বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বইয়ের বোঝা আর শ্বাসরুদ্ধকর পরীক্ষায় শিশুদের নাভিশ্বাস

খুলনা অফিস : কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিয়ে শিক্ষা বাণিজ্য চলছেই। কিন্ডারগার্টেনগুলোতে এ প্রতিযোগিতা বেশি লক্ষণীয়। যে বয়সে খেলায় মেতে থাকার কথা সেই প্লে, নার্সারী, কেজি শ্রেণি থেকেই শিক্ষার্থীদের কাঁধে তুলে দেয়া হচ্ছে ডজন ডজন বইয়ের ভারী ব্যাগ। সরকারের পক্ষ থেকে বার বারই বলা হচ্ছে শিশুদের বইয়ের ব্যাগ থেকে ভারীত্ব কমানো হবে। কিন্তু এর বাস্তবায়ন নেই খুলনায়। প্রতিটি কিন্ডার গার্টেনেই প্লে থেকে দ্বিতীয় শ্রেণি পর্যন্ত পড়ানো হচ্ছে ১০/১২টি বই। সকালে ঘুম থেকে উঠেই শুরু হয় শিশুদের পড়াশুনা আর চলে গভীর রাত পর্যন্ত। খেলার জন্য নেই উপযুক্ত জায়গাও। যেসব কিন্ডার গার্টেন খুলনা শহরে গড়ে উঠেছে তার অধিকাংশ স্কুলেই নেই খেলার মাঠ। কিছু স্কুল আবার বাসা-বাড়িতে গড়ে উঠেছে। অধিক পড়াশুনার পাশাপাশি কিন্ডার গার্টেনগুলো ঘন ঘন পরীক্ষা বাণিজ্যের মাধ্যমে একদিকে যেমন শিশুদের অসম প্রতিযোগিতার দিকে ঠেলে দিচ্ছে তেমনি অভিভাবকদের কাছ থেকে হাতিয়ে নেয়া হচ্ছে মোটা অংকের অর্থ। অভিভাবকদের মধ্যেও চলছে নিজের সন্তানকে প্রথম হওয়ানোর প্রতিযোগিতা। এর মধ্যদিয়ে শিশুরা বেড়ে ওঠায় এর প্রভাব পড়ছে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে। সম্প্রতি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক একটি অনুষ্ঠানে বক্তৃতাকালে বলেন, ছোটবেলায় শিশুদের ওপর অধিক চাপ দেয়ার ফলে বিশ^বিদ্যালয় পর্যায়ে গিয়ে অন্তত শতকরা ২০ ভাগ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ছে অথবা সাইকোতে ভুগছে। অনেকে মাথা ব্যাথাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পড়াশুনায় মন বসেনা। মোবাইল-টেলিভিশনে আসক্ত হয়ে পড়ছে। সব মিলিয়ে একটি অসুস্থ জাতি গড়ে উঠছে এ ধরণের শিক্ষা বাণিজ্যের মধ্যদিয়ে।
খুলনার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, সিংহভাগ স্কুলেই খেলার মাঠ নেই। খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের একজন প্রফেসর বলেন, তার দু’টি সন্তান যে কিন্ডার গার্টেনটি থেকে পড়াশুনা করেছে সেখানেও কোন মাঠ নেই। অথচ সেই স্কুলটি গড়ে তোলা হয়েছে শুধুমাত্র কিন্ডার গার্টেনের জন্যই। অর্থাৎ এটিকে তিনি একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আখ্যা দেন। অধিকাংশ কিন্ডার গার্টেন স্কুলে প্রতি বছর চলে বই বাণিজ্য। একাধিক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থের বিনিময়ে স্কুল কর্তৃপক্ষকে ম্যানেজ করে তাদের প্রকাশিত বই পুশ করা হয়। এর ফলে ওই বইটির মান যাই থাকুক না কেন ওই স্কুল সেটিকে পাঠ্যসূচীতে অন্তর্ভুক্ত করে। আর শিক্ষার্থীরা ওইসব বাড়তি বই পড়ে শিক্ষা নামক বোঝা তাদের মাথায় নিতে বাধ্য হচ্ছে। আবার স্কুলগুলোতে প্রথম শ্রেণিতে বসেই দ্বিতীয় শ্রেণির বই পড়ানো হয়। যা বয়সের তুলনায় ধারণ ক্ষমতা থাকে না অনেকের। শিক্ষা উপকরণও নেই অনেক স্কুলে।
শুধুমাত্র মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে ঠেলে দেয়া হচ্ছে অসম প্রতিযোগিতার দিকে। শিশুদেরকে স্কুল, কোচিং আবার গৃহশিক্ষক রেখে পড়ানো হচ্ছে। নেয়া হচ্ছে নানা প্রকার পরীক্ষা। এতে তৈরি হচ্ছে মানষিক চাপ। যা’ শিশু নির্যাতনের পর্যায়ে পড়ে বলেও কেউ কেউ মনে করেন। স্কুলগুলোর শিক্ষা বাণিজ্য ছাড়াও অভিভাবকদের মধ্যে চলছে অসম প্রতিযোগিতা। তারা তাদের সন্তানদেরকে ক্লাশে প্রথম হওয়ানোর জন্য এ প্রতিযোগিতায় মেতে থাকেন। অথচ শিক্ষাবিদরা বলছেন, শিশুদেরকে শ্রেণিতে প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় এভাবে মেধাক্রম হওয়ানোর কোন প্রয়োজন নেই। তারা শিখবে খেলতে খেলতে। অথচ তা যেমন নেই আবার তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি যুদ্ধও চলে প্রতি বছর। যদিও বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি মন্ত্রিত্ব গ্রহণের পর বলেছিলেন তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোন পরীক্ষা থাকবে না। কিন্তু এবারও খুলনার সরকারি স্কুলগুলোতে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি পরীক্ষা হচ্ছে।
খুলনার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা আইসিটি) গোলাম মাঈনউদ্দিন হাসান বলেন, এবারও পুরাতন পদ্ধতিতে তৃতীয় শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষা হবে। পরীক্ষাবিহীন শিক্ষার্থী ভর্তির বিষয়ে কোন নির্দেশনা এখনও আসেনি।
কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পর্কে খুলনার শিক্ষাবিদরাও বিরূপ মন্তব্য করেছেন। শিক্ষাবিদ অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, তিনি বরাবরই কিন্ডারগার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধী। তিনি মনে করেন, কিন্ডার গার্টেনে যেভাবে পড়ানো হয় তাতে শিশুদের সৃজন ক্ষমতাকে নষ্ট করে ফেলে। এক কথায় শিশুর মনোজগত ধ্বংস করে দেয়। বিষয়টি তিনি বিভিন্ন ফোরামেও বলছেন। কিন্তু কোন ফল হচ্ছে না। কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা ব্যবস্থা শিশু মনোবিকাশের সুযোগ সৃষ্টি করছে এমন কোন নজিরও এ পর্যন্ত কেউ দেখাতে পারেনি বলেও তিনি মন্তব্য করেন। খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের হেড প্রফেসর ড. মো. আব্দুল জব্বার বলেন, যে লক্ষ্য নিয়ে জার্মান শিশু শিক্ষানুরাগী ফ্রেডরিখ ফ্রোয়েবল কিন্ডার গার্টেন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন বাংলাদেশে সে লক্ষ্য কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই বাস্তবায়ন হয়না। ফ্রোয়েবলের উদ্দেশ্য ছিল প্রকৃতির কোলে প্রাকৃতিক পরিবেশে শিশু গড়ে উঠবে। কিন্তু এখন শিক্ষার নামে হচ্ছে ব্যবসা। শিশুদের বাবা-মাও মনে করছেন তাদের সন্তানদের স্কুলে পাঠাতে পারলেই অনেক কিছু শিখবে। কিন্তু সেখানে তারা যা শিখছে তার সবই মুখস্ত বিদ্যা।
খুলনা জেলা ক্রীড়া সংস্থার যুগ্ম সম্পাদক জিএম রেজাউল ইসলাম বলেন, তিনি দেশের বিভিন্ন শহর ঘুরেছেন। কিন্তু খুলনার ন্যায় এতো কম মাঠ অন্য কোন শহরে নেই। এজন্য শিশুদের খেলার জগত হারিয়ে যাচ্ছে। খুলনার উন্নয়নের সাথে যারা জড়িত কেডিএ বা কেসিসিও এ বিষয়টি নিয়ে কোন পরিকল্পনা করে না। উন্নয়নের সাথে সাথে স্থায়ী খেলার মাঠ স্থাপনের জন্য তিনি পরিত্যক্ত কোন স্থানকে নির্বাচন করে শিশুদের পড়াশুনার পাশাপাশি খেলার প্রতি মনোনিবেশ করার আহবান জানান।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ