঋণগ্রস্ত হয়ে এখনো অস্বাভাবিক জীবন যাপন করছেন অনেক বিনিয়োগকারী। বিনিয়োগকারী ও সাধারণ মানুষের অবিশ্বাস, আস্থাহীনতা ও পুঁজি হারানোর ভয়ের কারণে আজও মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি শেয়ারবাজার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক গতিতে বাড়াতে থাকে এবং ২০০৯ এর মাঝামাঝি সময়ে ঐ বছরের সবচেয়ে বেশি দাম বাড়ে। ২০১০ সাল জুড়েই মার্কেট অস্থিতিশীল ছিল, ১৩ ডিসেম্বরে শেয়ার বাজারের সূচক ২৮৫ পয়েন্ট কমে ৮,৫০০ তে দাড়ায়। আবার ১৯৯৬ সালের ১৯ ডিসেম্বরের পর সবচেয়ে বেশি ধস নামে এবং একদিনেই আরো ৫৫১ পয়েন্ট কমে শেয়ার বাজারের ৫৫ বছরের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি দর পতনের ঘটনা ঘটে।
বাংলাদেশের পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ লুটপাট ও ন্যাক্কারজনক ঘটনার বিচারের দাবিতে ফুঁসে ওঠে লাখ লাখ বিনিয়োগকারীসহ সর্বস্তরের জনগণ। দোষীদের শাস্তির দাবিতে আন্দোলন চলতে থাকে। সরকারের পক্ষ থেকে দোষীদের চিহ্নিত করে শাস্তির আশ্বাস দেয়া হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর খন্দকার ইব্রাহিম খালেদকে প্রধান করে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি ঘটনার সাথে জড়িত দোষীদের শাস্তির সুপারিশ করে সরকারের কাছে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করে।
খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে গঠিত শেয়ারবাজার-বিষয়ক তদন্ত কমিটি ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল সরকারের কাছে প্রতিবেদন জমা দিয়ে গণমাধ্যমকে বলেন, শেয়ারবাজারে রাজনৈতিক ব্যক্তিরা জড়িত থাকলেও তাঁরা মূলত ব্যবসায়ী। বাজারকেন্দ্রিক বড় অঙ্ক হাতিয়ে নিতেই তাঁরা বিভিন্ন ধরনের কারসাজি করেছেন। প্রতিবেদননে বলা হয়, অভিনব কৌশল, নতুন উদ্ভাবনী ও লোভের ফাঁদ তৈরি করে শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি ঘটনা ঘটানো হয়েছে। নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটি এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) সঙ্গে যোগসাজশে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) ও চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জ (সিএসই) সারা দেশে বাজারের বিস্তৃতি ঘটিয়েছে। রোড শো ও গণমাধ্যমে আহ্বান জানিয়ে সাধারণ মানুষের কাছে শেয়ারের দৈনন্দিন কেনাবেচাকে লোভনীয় করা হয়েছে। এসইসির শীর্ষ কর্মকর্তা, ডিএসই/সিএসইর সদস্য, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তা, বিশিষ্টজনদের এই প্লেসমেন্ট শেয়ার দিয়ে শুধু সিন্ডিকেট শক্তিশালী করা হয়নি, সমাজের উচ্চস্তরকে দুর্নীতির জীবাণু দ্বারা সংক্রমিতও করানো হয়েছে। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের রাজনৈতিক অঙ্গীকার ছাড়া এই দুষ্টচক্র ভেদ করে পুঁজিবাজারে সুস্থতা আনা সম্ভব হবে না। উল্লেখ্য, ১৯৯৬ সালে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সময় একইভাবে শেয়ার বাজারে দস্যুতার মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিলেও তার কোনো বিচার হয়নি। উপরন্তু ২০১৭ সালে বেক্সিমকো গ্রুপের চেয়ারম্যান এ এস এফ রহমান এবং ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমানদের বিরুদ্ধে ১৯৯৬ সালের শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারির আলোচিত দুই মামলা বাতিল করা হয়েছে। এ দুই মামলায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেক্সিমকো ফার্মা ও শাইনপুকুর হোল্ডিংস, ব্যক্তি হিসেবে এ এস এফ রহমান, সালমান এফ রহমান ছাড়াও এ বি সিদ্দিকুর রহমান ও ডি এইচ খান (মৃত) আসামী ছিলেন। সালমান এফ রহমান বর্তমানে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়নবিষয়ক উপদেষ্টার দায়িত্বে রয়েছেন।
ওই তদন্ত কমিটির প্রধান খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনে যে সব সুপারিশ করা হয়েছিল, তার সব কটি না হলেও বেশ কয়েকটি আংশিকভাবে বাস্তবায়ন করা হয়েছে। স্টক এক্সচেঞ্জে ডিমিউচুয়ালাইজেশন হলেও সেটি যথার্থভাবে হয়নি বলে তাঁর মত। তিনি বলেন, ‘ডিমিউচুয়ালাইজেশনের পরও স্টক এক্সচেঞ্জে ইন্ডিপেনডেন্ট ডিরেক্টর ৬০ শতাংশ। বাকি ৪০ শতাংশ পুরোনোদের মধ্য থেকেই করা হয়েছে। ফলে বাজারে এখনো এর প্রভাব রয়ে গেছে।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূত্রে জানা যায়, ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর দেশের ইতিহাসে ডিএসই সাধারণ সূচক সর্বোচ্চ স্থানে পৌঁছে। ওই দিন লেনদেন শেষে ডিএসই সূচক দাঁড়ায় ৮ হাজার ৯১৮ পয়েন্টে। সেই সঙ্গে ওই দিন মোট লেনদেনকৃত শেয়ারের সংখ্যা, বাজার মূলধন ও মোট লেনদেনের পরিমাণও সর্বোচ্চ অবস্থানে পৌঁছে। কিন্তু এর পরদিন অর্থাৎ ৬ ডিসেম্বর থেকেই শুরু হয় পতন। কয়েক দিনের ব্যবধানেই যা মহাধসে পরিণত হয়।
পুঁজিবাজারের ওই ধসে লোকসানের মুখে পড়েন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। সে সময় পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব কয়েকজন বিনিয়োগকারীর আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটে। পুঁজিবাজারে সূচকের পতনের পর ফুঁসে ওঠেন বিনিয়োগকারীরা। প্রায় প্রতিদিনই রণক্ষেত্রে পরিণত হতে থাকে পুরো মতিঝিল এলাকা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ও মামলা-মোকদ্দমার ঘটনাও ঘটে। যার রেশ এখনো অনেক বিনিয়োগকারীকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।
বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশীদ চৌধুরী বলেন, ধসের পর নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের অবস্থা ছয় বছরেও কোনো পরিবর্তন হয়নি। বিনিয়োগকারীদের দেখার কেউ নেই। বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) লক্ষ্য স্থির করে বিনিয়োগকারীদের জন্য কিছু করতে পারেনি বলেই আস্থা ফিরে পাননি বিনিয়োগকারীরা।
এ সংগঠনের অপর নেতা আলমগীর হোসেন বলেন, ২০১০ সালের ৬ ডিসেম্বর থেকে পুঁজিবাজারে যে ধস শুরু হয়েছিল, ৩৩ লাখ বিনিয়োগকারীর পরিবার এখনো সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছে। নিঃস্ব বিনিয়োগকারীদের রক্ষায় পুঁজিবাজার সুসংগঠিত করতে সরকারের সহায়তাও কামনা করেন তিনি।
এদিকে চলতি বছর শেয়ারবাজার টেনে তুলতে সরকারের নীতিনির্ধারকরা বেশ দৌড়ঝাঁপ করেছেন। দেয়া হয়েছে একের পর এক ছাড়। কিন্তু কোনো কিছুই টেনে তুলতে পারেনি বাজার। দিন যত যাচ্ছে বাজার ততই তলানিতে ঠেকেছে। অব্যাহত দরপতন আর তারল্য সংকটে বিনিয়োগকারীদের আস্থাও তলানিতে পৌঁছেছে।
তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে দেশের পুঁজিবাজার বেশ ইতিবাচক ছিল। এক মাসের মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স প্রায় ৬০০ পয়েন্ট বেড়ে যায়। বছরের শুরুতে পাঁচ হাজার ৩৮৫ পয়েন্ট নিয়ে যাত্রা শুরু করা ডিএসইএক্স দেখতে দেখতে ২৪ জানুয়ারি পাঁচ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে পৌঁছে যায়। মাস না ঘুরতেই ঊর্ধ্বমুখী বাজারে হঠাৎ করে নেমে আসে পতনের প্রবণতা। দিন যত গড়াতে থাকে পতনের মাত্রা তত বাড়তে থাকে। ফলে ২০১০ সালের পর আবারও মতিঝিলের রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ শুরু করেন পুঁজি হারানো বিনিয়োগকারীরা। দিনের পর দিন রাস্তায় নেমে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেও কোনো ফল না হওয়ায় পুঁজিবাজারের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রতীকী গণঅনশন করেন তারা। এরপরও অবস্থার উন্নতি না হলে বিনিয়োগকারীদের একটি অংশ প্রধানমন্ত্রী বরাবর স্মারকলিপি দেন।
পতনের মাত্রা ভয়াবহ রূপ নিলে গত সেপ্টেম্বরে পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে বৈঠকে বসেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। এরপর সুদিন ফেরাতে নেয়া হয় বেশকিছু ভালো পদক্ষেপ। অবশ্য তার আগেই ২০১৯-২০ অর্থবছরের বাজেটে বোনাস শেয়ার নিরুৎসাহিতের জন্য নগদ লভ্যাংশ থেকে অতিমাত্রায় বোনাস শেয়ার ইস্যু হলে তার ওপর কর আরোপের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সেই সঙ্গে করমুক্ত লভ্যাংশের সীমা ২৫ হাজার টাকা থেকে বাড়িয়ে ৫০ হাজার টাকা করা হয়।
২০১৯ সালে পুঁজিবাজারের জন্য নেয়া ভালো সিদ্ধান্তগুলোর মধ্যে রয়েছে- নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) থেকে শেয়ারের লক ইন প্রিয়ড বাড়িয়ে লেনদেন শুরুর দিন থেকে নির্ধারণ করা। প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে এ সীমা বাড়িয়ে নয় মাস এবং প্লেসমেন্ট শেয়ারের ক্ষেত্রে দুই বছর করা। পাশাপাশি পূর্ব ঘোষণা ছাড়া স্পন্সর শেয়ারহোল্ডারদের শেয়ার বিক্রির প্রবণতা বন্ধ করা এবং নতুন একটি ব্লক মডিউল দেয়া।
বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের দাবি মেনে ব্যাংকের তালিকাবহির্ভূত কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা অর্থ এক্সপোজারের হিসাব থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। এতে শুধু তালিকাভুক্ত কোম্পানিতে ব্যাংকের বিনিয়োগ এক্সপোজারে থাকবে। ফলে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের নতুন করে বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি হয়েছে। এছাড়া বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ না থাকলে ব্যাংক ৬ শতাংশ মুনাফায় ছয় মাস মেয়াদী রেপোর মাধ্যমে অর্থ পাবে- এমন সুযোগও দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক।
অবশ্য এসব সুবিধা দেয়া হলেও বাজার পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। বরং পতনের মধ্যেই রয়েছে বাজার। এ পরিস্থিতিতে পুঁজিবাজারে বিনিয়োগের জন্য সরকারের কাছে ১০ হাজার কোটি টাকার বিশেষ তহবিল চান পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্টরা। ৩ শতাংশ সুদে ছয় বছরের জন্য মার্চেন্ট ব্যাংক ও ব্রোকারেজ হাউজকে এ তহবিল থেকে টাকা দেয়ার দাবি জানানো হয়। পুঁজিবাজার-সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর এ দাবির পক্ষে রয়েছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। তবে সরকারের পক্ষ থেকে এ বিষয়ে এখনও (১২ ডিসেম্বর) কোনো সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
বিনিয়োগকারী আশরাফুল বলেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে বাজারের অবস্থা বেশ ভালো ছিল। বাজার যেভাবে ছুটছিল তাতে মনে হচ্ছিল, হারানো পুঁজি আবার ফিরে পাব। কিন্তু বাস্তবে ঘটল উল্টো। নতুন বিনিয়োগেও ধরা খেলাম। জানুয়ারি মাস বাদে পুরো বছর দরপতন হয়েছে। এতে লোকসানের মাত্রা নতুন করে বেড়েছে। তিনি বলেন, বাজার ভালো করতে কত পদক্ষেপ নেয়া হলো, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। আমার মতো সাধারণ বিনিয়োগকারীরা প্রতিনিয়ত পুঁজি হারাচ্ছে। অন্যদিকে পুঁজিবাজারের কল্যাণে ব্যাংক-আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক ছাড় পাচ্ছে। কিন্তু তারা তো বাজারে সক্রিয় হচ্ছে না।
ডিএসইর পরিচালক রকিবুর রহমান বলেন, সবাইকে ধৈর্য ধরতে হবে। কেউ যেন হতাশ না হন। আমরা সবাই যদি নিজের জায়গা থেকে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার মধ্য থেকে কাজ করি তাহলে অবশ্যই বাজার ভালো হবে। কীভাবে বাজারের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো যায়, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক বেশ পজেটিভ। তবে বাজার শক্তিশালী করতে হলে গুণগত পরিবর্তন আনতে হবে। বন্ড মার্কেট লেনদেনের আওতায় আনতে হবে। সেই সঙ্গে শক্তিশালী মিউচ্যুয়াল ফান্ড আনতে হবে।
ডিএসই ব্রোকারস অ্যাসোসিয়েশনের (ডিবিএ) সভাপতি শাকিল রিজভী বলেন, পুঁজিবাজারে উত্থান-পতন হবে, এটাই স্বাভাবিক। আমার মতে, বর্তমান বাজার কেনার জন্য বেশ ভালো। অনেক ভালো কোম্পানির শেয়ারের দাম রিজেনেবল প্রাইসে রয়েছে। তবে কোম্পানির পারফরমেন্স বাজারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে কোম্পানির প্রথম প্রান্তিক বা বার্ষিক পারফরমেন্স বিবেচনা করলে বেশির ভাগ কোম্পানির শেয়ার কেনার উপযোগী। আমার ধারণা, ডিসেম্বর মাসে হয়তো বাজার কিছুটা চাপের মধ্যে থাকবে। তবে জানুয়ারি থেকে ভালো হবে।
বাজার মূলধন: ডিএসইর ২০১৯ সাল শুরু হয় তিন লাখ ৮৭ হাজার ২৯৫ কোটি টাকা বাজার মূলধন নিয়ে। বছরের শুরুতে ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেয়ায় তা ২৯ জানুয়ারি বেড়ে দাঁড়ায় চার লাখ ২১ হাজার ৫৮১ কোটি টাকায়। অর্থাৎ এক মাসে ডিএসইর বাজার মূলধন বাড়ে ৩৪ হাজার ২৮৬ কোটি টাকা। বছরের শুরুতে বাজার মূলধনের এমন উত্থান হলেও ১২ ডিসেম্বর শেষে তা তিন লাখ ৪৩ হাজার ৬৯৭ কোটি টাকায় নেমে আসে। এ হিসাবে ২৯ জানুয়ারি থেকে ১২ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৭৭ হাজার ৮৮৪ কোটি টাকার বাজার মূলধন হারিয়েছে ডিএসই।
সূচক: বছরের শুরুতে ডিএসইর প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ছিল পাঁচ হাজার ৩৮৫ পয়েন্টে। টানা উত্থানে ২৪ জানুয়ারি তা বেড়ে দাঁড়ায় পাঁচ হাজার ৯৫০ পয়েন্টে। অর্থাৎ এক মাসেরও কম সময়ে সূচকটি বাড়ে ৫৬৫ পয়েন্ট। এরপর থেকেই ধুঁকতে থাকায় ১২ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে ডিএসইএক্স চার হাজার ৫১৪ পয়েন্টে নেমে আসে। এ হিসাবে ২৪ জানুয়ারি থেকে ১২ ডিসেম্বরের মধ্যে সূচকটি কমেছে এক হাজার ৪৩৬ পয়েন্ট।
বিও হিসাব: ২৭ লাখ ৭৯ হাজার ৭৯১টি বিও হিসাব নিয়ে শুরু হয় ২০১৯ সাল। ১২ ডিসেম্বর শেষে বিও হিসাবের সংখ্যা দাঁড়ায় ২৫ লাখ ৬৪ হাজার ৯৮৬টি। সে হিসাবে বছরটিতে বিও হিসাবের সংখ্যা কমেছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৮০৫টি। অর্থাৎ ২০১৯ সালে দুই লাখের ওপর বিনিয়োগকারী বাজার ছেড়েছেন।
বিদেশী বিনিয়োগ: পুঁজিবাজারের ইতিহাসে ২০১৯ সালে বিদেশিদের শেয়ার বিক্রির চাপ ছিল সবচেয়ে বেশি। টানা নয় মাস (মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত) বিদেশিরা শেয়ার ক্রয় থেকে বিক্রি বেশি করেছেন। এর আগে কখনও বিদেশিরা শেয়ার বিক্রির এমন চাপ অব্যাহত রাখেনি।
ব্যাংকের শেয়ার: পুঁজিবাজারের প্রাণ হিসেবে বিবেচনা করা হয় ব্যাংক খাত-কে। তবে ২০১০ সালের ধস এবং ব্যাংক কেলেঙ্কারি ফাঁসের পর [বাজারে ব্যাংকের প্রভাব কমে একেবারে তালানিতে গিয়ে ঠেকে। গত ১২ ডিসেম্বর লেনদেন শেষে ডিএসইতে তালিকাভুক্ত ৩০টি ব্যাংকের মধ্যে সাতটির শেয়ারের দাম অভিহিত মূল্যের (১০ টাকা) নিচে রয়েছে। এছাড়া আরও সাতটির শেয়ারের দাম ১৫ টাকার নিচে রয়েছে।
বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পুঁজিবাজারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষভাবে প্রায় কোটি মানুষ জড়িত। এই মানুষগুলোর ভোটের স্বার্থে হলেও বাজার ভালো করা জরুরি। তারা বলছেন, চলতি বছরের শুরুতেই পুঁজিবাজারে ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত বিনিয়োগের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংকের নজরদারি বৃদ্ধি ইস্যুকে কেন্দ্র করে বাজারে দরপতন শুরু হয়। এরপর ডিএসই’র কৌশলগত বিনিয়োগকারী হিসেবে চীনা কনসোর্টিয়ামের প্রস্তাব চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়াকে কেন্দ্র করে ফের দরপতন শুরু হয়। যার গ্রাস থেকে এখনো বের হতে পারেনি পুঁজিবাজার।
সার্বিক বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, এখন পুঁজিবাজারে বড় সমস্যা তারল্য সংকট। ব্যাংক খাতের খারাপ অবস্থার কারণে পুঁজিবাজারেও আস্থার ঘাটতি রয়েছে। পাশাপাশি বাজারে কারসাজি, সিরিয়াল ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে পুঁজিবাজারে অসুস্থ পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। এই অবস্থা থেকে উত্তোলনে নিয়ন্ত্রক সংস্থা, স্টক এক্সচেঞ্জের ভূমিকা বেশি। পুঁজিবাজারে কোনো জবাবদিহিতা নেই, বিচার নেই। যে যার মতো কারসাজি করে চলছেন। পৃথিবীর কোনো দেশের বাজারেই ম্যানুপোলেশন করে পার পাওয়া যায় না। আর আমাদের বাজারে যারা সিরিয়াল ট্রেডিংয়ে সঙ্গে জড়িত নিয়ন্ত্রক সংস্থার তাদের উল্টো পুরস্কৃত করে। এটা কোনো সুস্থ বাজারে হতে পারে না।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ