শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

১৬ মাসেও ব্যাংকিং খাতের এক অঙ্কের সুদ হার কার্যকর হয়নি

মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: প্রতিশ্রুতির ১৬ মাসেও ব্যাংকিং খাতের এক অঙ্কের সুদ হার কার্যকর করতে পারেনি সরকার। ব্যাংক মালিকরা ঋণের সুদহার এক অঙ্কে (সিঙ্গল ডিজিট) নামিয়ে আনতে গত বছরের আগস্টে প্রধানমন্ত্রীকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। এ প্রতিশ্রুতির বিনিময়ে ব্যাংক মালিকরা সরকারের কাছ থেকে একের পর এক সুবিধা নিয়েছেন। কিন্তু ঋণের সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন হয়নি।
এদিকে সর্বশেষ গত ৫ নভেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেন। কিন্তু তাতেও কোনো কাজ হয়নি। প্রতিশ্রুতি ছিল, আমানতের সুদ হার হবে ৬ এবং ঋণে সুদ হবে ৯ শতাংশ। কিন্তু নানা ছুঁতোয় ওই পথে হাঁটছে না বেসরকারি খাতের বেশিরভাগ ব্যাংক। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার কোনোরকম তোয়াক্কা না করে নেওয়া হচ্ছে উচ্চ সুদ। অথচ ১ অঙ্কের সুদ হারের কথা বলে সরকারের কাছ থেকে নিচ্ছে নানান সুবিধা। বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়াতেই সুদের হার ১ অঙ্কের ঘরে নামিয়ে আনতে নীতিগতভাবে সিদ্ধান্ত নেয় সরকার।
৯ থেকে ৬ সুদহার বাস্তবায়নে ব্যাংকগুলোতে অনেক সুবিধা দিয়েছে সরকার। তার মধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ধার নেওয়ার ‘রেপো’ সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে ৬ শতাংশে নামানো হয়। এর আগের বছর করপোরেট কর আড়াই শতাংশ কমিয়ে সাড়ে ৩৭ শতাংশ করে সরকার। একই সঙ্গে সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার সুযোগ দেওয়া হয়। এরপর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বিধিবদ্ধ নগদ জমা অর্থাৎ ক্যাস রিজার্ভ রিকোয়ারমেন্ট (সিআরআর) সংরক্ষণের হার সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করা হয়। একই সঙ্গে গেল বছর ব্যাংক কোম্পানি আইন সংশোধনও করা হয়। যেখানে এক পরিবার থেকে চারজন পরিচালক হওয়ার সুযোগ রয়েছে এবং একজন পরিচালক টানা ৯ বছর থাকতে পারবেন। ব্যাংকগুলো যাতে সুদহার নমনীয় করে আনতে পারে তার জন্য পরিবেশ নিশ্চিত করতেই সরকার এমন উদ্যোগ নেয়। কিন্তু দীর্ঘদিনেও কমছে না সুদহার, যা বিনিয়োগের প্রতিবন্ধক।
ব্যাংক ঋণে সুদ হার এক অঙ্ক বাস্তবায়নের ঘোষণা দেয় বেসরকারি ব্যাংক মালিকদের সংগঠন, বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকস (বিএবি)। কিন্তু এখন পর্যন্ত কার্যকর পদক্ষেপ নেই। ঋণের সুদহার এখন ব্যাংক ভেদে ১২ থেকে ২০ শতাংশ। বাড়ি-গাড়ি কেনার ঋণ ১৪ থেকে ১৭ শতাংশ এবং ক্রেডিট কার্ডে অধিকাংশ ব্যাংকের সুদহার রয়েছে ১৮ থেকে ২৭ শতাংশ। যদিও ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত সংগ্রহের নির্দেশ দিয়েছে সরকারি ব্যাংক। কিন্তু সরকারি ব্যাংকগুলো ছাড়া বেসরকারি ব্যাংকগুলো এ নির্দেশমতো কাজ করেনি।
জানা গেছে, গত ১৬ মাসে প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া এ প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছে সরকারি-বেসরকারি মিলে মাত্র ১১টি ব্যাংক। এখনও বেসরকারি খাতের ৩৭ ব্যাংকের ঋণের সুদহার ১২-২০ শতাংশের ঘরে। এ অবস্থায় ব্যাংক খাতে ঋণের সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার বাস্তবায়ন হচ্ছে না কেন এ প্রশ্নের সমাধান খুঁজতে দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি ব্যাংকের চেয়ারম্যান এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালকদের (এমডি) নিয়ে বৈঠকে বসছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। আজ রোববার পরিকল্পনা কমিশনের এনইসি সম্মেলন কক্ষে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
এ বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, প্রধানমন্ত্রীকে দেয়া প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী সুদের হার কমার বদলে উল্টো বেড়েই চলছে। এতে নতুন শিল্প স্থাপন ও চলমান শিল্প সম্প্রসারণে অনেকেই আগ্রহ হারাচ্ছেন। ঋণের সিঙ্গেল ডিজিট বা এক অঙ্কের সুদহার কীভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেটা আগামী রোববারের বৈঠকের মূল আলোচ্য বিষয়।
সূত্র জানায়, ঋণের সুদহার সিঙ্গেল ডিজিটে নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ব্যাংক মালিকরা সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখা, বাণিজ্যিক ব্যাংক কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সংরক্ষিত নগদ জমা বা সিআরআর সংরক্ষণের হার কমানো এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে স্বল্পমেয়াদি ধারের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থা রেপোর সুদহার কমিয়ে নিয়েছে।
এসব সুবিধা দেয়ার লক্ষ্যই ছিল সুলভ বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিতের মাধ্যমে বিনিয়োগ উৎসাহিত করা। নানা সুবিধা পাওয়ার পর ব্যাংকের উদ্যোক্তারা গত বছরের জুনে সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ বিতরণের ঘোষণা দেন এবং একই বছরের ১ জুলাই থেকে এটি কার্যকর হওয়ার কথা জানান। কিন্তু গত ১৬ মাসে বেসরকারি ৪১ ব্যাংকের মধ্যে মাত্র তিনটি ব্যাংক এক অঙ্কের ঋণের সুদহার কার্যকর করেছে। গত বছরই সরকারি খাতের আটটি ব্যাংক ঋণের সুদহার এক অঙ্কে নামিয়ে আনে।
এদিকে যে কোনো মূল্যে বিনিয়োগ বাড়াতে চায় সরকার। বিশেষ করে ব্যক্তি খাতের বিনিয়োগ গেল ছয় বছর ধরেই জিডিপির ২২ থেকে ২৩ শতাংশের মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। এমন অবস্থায়, বিনিয়োগ চাঙ্গা করতে সুদহার কমিয়ে আনতে তোড়জোড় বাড়িয়েছে সরকার। সিঙ্গেল ডিজিট সুদহার কার্যকরের জন্য অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল সর্বশেষ ৫ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংকে সব ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও প্রধান নির্বাহীদের নিয়ে বৈঠকে বসেন। ওই বৈঠকের পর বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকে চিঠি দিয়ে ঘোষণার আলোকে ৯ শতাংশ সুদে ঋণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত কার্যকরের পরামর্শ দেয়। সম্প্রতি একনেক বৈঠকেও সুদহার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। জানা গেছে, সিঙ্গেল ডিজিটে সুদহার কার্যকরের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন না হওয়ায় প্রধানমন্ত্রী অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন।
ব্যবসায়ীদের সংগঠন, ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সভাপতি ওসামা তাসির মনে করেন, বেশিরভাগ ব্যাংক ১১ থেকে ১৫ শতাংশ হারে ঋণ দিচ্ছে। সরকার এক অংকের সুদহারে ঋণ দেওয়ার বিষয়ে উদ্যোগ নিয়েছে, কিন্তু তার প্রতিফলন নেই। তিনি বলেন, এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়নে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, সঞ্চয়পত্রের সুদ হার হ্রাস এবং ব্যাংক খাতের সুশাসন নিশ্চিত করা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি পদ্ধতি হাতে নেওয়া প্রয়োজন, যার মাধ্যমে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি এবং অনিচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপি শনাক্ত করা যাবে। দ্রুত সময়ের মধ্যে এক অঙ্কের সুদহার বাস্তবায়ন জরুরি।
এক অঙ্ক সুদহার প্রসঙ্গে জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জামাল উদ্দিন জানান, রাষ্ট্রায়ত্ত সব ব্যাংক এক অঙ্ক সুদহার বাস্তবায়ন করেছে। কিছু কিছু ব্যাংক চড়া সুদ দিয়ে এক ব্যাংকের আমানতকারীকে অন্য ব্যাংকে নিয়ে যাচ্ছে। এটা করলে ৯ শতাংশ সুদের কোনো ব্যবস্থায় কাজ করবে না। সুদহার যারা বাস্তবায়ন করবে না বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। তা না হলে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আসবে না।
গত বছরের ২০ জুন ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকসের (বিএবি) এক বৈঠক থেকে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, সব ব্যাংক সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ সুদে ঋণ এবং ৬ শতাংশ সুদে আমানত নেবে। শিল্পায়নের স্বার্থে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিকনির্দেশনার আলোকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে বলে জানান বিএবির চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম মজুমদার। এক অঙ্কের সুদহার কার্যকরের জন্য তখন সিআরআর সাড়ে ৬ শতাংশ থেকে কমিয়ে সাড়ে ৫ শতাংশ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। একই সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে 'রেপো'র বিপরীতে ধারের সুদহার ৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৬ শতাংশ করা হয়। আর সরকারি আমানতের ৫০ শতাংশ বেসরকারি ব্যাংকে রাখার ঘোষণা দেওয়া হয়। এত সুবিধার পরও রাষ্ট্রীয় মালিকানার ৮ ব্যাংক এবং কয়েকটি বিদেশি ব্যাংক ছাড়া সব ব্যাংকের সুদহার এক অঙ্কে না নামানোয় বিভিন্ন মহলের সমালোচনার মুখে রয়েছে ব্যাংকগুলো।
সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকে অনুষ্ঠিত 'ব্যাংকার্স সভায় বৈঠকে এমডিরা বলেন, সুদহার পুরোপুরি চাহিদা ও সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। এটা রাতারাতি কমানোর কোনো বিষয় নয়। বাজার চাহিদার কারণে বর্তমানে দুই অঙ্ক সুদে আমানত নিতে হচ্ছে। এখন এক অঙ্ক সুদে ঋণ বিতরণ সম্ভব না। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানতে সর্বোচ্চ ৬ শতাংশ সুদ নেওয়ার কথা থাকলেও এখনও সাড়ে ৯ শতাংশের কমে পওয়া যাচ্ছে না। আমানতে ৬ শতাংশ সুদহার কার্যকর না হলে ঋণের সুদ ৯ শতাংশে নামানো যাচ্ছে না। এর পরও ব্যাংকগুলোর ওপর চাপিয়ে দেওয়া হলে তারা তা কার্যকর করবে। তবে তাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে বলে সতর্ক করেন। সুদহারের কারণে কোনো ব্যাংক লোকসান করলে তখন বিদেশি ব্যাংক আর ওই ব্যাংকের সঙ্গে ব্যবসা করতে চাইবে না। এলসির খরচ অনেক বেড়ে যাবে বলে জানানো হয়।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এক ব্যাংকের পরিচালক অন্য ব্যাংকের কাছ থেকে ঋণ নিচ্ছেন। নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করেই এ কাজ করছেন পারস্পরিক যোগসাজশে। এমনও ঘটছে যে, বাণিজ্যিক ব্যাংকের পরিচালকরা পরিচিতজনদের নামে ঋণ উত্তোলন করে নিজেরাই নিয়ে যাচ্ছেন। এ ক্ষেত্রে জামানতের তোয়াক্কাও করছেন না তারা। ব্যাংক পরিচালকদের বেনামি ঋণ গ্রহণের ফলে দেশের ব্যাংকিং খাতে একধরনের অস্থিরতা দেখা দিয়েছে। যাদের নামে ঋণ দেখিয়ে পরিচালকরা বিরাট অঙ্কের টাকা নিয়ে গেছেন, ওই সব গ্রাহকও সার্বক্ষণিক আতঙ্কে ভুগছেন। কারণ, মামলার ভয় তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের। মালিক-পরিচালক টাকা ফেরত না দেয়ায় ব্যাংকে সুদাসলে দেনা বাড়ছে। এতে বেড়ে যাচ্ছে খেলাপি ঋণের পরিমাণও।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিশৃঙ্খল ব্যাংক খাতে নানা কারণে অস্থিরতা বিরাজ করছে। আমানত পেতেও ব্যাংকগুলো সমস্যায় পড়ছে। কারণ, অনেক ব্যাংকের ওপর আমানতকারীরা আস্থা হারিয়ে ফেলেছেন। বিদ্যমান তারল্য সঙ্কটের এটাও অন্যতম কারণ। আস্থাহীনতার কারণে অনেকেই ব্যাংকে টাকা রাখতে আগ্রহী হচ্ছেন না আর।
এ পরিস্থিতিতে কোনো দেশের সার্বিক অর্থনীতির উত্তরণের সম্ভাবনা নেই। ব্যাংক খাতের বিশৃঙ্খলার বিরূপ প্রভাব সব সেক্টরে পড়তে বাধ্য। অর্থনীতির সম্ভাব্য নি¤œগামিতা রোধে এখনই ব্যবস্থা নিতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থ মন্ত্রণালয়কে। কিন্তু ক্যাসিনোর মতো এ খাতও যদি সত্যিই এমন প্রভাবশালীদের খপ্পরে পড়ে থাকে, যাদের বিরুদ্ধে কথা বলার সাহস কারো নেই, তাহলে খোদ সরকার প্রধানকেই দায়িত্ব নিতে হবে এবং ‘ক্যাসিনো সম্রাট’দের বিরুদ্ধে যেভাবে দৃশ্যত কঠোর অভিযান চালানো হয়েছে, সে রকম ব্যাংকিং খাতেও কড়া ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ