চারদিন পর স্বাভাবিক হলো রাজধানীর সাথে সারাদেশের যান চলাচল
স্টাফ রিপোর্টার : চারদিনের ঘোষিত এবং অঘোষিত ধর্মঘট শেষে রাজধানীর সাথে সারাদেশের যান চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক হয়েছে। গতকাল শুক্রবার ঢাকা থেকে গাড়ি ছেড়ে গেছে বিভিন্ন গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। আর যাত্রির চাপও ছিল চোখে পড়ার মতো। এদিকে, সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের আশা প্রকাশ করে বলেন বৃহস্পতিবার কোথাও কোথাও বিঘ্ন ঘটলেও আজ শুক্রবার থেকে যান চলাচল স্বভাবিক হবে।
নতুন সড়ক আইন কার্যকরের প্রতিবাদে গত কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় পরিবহন শ্রমিকরা। কেউ কেউ পরিবহন চালাতে চাইলেও বিভিন্ন স্থানে বাধা দেয় শ্রমিকরা। পরে সরকারের আশ্বাসে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণা দিলেও কোথাও কোথাও চলছিলো অঘোষিত ধর্মঘট। গতকাল সকালে গাবতলী বাস টার্মিনাল থেকে যান চলাচল ছিল স্বাভাবিক। তবে, নতুন আইন নিয়ে কিছুটা অস্বস্তি আছে শ্রমিকদের মাঝে।
গত দু’দিন রাজধানীতে পরিবহন সঙ্কট থাকলেও ছুটির দিন হওয়ায় তার কোনো প্রভাব বোঝা যায়নি। সড়ক পরিবহন আইন সংশোধনের দাবিতে দেওয়া কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেওয়ার একদিন পর রাজধানী থেকে বাস চলাচল স্বাভাবিক হলো। শুক্রবার রাজধানীর গাবতলী, সায়েদাবাদ ও মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে দূরপাল্লার বিভিন্ন পরিবহনের বাস ছেড়ে গেছে।
গাবতলী থেকে খুলনাগামী ঈগল পরিবহনের বিভিন্ন পরিবহনের বাস নিয়মিত বিরতিতে ছেড়ে গেছে বলে জানান এ পরিবহন কোম্পানির গাবতলী কাউন্টারের ব্যবস্থাপক রুবেল। তিনি বলেন, “গতকাল যে বাসগুলো এসেছে সেগুলো খুলনা, মাগুরা, যশোরসহ বিভিন্ন রুটে সময়মতো ছেড়ে গেছে। দুপুরের পরও গাড়ি ছাড়বে।” সোহাগ পরিবহনের বাসগুলোও নির্ধারিত সময়ে বিভিন্ন রুটে ছেড়ে গেছে বলে কাউন্টার থেকে জানানো হয়েছে।
আনুষ্ঠানিক কোনো ঘোষণা না থাকলেও গত সোমবার থেকে বাস চলাচল বন্ধ রেখেছিলেন দেশের অনেক এলাকার বাস চালক ও শ্রমিকরা। এর মধ্যে বুধবার সকাল থেকে ট্রাক ও কভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন।
বুধবার রাতে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল পরিবহন নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে দাবি বিবেচনার আশ্বাস দিলে ট্রাক-কভার্ড ভ্যান মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদ কর্মসূচি প্রত্যাহার করে নেয়। কিন্তু বৃহস্পতিবারও দেশের অনেক এলাকায় বাস শ্রমিকদের অঘোষিত ধর্মঘট চলতে থাকে। ফলে বৃহস্পতিবারও গাবতলী থেকে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন রুটের বাস চলাচল কার্যত বন্ধ ছিল। পরিবহন সংশ্লিষ্টরা বলছিলেন, খুলনা থেকে কোনো বাস আসতে না পারায় ঢাকা থেকে সেগুলো ছাড়তে পারেনি।
বাংলাদেশ বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য মো. সালাহ উদ্দিন শুক্রবার সকালে বলেন, বাস চলাচল এখন স্বাভাবিক। রুটে বাস চলাচলে কোনো সমস্যা নেই। হান্ড্রেট পার্সেন্ট বাস ছেড়ে যাচ্ছে। ঢাকার দিকেও ছেড়ে আসছে।”
সায়েদাবাদ থেকেও বিভিন্ন পরিবহনের বাস চলাচল করছে বলে জানান সায়েদাবাদ আন্তঃজেলা বাস শ্রমিক কমিটির সভাপতি মোহাম্মদ আলী সুবা।
শাহজাহান খানের নির্দেশ :
পরিবহন শ্রমিকদের ধর্মঘট প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়েছেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি শাজাহান খান। দীর্ঘ অচলাবস্থা শেষে অবশেষে নির্দেশ আসলো পরিবহন নেতার। এর পরপরই স্বাভাবিক হতে শুরু করে দেশের পরিবহন ব্যবস্থা। শুক্রবার সকাল থেকে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সবকটি বাস টার্মিনাল থেকেই শুরু হয় স্বাভাবিক বাস চলাচল। পরিবহন খাতের স্থবিরতা থেকে মুক্তি দিতে এর আগে সরকারের দুই মন্ত্রী নানা প্রচেষ্টা চলালেও তা ব্যর্থ হয়। পরিবহন শ্রমিকরা বন্ধ রাখেন যান চলাচল।
পরিবহন বিশেষজ্ঞদের মতে, দীর্ঘদিনের একক আধিপত্যের সুযোগ নিয়ে মতের অমিল হলেই পরিকল্পিতভাবে অকার্যকর করা হয় পরিবহন ব্যবস্থা। জিম্মি দশায় পড়েন সাধারণ মানুষ। এমনকি অসহায় হতে হয় রাষ্ট্রকেও।
পরিবহন বিশেষজ্ঞ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, পৃথিবীর কোথাও পরিবহন সেক্টর ব্যক্তি-গোষ্ঠীর উপর নেই। তারা সরকারের নিয়ম-নীতি অনুযায়ী চলে, কোনো দাবি থাকলে সরকারের সঙ্গে কথা বলে। আলোচনার মাধ্যমে যে কোনো সমস্যার যৌক্তিক সমাধান সম্ভব জানিয়ে তিনি আরও বলেন, পরিবহন সংগঠনগুলো যাতে যখন-তখন ধর্মঘট ডাকতে না পারে সেজন্যও করতে হবে আইন প্রণয়ন। সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আইনের মধ্যে এই ধারা আনা উচিত যে, কেউ যদি জনগণের স্বার্থে গাড়ি চালায় এবং সেটাতে অন্য কেউ বাধা দেয় তবে তাকে শাস্তি পেতে হবে।
এদিকে দেশে মোটর চালকরা কথিত মালিক-শ্রমিক নেতাদের কাছে জিম্মি বলে অভিযোগ করেছেন জাতীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান। তিনি বলেন, নতুন মোটর আইন ২০১৮ বাস্তবায়ন করতে হলে সেসব কথিত নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। যারা শ্রমিকদের জিম্মি করে নিজেদের ফায়দা লুটছে। এ সময় তিনি শ্রমিকদের দক্ষতা ও কল্যাণে সাতটি দাবির কথা তুলে ধরেন।
গতকাল শুক্রবার বেলা সাড়ে ১১টায় রাজধানীর গাবতলী বাস টার্মিনালের বিপরীত পাশে খালেক সিটি এর দ্বিতীয় তলায় আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে এসব অভিযোগের দাবির কথা তুলে ধরেন সংগঠনের সভাপতি।
জাতীয় সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি মোস্তাকুর রহমান বলেন, ‘আমরা মোটর শ্রমিকরাও নিরাপদ সড়ক চাই। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, এই আইনে সড়ক পরিবহন মোটর শ্রমিকদের আশা-আকাক্সক্ষার তেমন কোন বাস্তবায়ন ঘটেনি। সড়ক পরিবহন আইনে ১৪টি অধ্যায় ও ১২৫ টি ধারার মধ্যে ৫২ টি ধারাই শ্রমিকদের শাস্তির বিধান সম্পর্কিত। অথচ দুর্ঘটনার জন্য সড়ক নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান, সড়ক ব্যবস্থাপনা সংস্থার প্রকৌশলী, বি আরটিএ, গাড়ির মালিক, সড়কের বেহাল অবস্থা, গাড়ির যান্ত্রিক ত্রুটি, ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা ও যত্রতত্রভাবে পথচারী পারাপার উল্লেখিত সবাই কোনো না কোনোভাবে দায়ী। কিন্তু শুধুমাত্র এককভাবে চালককে দায়ী করলে নিরাপদ সড়কের সমস্যার সমাধান কোনোভাবে সম্ভব নয়।’
তিনি আরও বলেন, ‘পরিসংখ্যান অনুযায়ী দেশে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ৪০ লাখেরও বেশি। কিন্তু লাইসেন্স প্রাপ্ত ড্রাইভার এর সংখ্যা মাত্র ২৭ লাখের মতো। প্রায় ১৩ লাখ ড্রাইভার লাইসেন্স বিহীন বা অবৈধ উপায়ে লাইসেন্স নিয়ে গাড়ি চালাতে বাধ্য হচ্ছে, তার প্রধান কারণ এর সঙ্গে বি আরটিএর সংশ্লিষ্ট অসাধু কর্মকর্তা ও দালালদের দৌরাত্ম্য। যেখানে একজন মোটর শ্রমিক প্রকৃতভাবে তার লাইসেন্স পেতে অনেক প্রতিকূলতা ও হয়রানির শিকার হতে হয়। সেইসঙ্গে গুনতে হয় ১০ থেকে ২৫ হাজার টাকার বাড়তি অর্থ। আবার যথাসময়ে শ্রমিকরা লাইসেন্স না পেয়ে নিতান্তই বেঁচে থাকার তাগিদে বাধ্য হয়েই তারা মালিককে অনুরোধ করেন এবং ন্যায্য বেতন না পেয়ে অল্প বেতন পাওয়ার আশায় তারা পথে নামে। যার সুযোগ সুবিধা মালিকরাও নিয়ে থাকে। রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নামার পরও বাংলাদেশের পর্যাপ্ত গাড়ি পার্কিং সুবিধা না থাকার পরও পার্কিংয়ের জন্য তাদেরকে জরিমানা করা হয়। আবার মালিক সমিতির স্থানীয় প্রভাবশালীদের যোগসাজশে রাস্তার পাশে অবৈধ পার্কিং দেখিয়ে সেখান থেকে গাড়ি প্রতি ১০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত আদায় করে থাকে। যার ভাগ স্থানীয় প্রভাবশালী ও মটর সংগঠনের নেতারা পর্যন্ত পেয়ে থাকেন। অথচ যত দায়ভার সব চালকের।’
মোস্তাকুর রহমান বলেন, ‘শ্রম আইনে আছে নিয়োগপত্র, পরিচয়পত্র, সার্ভিস বুক না দিয়ে কোনো শ্রমিক নিয়োগ করা যাবে না। কিন্তু ৫০ লাখের বেশি শ্রমিকের মধ্যে অধিকাংশের কাছেই কোনো নিয়োগপত্র কিংবা পরিচয়পত্র নেই।’
মোস্তাকিন রহমান বলেন, নতুন মোটরযান আইন-২০১৮ এর ধারা নং ৬৬, ৮৬, ৮৭, ৮৮, ৮৯, ১০৪ ও ১০৫ এর ধারা সমূহের শাস্তির বিধান সংশোধন করে জরিমানা আরও কম এবং আরও লঘুদ- বাস্তবায়নের দাবি জানাচ্ছি। সেইসঙ্গে শ্রমিকদের নিয়োগপত্র কর্মঘন্টা আইনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য অনুরোধ করছি।
মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের নেতাদের অনিয়মের অভিযোগ তুলে তিনি বলেন, ১৯৯১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের নেতৃত্বে সমগ্র বাংলাদেশের টার্মিনালগুলো দখল করে পরিবহন সেক্টরে লুটপাটের রাজনীতি সৃষ্টি করেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় বর্তমানে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক শ্রমিক ঐক্য পরিষদ নামে ২০০৩ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত ব্যাপকহারে চাঁদাবাজি করে আসছে। মালিক-শ্রমিক ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক নামধারী মালিক নেতা খন্দকার এনায়েতুল্লাহ ঢাকা শহরের মিনি বাস সার্ভিস গুলোতে একক মালিক সমিতি কমিটি দিয়ে প্রতিদিন গাড়ি প্রতি ১ হাজার থেকে ১২'শ টাকা পর্যন্ত চাঁদা তোলেন। আবার সেসব নেতারাই বর্তমান সরকার ভেতরে থেকে পরিবহন ধর্মঘটের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে অবৈধ চাঁদাবাজি বহাল রাখার অপচেষ্টা লিপ্ত রয়েছে। এ সমস্ত দুর্নীতিবাজ মালিক সমিতির নেতাদের কাছে সাধারণ গাড়ির মালিকরাও জিম্মি।
এ সময় তিনি শ্রমিকদের দক্ষতা বাড়াতে ও ভাগ্যোন্নয়নে সাতটি দাবির কথা তুলে ধরেন। দাবিগুলো হলো- যোগ্য মোটর শ্রমিক গড়ার লক্ষ্যে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলা ও উপজেলায় প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে উন্নত ট্রেনিং সেন্টার দিতে হবে; ট্রেনিং সার্টিফিকেট, বৈধ লাইসেন্স, নাগরিকত্বের সনদ, শ্রমিক কার্ড এবং শ্রমিক সংগঠন থেকে প্রত্যয়নপত্র এবং আবেদনপত্র নিয়ে সরকারি নিয়মনীতি অনুযায়ী প্রত্যেক শ্রমিককে নিয়োগপত্র দিতে হবে। যার মধ্যে গ্রাচুইটি ও প্রভিডেন্ট ফান্ড সমূহের নিয়ম-নীতি উল্লেখ থাকবে।; শ্রমিকদের ভাগ্য উন্নয়নে শুধুমাত্র শ্রমিক কল্যাণ রশিদের মাধ্যমে শ্রমিক কল্যাণ তহবিল আদায় ব্যতীত, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সকল অবৈধ চাঁদা অনতিবিলম্বে বন্ধ করতে হবে; নিরাপদ সড়কের স্বার্থে সড়ক ও মহাসড়কে ডিভাইডার দিতে হবে এবং সিএনজি অটোরিকশার জন্য আলাদা লেনের ব্যবস্থা করতে হবে। মহাসড়কের পাশে অবৈধ বাজারব্যবস্থা নির্দিষ্ট স্থানে সরাতে হবে শহরের ফুটপাত দখলমুক্ত রেলিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে; জেব্রা ক্রসিং ওভার ব্রিজ ছাড়া যেখানে-সেখানে রাস্তা পারাপার আইন করে বন্ধ ঘোষণা করতে হবে এবং অস্থায়ীভাবে হলেও নির্দিষ্ট স্থানে পার্কিং এবং স্টপেজ দিতে হবে; শ্রমিক ও যাত্রীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য টার্মিনালভিত্তিক সরকারি প্রাথমিক চিকিৎসা কেন্দ্রের ব্যবস্থা করতে হবে;শ্রমিকদের সন্তানদের জন্য উচ্চ মাধ্যমিক পর্যন্ত অর্ধেক বেতনে পড়ালেখার সুযোগ করে দিতে হবে। এ সময় তিনি সকল শ্রমিকদের কে অঘোষিত কর্মবিরতি পরিহার করে কাজে যোগদানের আহ্বান জানান।