শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ‘পাকিস্তান জেতে না’

মোহাম্মদ জাফর ইকবাল : ১৯৫৬ সাল থেকে পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে কখনই সিরিজ জিততে পারেনি। যে তিনটি মাত্র টেস্ট জিতেছে তার সর্বশেষটি ২৪ বছর আগে, সেই ১৯৯৫ সালে। দীর্ঘ দুই যুগের ব্যর্থতা ঘোঁচাতে এবার বাজি ধরেছিলেন বর্তমান কোচ মিসবাহ উল হক। গ্যাবায় (ব্রিসবেন) শুরু হতে যাওয়া দুই ম্যাচ সিরিজের প্রথম টেস্টের আগে এমন হুমকি দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু শেস পর্যন্ত হোয়াইটওয়াশই হতে হলো সফরকারীদের। ঘরের মাটিতে শ্রীলঙ্কার কাছে টি২০ সিরিজে শ্রীলঙ্কার কাছে হোয়াইটওয়াশের পর অস্ট্রেলিয়া সফরেও বিধ্বস্ত বাবর আজমের দল। সরফরাজ আহমেদ বাদ পড়ায় এই সিরিজে টেস্টে প্রত্যাবর্তনে অধিনায়কের দায়িত্ব আজহারের কাঁধে ছিল। একই সঙ্গে প্রধান নির্বাচক এবং প্রধান কোচের দায়িত্ব পাওয়ার পর মিসবাহর অধীনে ছিল প্রথম টেস্ট সিরিজ।
টেস্ট সিরিজ শুরুর আগে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছে পাকিস্তান। ‘আমরা অবশ্যই জয়ের জন্যই খেলার চিন্তা করছি। বলেন টেস্ট অধিনায়ক আজহার। আইসিসি টেস্ট র‌্যাঙ্কিংয়ে অস্ট্রেলিয়া পাঁচ ও পাকিস্তান সাত নম্বরে। বিশ্বকাপের পর ইংল্যান্ডের মাটিতে নিজেদের টেস্ট ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সিরিজ ড্র করে টিম পেইনের অস্ট্রেলিয়া। দুর্দান্ত ব্যাটিং করেন নিষেধাজ্ঞা কাটিয়ে ফেরা স্টিভেন স্মিথ। তাকে থামাতে বিশেষ পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিলেন পাকিস্তান কোচ মিসবাহ। তার মনে রাখা দরকার ছিল, স্বাগতিক দলে ছিল ডেভিড ওয়ার্নার, ক্যামেরন ব্যানক্রফট, ম্যাথু ওয়েড। ছিল কামিন্স, স্টার্ক, প্যাটিনসনদের নিয়ে পেস বোলিং ভয়ঙ্কর। অন্যদিকে ব্যাটিংয়ে সফরকারীদের ভরসা ছিল ইনফর্ম বাবর আজম, টেস্ট স্পেশালিস্ট আসাদ শফিক, ওপেনার ইমাম উল হকের উপর। মোহাম্মদ আব্বাস, ইমরান খান, শাহিন আফ্রিদির সঙ্গে আলোচিত তরুণ নাসিমকে নিয়ে পাকিস্তানীদের পেস আক্রমণও মন্দ ছিলনা। কিন্তু স্বাগতিকদের কাছে পাত্তাই পায়নি সফরকারী পাকিস্তান।
বলা হয় অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ‘পাকিস্তান জেতে না’। সেটা কিন্তু এমনিতে নয়। ব্রিসবেনে ইনিংস ও ৫ রানের পর এ্যাডিলেডে ডে-নাইট টেস্টে আজহার আলিদের হার ইনিংস ও ৪৮ রানে। হোয়াইটওয়াশের পথে লজ্জার হারের সঙ্গে সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ায় নিজেদের কলঙ্কিত ইতিহাসটাকে আরও দীর্ঘ করল আনপ্রেডিক্টেবল পাকিস্তনীরা। এ নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় টানা ১৪ টেস্টে হারল পাকিস্তান। গড়ল লজ্জার বিশ্বরেকর্ড! ম্যাচের নায়ক ডেভিড ওয়ার্নারের (৩৩৫*) ম্যারাথন ট্রিপল সেঞ্চুরি ও মার্নাস লাবুশেনের (১৬২) সেঞ্চুরির সৌজন্যে ৩ উইকেটে ৫৮৯ রানের পাহাড় গড়ে প্রথম ইনিংস ঘোষণা করে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। জবাবে ‘বোলার’ ইয়াসির শাহর (১১৩) চমকে দেয়া সেঞ্চুরি সত্ত্বেও ৩০২ রানের অলআউট পাকিস্তান ফলোঅনে পড়ে দ্বিতীয় ইনিংসে গুটিয়ে যায় ২৩৯-এ। অফস্পিনার নাথান লেয়ন নিয়েছেন ৫ উইকেট। তিন ম্যাচের টি২০ ২-০ ব্যবধানে হারের পর হোয়াইটওয়াশের চরম লজ্জায় ওয়ার্ল্ড টেস্ট চ্যাম্পিনশিপ শুরু করল পাকিস্তান। ফলোঅনে পড়ে ৩ উইকেটে ৩৯ রান নিয়ে সোমবার চতুর্থদিনে ৬৬ ওভারে ২০০ রান করতে অলআউট হয়ে যায়। ওপেনার শান মাসুদ ৬৮, আসাদ শফিক ৫৭, মোহাম্মদ রিজওয়ান ৪৫ রান করে আউট হন।
সর্বশেষ ১৯৯৫ সালে সিডনি টেস্টে স্বাগতিকদের হারিয়েছিল ওয়াসিম আকরামের দল। এরপর গত প্রায় ২০ বছরে অস্ট্রেলিয়া সফরে টেস্টে জয় নেই তাদের। পাকিস্তান এই নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় টানা ১৪ টেস্ট হারল। এর আগে ১৯৯৯, ২০০৪, ২০০৯, ২০১৬ সালে তিনটি করে টেস্টের সিরিজে হেরেছিল তারা। এবার দুই টেস্টে। অস্ট্রেলিয়ায় টানা এতগুলো টেস্টে এর আগে কোন দল হারেনি। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত ভারত টানা ৯ টেস্টে হেরেছিল। অস্ট্রেলিয়ার কাছে দশমবারের মতো ইনিংস ব্যবধানে হারের তিক্ত স্বাদ পেল পাকিস্তান। সবমিলিয়ে অস্ট্রেলিয়ার কাছে এটি তাদের ৩৩তম হার। এ জয়ে টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে নিজেদের জায়গা আরও শক্ত করল অস্ট্রেলিয়া। ৭ ম্যাচে সবকটিতে জিতে ভারতের পয়েন্ট ৩৬০। অস্ট্রেলিয়া ৪ জয় ও ২ হার ও ১ ড্রয়ে ১৭৬ পয়েন্ট নিয়ে রয়েছে দুইয়ে। অন্যদিকে ২ ম্যাচ খেলে মিসবাহ’র শিষ্যদের পয়েন্ট শূন্য। ঘরের মাঠে ১২ ডিসেম্বর থেকে নিউজিল্যান্ডকে আতিথেয়তা দেবে অস্ট্রেলিয়া। দুটি টেস্ট খেলবে তাসমান পাড়ের দুই দেশ। দ্বিতীয় টেস্টটি শুরু হবে বক্সিং ডে’তে। পাকিস্তানও ঘরের মাঠে আতিথেয়তা দেবে শ্রীলঙ্কাকে। সিংহের দলের বিপক্ষে দুটি টেস্ট খেলবে পাকিস্তান। টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে পাকিস্তানের শুরুটাও হলো বাজে। ওয়েস্ট ইন্ডিজ, দক্ষিণ আফ্রিকা ও বাংলাদেশের পর তারাও কোন ম্যাচে জিততে পারেনি। ক্যারিয়ারে ষোড়শবার ৫ উইকেটের স্বাদ পেয়েছেন স্পিনার নাথান লেয়ন। এ্যাডিলেইডে তার ৫০ উইকেটের বেশি আছে কেবল শেন ওয়ার্নের (৫৪টি)। দিনের নায়ক লেয়ন হলেও ম্যাচ ও সিরিজের নায়ক ডেভিড ওয়ার্নার। অপরাজিত ৩৫৫ রানের পথে ডন ব্র্যাডম্যান-রিকি পন্টিংদের ছাড়িয়ে রেকর্ডগড়া ট্রিপল সেঞ্চুরিতে হয়েছেন ম্যান অব দ্য ম্যাচ। এ্যাশেজে ১০ ইনিংসে ৯৫ রান করা ব্যাটসম্যান এই সিরিজে ২ ইনিংসেই করলেন ৪৮৯ রান। সিরিজের সেরাতেও তার ছিল না কোন প্রতিদ্বন্দ্বী।
এ্যাডিলেড থেকেই শুরু হয়েছিল দিবারাত্রির টেস্ট ম্যাচের যাত্রা। ২০১৫ সালের ২৭ নবেম্বর ইতিহাসের প্রথম দিবারাত্রির টেস্টে গোলাপি বলে খেলে স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড। অসিরা সেবার ৩ উইকেটে জয় দিয়ে শুরু করেছিল এবং তারপর থেকে গোলাপি বলে তাদের শুধু একচ্ছত্র দাপট দেখেছে বাকি দলগুলো।
৫টি দিবারাত্রির টেস্ট খেলে সবগুলোতেই জিতেছে তারা। এখন পর্যন্ত হয়েছে ১২টি দিবারাত্রির টেস্ট যার মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত ছিল সম্প্রতিই কলকাতার ইডেনে বাংলাদেশ-ভারত টেস্ট। কারণ সেটি ছিল উপমহাদেশে সর্বপ্রথম দিবারাত্রির টেস্ট ম্যাচ। সপ্তাহ না পেরোতেই অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে উপমহাদেশের দল পাকিস্তান স্বাগতিকদের বিপক্ষে এ্যাডিলেডে মুখোমুখি হয়েছে।  প্রথম টেস্টে ইনিংস ও ৫ রানে হেরে সিরিজ রক্ষার চেষ্টা ছিল সফরকারীদের। গোলাপি বলে কৃত্রিম আলোয় দুই ম্যাচের সিরিজ বাঁচানোর লড়াই ছিল তাদের। অবশ্য এর আগে ৩টি দিবারাত্রির টেস্ট খেলায় তাদের অভিজ্ঞতা ছিল। কিন্তু ঘরের মাটিতে দুর্বার অসিরা গোলাপি বলে আরও অপ্রতিরোধ্য হওয়াতে সফরকারী পাকিস্তানীরা যেন দাঁড়াতেই পারলোনা।
নিজেদের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া উপমহাদেশের দলগুলোর জন্য যে কতটা ভয়ঙ্কর প্রতিপক্ষ, যুগে যুগে ক্রিকেটবিশ্ব সেটি দেখে এসেছে। ইমরান খানের পাকিস্তান, কপিল দেবের ভারত কিংবা অর্জুনা রানাতুঙ্গার তুখোড় সেই শ্রীলঙ্কাÑ কখনই অস্ট্রেলিয়া সফরে গিয়ে সুবিধা করতে পারেনি। গত বছর বিরাট কোহলির সুপার ভারতের সর্বশেষ সাফল্যটি বাদ দিলে সেখানে এই অঞ্চলের দলগুলোর অতীত রেকর্ড বড় করুণ। শ্রীলঙ্কাকে টি২০-টেস্ট দুই ভার্সনে দুরমুশ করার পর পাকিস্তানকে নিয়েও খেললো অসিরা। ২-০তে টি২০ জিতেছে এ্যারন ফিঞ্চের দল। ব্রিসবেনে ইনিংস ও ৫ রানের দাপুটে জয়ে টেস্ট সিরিজ শুরু করে স্বাগতিকরা। সাদা পোশাকের অস্ট্রেলিয়ান অধিনায়ক টিম পেইন জানিয়েছেন এ্যাডিলেডে শুরু হতে যাওয়া সিরিজ নির্ধারণী দ্বিতীয় ও শেষ টেস্টে তার দল আরও নির্মম হবে। বিশেষ করে পেসাররা। অবশেষে তা-ই হয়েছে। প্রতিপক্ষকে এতটুকু ছাড় দেয়নি।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ