শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

রোহিঙ্গাদের সুশাসন নিশ্চিত করতে ১৩ দফা সুপারিশ টিআইবি’র

 

স্টাফ রিপোর্টার: রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দেয়ার ক্ষেত্রে জাতিসংঘের কাজের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। একই সঙ্গে এ কাজে সংস্থাটির স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এসময় রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থানের সময়ে সুশাসন নিশ্চিত করার জন্য ১৩ দফা সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।

গতকাল বৃহস্পতিবার টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান ‘বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের (রোহিঙ্গা) নাগরিকদের বাংলাদেশে অবস্থান: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে বিষয়টি তুলে ধরেন।

টিআইবিকে জাতিসংঘের কয়েকটি সংস্থার দেওয়া তথ্যে দেখা গেছে, প্রশাসনিক কাজে ইউএন উইমেন খরচের হার সবচেয়ে বেশি। এই হার হচ্ছে ৩২ দশমিক ৬ শতাংশ। আর জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) খরচ করে ৩ শতাংশ, যা সবচেয়ে কম।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, এ তথ্যগুলো আমরা বহুবার চেষ্টা করার পর তাদের কয়েকটি সংস্থার কাছ থেকে পেয়েছি। যেটি তারা বলছে নিজেদের পরিচালন ব্যয়। তারা কিন্তু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে না। তারা কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে সহযোগী সংস্থার মাধ্যমে। সেই সহযোগী সংস্থার পরিচালন ব্যয় তাদের কর্মসূচি ব্যয়ের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। যার ফলে এখানে খরচ (কর্মসূচি ব্যয়) দুবার দেখানো হচ্ছে। যার মধ্যে পরিচালন ব্যয় অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। সত্যিকার অর্থে পরিচালন ব্যয় কতটুকু আর সহায়তা বাবদ ব্যয় কতটুকু, তা একমাত্র সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোই বলতে পারবে। এটি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হয়নি। সম্ভব হবেও না। কারণ, এ ধরনের তথ্য তারা প্রকাশ করতে চায় না। দিতে চায় না।

জাতিসংঘ নিজেদের কাজে কতটা স্বচ্ছতা রেখে চলে, জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, এটা ঠিক যে তারা আমাদের কাছে নিজেদের স্বচ্ছতা বজায়কারী সংস্থা হিসেবে প্রচার করে থাকে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে তাদের কাছ থেকে আমরা সেটার প্রমাণ দেখতে পাই না।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, জাতিসংঘের স্বচ্ছতার ঘাটতি পরিচালনা ব্যয়ে, তবে মানবিক সহায়তার ব্যয়ে তা নয়। এখানে একধরনের কায়েমি স্বার্থ জাতিসংঘের রয়েছে। এ ধরনের সংকট জাতিসংঘের জন্য নতুন নয়। যেখানে তাদের প্রতিরোধের ভূমিকায় যাওয়ার কথা, তারা সেখানে ব্যর্থতার পরিচয় দেয়। এ ক্ষেত্রে তাই হয়েছে।

 তিনি বলেন, আমাদের জানামতে, জাতিসংঘের মিয়ানমারের কার্যালয়ের একটি নিজস্ব প্রতিবেদনে জাতিগত নিধনের ঘটনার আগে তাদের হাতে সুনির্দিষ্ট তথ্য ছিল। যেটি তাদের নিজেদের দাতাদের করা প্রতিবেদন। সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে কী ঘটতে যাচ্ছে, সময়সীমাসহ গ্রাফিক উপস্থাপনা ছিল এবং তাতে জাতিসংঘের কাছে নির্দেশনা ছিল। পরামর্শ ছিল। সেই প্রতিবেদন কখনো আলোর মুখ দেখেনি। কাজেই তাদের ভূমিকাও কিন্তু বেশ প্রশ্নবিদ্ধ।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক বলেন, বিষয়টি যখন আন্তর্জাতিক আদালতে গেছে, সেখানে সত্যিকার অর্থেই যে দাতাদের কাছ থেকে আমরা ন্যায়বিচার চাই। যারা জাতিগত নিধনের জন্য দায়ী, তাদের যেমন জবাবদিহির আওতায় আনা উচিত, তেমনি যারা নিধন ঘটাতে যাচ্ছে দেখে পর্যাপ্ত ব্যবস্থা নেয়নি, তাদেরও বিচারের আওতায় আনা উচিত বলে আমরা মনে করি।

বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তার ক্ষেত্রে ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করতে এ বছরের ১৩ জুলাই থেকে ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত গবেষণা চালানো হয়। গবেষণাটির সুনির্দিষ্ট উদ্দেশ্য হলো রোহিঙ্গাদের জন্য গৃহীত উদ্যোগ এবং এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের কার্যক্রম ও সমন্বয় ব্যবস্থার পর্যালোচনা করা, রোহিঙ্গাদের ত্রাণ ব্যবস্থাপনায় বিদ্যমান সুশাসনের চ্যালেঞ্জ নিরূপণের পাশাপাশি অনিয়ম ও দুর্নীতি চিহ্নিত করা এবং সার্বিক ব্যবস্থাপনায় সুশাসনের চ্যালেঞ্জ থেকে উত্তরণের উপায় সুপারিশ করা। এই গবেষণায় রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় সংশ্লিষ্ট অংশীজনের কার্যক্রম পর্যালোচনার পাশাপাশি মানবিক সহায়তায়, বিশেষত খাদ্য ও পুষ্টি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পানি সরবরাহ ও স্যানিটেশন, সুরক্ষা ও নিরাপত্তা পর্যালোচনা করা হয়েছে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে অবস্থান এবং তাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ায় সৃষ্ট ঝুঁকির ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত প্রভাবের পাশাপাশি রাজনৈতিক ঝুঁকি ও নিরাপত্তা পর্যালোচনা করা হয়েছে।

গবেষণায় দেখা যায়, রোহিঙ্গা ব্যবস্থাপনায় ব্যাপক নিরাপত্তাজনিত ঝুঁকি বিদ্যমান। ৩৪টি ক্যাম্পের মধ্যে দুটি নিবন্ধিত ক্যাম্প ব্যতীত বাকিগুলোতে সিআইসির অধীনে নিরাপত্তাকর্মী নেই। নিরাপত্তার ঘাটতির কারণে সিআইসিরা রাতের বেলা এসব ক্যাম্পে অবস্থান করেন না। বিভিন্ন ক্যাম্পে কমপক্ষে সাতটি সন্ত্রাসী গ্রুপের কার্যক্রম পরিচালনার অভিযোগ রয়েছে। 

দালাল চক্রের সহায়তায় প্রাথমিকভাবে দালালদের ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা এবং নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছানোর পর দেড় থেকে দুই লাখ টাকার বিনিময়ে ক্যাম্পভিত্তিক রোহিঙ্গাদের পাচারের অভিযোগ রয়েছে। অন্যদিকে, ক্যাম্পে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের মধ্যে আর্থিকভাবে সচ্ছলদের একাংশকে স্থানীয় রাজনৈতিক ছত্রচ্ছায়ায় মোটা অঙ্কের অর্থের বিনিময়ে স্থানীয় জনগণের সঙ্গে মূল স্রোতে মেশার সুযোগ করে দেওয়া এবং তাদের স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থ হাসিলে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণায় সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন অংশীজন কর্তৃক নানা ধরনের অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য উঠে এসেছে। এনজিও অ্যাফেয়ার্স ব্যুরোর কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক প্রকল্প অনুমোদনে (এফডি-৭) দীর্ঘসূত্রতা এবং অনুমোদন প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করতে নিয়মবহির্ভূত অর্থ ও উপঢৌকন দাবির অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয় –সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের একাংশের কাছ থেকে প্রকল্প কার্যক্রম শুরুর অনুমোদন পেতে কমপক্ষে ৭ থেকে ১৫ দিন এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক মাসের অধিক সময়ক্ষেপণের অভিযোগ পাওয়া যায়। 

উপজেলা ও জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের একাংশের কাছ থেকে প্রকল্প সমাপ্তির ছাড়পত্র সংগ্রহে যথাক্রমে প্রকল্প প্রতি নিয়মবহির্ভূতভাবে ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা ও ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা আদায় করা হয়। ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ভিন্ন ভিন্ন যাচাইব্যবস্থার কারণে সমন্বয়ের ঘাটতি এবং অনিয়ম, দুর্নীতিসহ সময়ক্ষেপণের অভিযোগ রয়েছে। জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কমিটির কর্মকর্তাদের একাংশ কর্তৃক নিয়মিত এবং বিশেষ ত্রাণের মান ও পরিমাণ যাচাইয়ে ত্রাণের মালবাহী গাড়িপ্রতি নিয়মবহির্ভূতভাবে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আদায় করে এবং না দিলে ৫ থেকে ১৫ দিন সময় ক্ষেপণ করে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিআইসিদের একাংশ এনজিওদের কার্যক্রম তদারকিতে বিশেষত কমিউনিটি মোবিলাইজেশন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণে প্রতি কর্মসূচি বাবদ নিয়মবহির্ভূতভাবে দুই হাজার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আদায় করে বলে অভিযোগ রয়েছে।

গবেষণা অনুযায়ী, ক্যাম্প পর্যায়ে এফডি-৭ এবং জাতিসংঘের অনুদানে কার্যক্রম পরিচালনায় স্থানীয়, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক এনজিওগুলোর একাংশের বিরুদ্ধে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ পাওয়া গেছে।

বাংলাদেশ সরকার রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে সামর্থ্য অনুযায়ী কূটনৈতিক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে ইফতেখারুজ্জামান বলেন, মিয়ানমারের একগুঁয়েমি এবং ভারত, চীন, জাপানের মতো শক্তিশালী দেশগুলোর কৌশলগত সমর্থনের ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে প্রতিবন্ধকতা অব্যাহত রাখতে মিয়ানমার অনড়। তাই এটি সরকারের কূটনৈতিক ব্যর্থতা নয়, কূটনৈতিক সীমাবদ্ধতা।

রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমন্বয় ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতে এবং রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে ১৩ দফা সুপারিশ করেছে টিআইবি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ