বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

ক্রিকেটে আশার আলো মোহাম্মদ নাঈম শেখ

মাহাথির মোহাম্মদ কৌশিক : নতুনরা উঠে আসে পুরনোদের বিদায় করে দিতে। শুধু খেলাধুলাই নয়, প্রতিটা সেক্টরেই দেখা মিলে এমন কিছুর। আর খেলাধুলায় বয়সভিত্তিক আসর থেকেই মূলত জাতীয় দলের জন্য নিজেকে তৈরি করে থাকেন খেলোয়াড়রা। যেমন করে নিজেকে প্রস্তুত করে আজকের অবস্থানে এসে পৌছেছেন মোহাম্মদ নাঈম শেখ। সুযোগ পেয় এক সিরিজে নিজেকে প্রমাণ করেছেন এই তরুণ। ভারতের বিপক্ষে তাদের মাটিতেই নিজেকে আলাদাভাবে সুযোগ করে দিয়েছেন। এর আগে গত সেপ্টেম্বরে ঘরের মাটিতে ত্রিদেশীয় টোয়েন্টি-২০ সিরিজে দলে প্রথম ডাক পেয়েছিলেন। কিন্তু খেলার সুযোগ হয়নি। ওপেনারদের ব্যর্থতায় হয়তো ফাইনালেই অভিষেক হতে পারতো মোহাম্মদ নাইম শেখের। কিন্তু বৃষ্টির কারণে ফাইনাল না হওয়াতে, শেষ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছে পরবর্তী সিরিজ পর্যন্ত। সেই অপেক্ষাটা কাজে লেগেছে ২০ বছর বয়সী এ তরুণ ওপেনারের। এমনিতে ঘড়োয়া ক্রিকেটে নিয়মিত পারফরমার। গত কয়েক বছর যাবত নিয়মিতভাবে ভাল খেলে চলেছেন। আর এবার অপরিহার্য ওপেনার তামিম ইকবালের অভাবটা একেবারেই বুঝতে দেননি তিনি। বরং কঠিন ভারত সফরে অদম্য ভারতের বিপক্ষে সুযোগ পেয়েই ছাড়িয়ে গেছেন সবাইকে। ৩ ম্যাচের সিরিজে করেছেন ১৪৩ রান যা বাংলাদেশী কোন ব্যাটসম্যানের হয়ে দ্বিপাক্ষিক টোয়েন্টি-২০ সিরিজে সর্বাধিক। তাছাড়া তৃতীয় টোয়েন্টি-২০ ম্যাচে ৪৮ বলে ১০ চার, ২ ছক্কায় ৮১ রানের যে ইনিংস খেলেছেন তা ভারতের বিপক্ষে কোন বাংলাদেশী ব্যাটসম্যানের সেরা ইনিংস। এক সিরিজেই এমন আলো ড়ানো নৈপুণ্যে বাংলাদেশের ভবিষ্যত টোয়েন্টি-২০ ব্যাটসম্যান হিসেবে নিজের সামর্থ্য বেশ ভালভাবেই পূরণ করেছেন তিনি। নির্বাচকরাও মনে করছেন নাইমের পেছনে যে সময় ব্যয় করেছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি) এখন তার কাছ থেকে সুফল পাওয়া উচিত দলের। ফরিদপুরে জন্ম নেয়া নাইম ক্রিকেট খেলার শুরুও করেছিলেন নিজ জেলায়। তার সে সময় কোচ ছিলেন মোখলেসুর রহমান। বয়সভিত্তিক ক্রিকেটে নিয়মিত খেলে নিজেকে ধীরে ধীরে গড়ে তুলেছেন তিনি। পরবর্তীতে কোচ তানভির আহমেদ রাজিবের কাছেও বিভিন্ন সময়ে পরামর্শ নিয়েছেন। এভাবেই ধীরে ধীরে নিজের প্রতিভা বিকশিত করতে থাকেন। অবশেষে মাত্র দুই বছর আগে শেষ সময়ে এসে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে অভিষেক হয় নাইমের। গত বছর যুব বিশ্বকাপও খেলেছেন নিউজিল্যান্ডে। সবমিলিয়ে যুবাদের হয়ে মাত্র ৮ ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন। তারপরই তার বয়স শেষ হয়ে গেছে যুবাদের হয়ে জার্সি গায়ে চড়ানোর। গত বছর ঢাকা প্রিমিয়ার ডিভিশন ক্রিকেট লিগে (ডিপিএল) তাকে দলে ভেড়ায় লিজেন্ডস অব রুপগঞ্জ। মূলত অনুর্ধ-১৯ দলের হয়ে কিছু ভাল ইনিংস খেলার সুবাদেই দলটি তাকে নিয়েছিল। কিন্তু চার ম্যাচ বসে থাকতে হয়েছে। নিয়মিত ওপেনার ভাল করতে না পারায় অবশেষে খেলার সুযোগ পান নাইম। সেই সুযোগ কাজে লাগিয়ে সেই ডিপিএল তিনি শেষ করেন ৪৬.৩৩ গড়ে ৫৫৬ রান করে। কিন্তু একই বছর প্রথম শ্রেণীর আসর ও বিপিএল এবং এ বছর ডিপিএল টোয়েন্টি-২০-তে ব্যর্থ হন। কিন্তু রূপগঞ্জের হয়ে সর্বশেষ ডিপিএলে আবার নিজেকে ফিরে পান নাইম। এ বছর ডিপিএলে ৫৩.৮০ গড়ে করেন দ্বিতীয় সর্বাধিক ৮০৭ রান। সর্বাধিক রান করা আরেক তরুণ সাইফ হাসানের চেয়ে মাত্র ৭ রানে পিছিয়ে ছিলেন তিনি। এমন দুর্দান্ত নৈপুণ্যের পর জাতীয় দলের নির্বাচকদের নজরে আসেন। কিন্তু নাইমকে আরও পরীক্ষা করা এবং সুযোগ করে দেয়ার প্রক্রিয়ায় এগিয়েছেন তারা। নাইমকে ইমার্জিং দল, ‘এ’ দল, বিসিবি একাদশের হয়ে খেলানো হয়েছে। গত জুলাইয়ে ‘এ’ দলের হয়ে আফগানিস্তান ‘এ’ দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি, অক্টোবরে শ্রীলঙ্কা ‘এ’ দলের বিপক্ষে দুটি হাফসেঞ্চুরি করে সন্তুষ্টি অর্জন করেন নির্বাচকদের। জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো ডাক পেয়ে যান সেপ্টেম্বরে জিম্বাবুয়ে ও আফগানিস্তানকে নিয়ে আয়োজিত ত্রিদেশীয় সিরিজে। তবে এই সুযোগটা হয়তো বিলম্বেই আসতো যদি না অপরিহার্য ওপেনার তামিম ক্রিকেট থেকে সাময়িক বিশ্রামে না থাকতেন। কারণ প্রতিযোগিতামূলক টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটে অতটা আশা জাগানিয়া ছিল না নাইমের পারফরম্যান্স। ৭ ম্যাচে মাত্র ৯০ রান ছিল তার। তবে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে তার পারফর্মেন্সই সুযোগ করে দেয় তাকে টোয়েন্টি-২০ দলে। তাছাড়া আগামী বছর টোয়েন্টি-২০ বিশ্বকাপের জন্য নতুন খেলোয়াড় খুঁজে বের করার মিশন হাতে রয়েছে নির্বাচকদের। সবমিলিয়ে সুযোগটা আসে নাইমের। তবে ত্রিদেশীয় সিরিজে অভিষেক হয়নি শেষ পর্যন্ত। এবার ভারত সফরের টোয়েন্টি-২০ দলেও তাকে রেখে দেন নির্বাচকরা। এই অপেক্ষাটা খুব কাজে লেগেছে তরুণ নাইমের। ‘সবুরে মেওয়া ফলে’ যাওয়ার মতোই বলতে হবে ব্যাপারটিকে। কারণ পুরো একটা ত্রিদেশীয় সিরিজে দলের সঙ্গে থেকে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের উত্তেজনা, রূপ, রস, মানসিকতা বুঝে ওঠার দারুণ সুযোগ পেয়েছেন। সেই সুযোগটা যখনই পেলেন কাজে লাগালেন। তাও আবার ভারত সফরে গিয়ে। তার বিষয়ে নির্বাচক হাবিবুল বাশার সুমন বলেন, ‘বাংলাদেশের ক্রিকেটে প্রতিভার কোন কমতি কখনোই ছিলনা। আর অনেক মেধাবীই আন্তর্জাতিক ক্রিকেট আসে, কিন্তু পারফরমার হতে পারে না। নাইম পারফর্ম করছে। তার জন্য আমরা যে সময় ও পরিচর্যা দিয়েছি এখন তার সুফল আসার সময়। আন্তর্জাতিক ম্যাচে রান করতে বিশেষ ক্ষমতা লাগে। এখনই কিছু বলা ঠিক হবে না। মাত্রই ৩ ম্যাচ খেলেছে। কিন্তু আশা করছি ভবিষ্যতে তাকে আমাদের অনেক কাজে লাগবে।’ ১২ বছর আগে ভারতের বিপক্ষে ২০০৭ বিশ্বকাপে তামিম বিধ্বংসী এক অর্ধশতক হাঁকিয়েছিলেন। ভারতের বিপক্ষে টোয়েন্টি-২০ ম্যাচ আসলেই সেই ইনিংসটি আলোচনায় চলে আসতো ঘুরে-ফিরে। এখন সেটিকে ছাপিয়ে নাইম নতুন আলোচনার জন্ম দিয়েছেন। ভারতের মাটিতে সব প্রতিপক্ষই যখন নাস্তানাবুদ হয়, বাংলাদেশ দল যেখানে তাদের কাছে বারবার টোয়েন্টি-২০ ম্যাচে হয় কুপোকাত- নাইম ব্যতিক্রমী একটি ইনিংস খেললেন। নাগপুরে সিরিজের তৃতীয় ও শেষ ম্যাচে ৪৮ বলে ১০ চার, ২ ছক্কায় খেলেন ৮১ রানের বিস্ফোরক ইনিংস যা ভয় ধরিয়ে দিয়েছিল ভারতীয়দের। কিন্তু সেই ম্যাচে শেষ পর্যন্ত জিততে পারেনি বাংলাদেশ। সেজন্য আক্ষেপ অধিনায়ক মাহমুদল্লাহ রিয়াদেরও,‘ভারতের মাটিতে দল হিসেবে সাম্প্রতিক সময়ে ভাল খেলা দলের সংখ্যা খুব বেশি নয়। প্রথমবারের মতো টোয়েন্টি-২০ সিরিজে আমরা সিনিয়ররা ব্যর্থ হয়েছি। এটা মেনে নিচ্ছি। খুবই দৃষ্টিনন্দন লেগেছে নাইমের খেলা ইনিংসগুলো। আমার এতটুক খারাপ লাগছে যে ও এতো সুন্দর খেলেছে, আর আমরা ম্যাচ শেষ করে আসতে পারলাম না। তো ওর জন্য খারাপ লাগছে। আমরা ওর জন্য হলেও ম্যাচটি শেষ করে আসতে পারতাম। তাহলে ওকে কৃতিত্ব দিতে পারতাম।’ এর আগে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের সেরা ব্যক্তিগত ইনিংস ছিল সাব্বির রহমান রুম্মানের। গত বছর নিদাহাস ত্রিদেশীয় টোয়েন্টি-২০ সিরিজে কলম্বোয় তিনি খেলেছিলেন ৫০ বলে ৭ চার, ৪ ছক্কায় ৭৭ রানের ইনিংস। নাগপুরে এসে সেটিকে ছাড়িয়ে গেছেন নাইম, এখন ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের হয়ে সেরা ইনিংস তার দখলে। প্রথম ম্যাচে করেছিলেন ২৬, দ্বিতীয় ম্যাচে ৩১ বলে ৩৬... ক্রমান্বয়ে যেন খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসছিলেন আর ইনিংসটাকে বড় করছিলেন। দিল্লীতে অভিষেকে ২৬ রান দিয়ে শুরু করেছিলেন। আপাতত শেষ করেছেন নাগপুরে গিয়ে ৮১ রানের এক অবিশ্বাস্য ইনিংস উপহার দিয়ে। নাইম তার অভিষেক সিরিজের ৩ ম্যাচে ৪৭.৬৬ গড় ও ১৩৩.৬৪ স্ট্রাইকরেটে ১৪৩ রান করেছেন সর্বাধিক রান সংগ্রাহক। এর আগে দ্বিপাক্ষিক টোয়েন্টি-২০ সিরিজে বাংলাদেশের পক্ষে সর্বাধিক রান ছিল সাব্বিরের। তিনি ২০১৬ সালের জানুয়ারিতে জিম্বাবুইয়ের বিপক্ষে ৪ ম্যাচে করেছিলেন ১৪০ রান। ২ কিংবা ৩ ম্যাচের সিরিজে সর্বাধিক তামিম ইকবালের ১১৯ রান। তিনি হল্যান্ডের বিপক্ষে ২০১২ সালে ২ ম্যাচে ওই রান করেছিলেন। ৩ ম্যাচে সর্বাধিক ১০৯ রান আছে লিটন দাসের, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। অর্থাৎ এক সিরিজেই দেশের সেরা পারফরমার হয়ে গেছেন নাইম অনেক পরিসংখ্যানে। ভারতের মাটিতে ভারতের বিপক্ষে টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটে আনকোরা হিসেবে নামলেও পরিণত ইনিংস খেলে সবাইকে চমকে দিয়েছেন ২০ বছর বয়সী ফরিদপুরের এ তরুণ ওপেনার। ৩ ম্যাচের সিরিজে যেখানে দু’দলে টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটের অনেক অভিজ্ঞ ও দুর্দান্ত ব্যাটসম্যানের উপস্থিতি, সেখানে সর্বাধিক ১৪৩ রান করেছেন তিনি। সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব ক্রিকেটের সব ফরমেটেই ফর্মের তুঙ্গে আছেন রোহিত শর্মা। তিনি টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটেও বিধ্বংসী ও নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ভারতের। তার প্রমান সিরিজের দ্বিতীয় টোয়েন্টি-২০ ম্যাচে দিয়েছেন মাত্র ৪৩ বলে ৬ চার, ৬ ছক্কায় ৮৫ রানের বিস্ফোরক ইনিংস উপহার দিয়ে। এছাড়াও ভারতের ব্যাটিং লাইনআপে আছেন লোকেশ রাহুল, শিখর ধাওয়ানের মতো টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটের বড় বড় নাম। ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগে (আইপিএল) নিয়মিত ঝড়ো ব্যাটিং করা শ্রেয়াস আইয়ার ও ঋষভ পান্তও ছিলেন। বাংলাদেশ দলে অভিজ্ঞ মুশফিকুর রহিম, মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও সৌম্য সরকারের মতো টোয়েন্টি-২০ ক্রিকেটের স্বীকৃত ব্যাটসম্যানরা আছেন। কিন্তু সবাইকে ছাপিয়ে সিরিজ শেষে সব আলো নিজের ওপরে নিয়েছেন তরুণ বাঁহাতি ওপেনার নাইম। দিল্লীতে যাত্রা শুরু করে সব আলো কেড়ে নিয়েছেন একাই। নাইমের এমন পারফরম্যান্সে ভবিষ্যতের চিন্তাটাও হয়তো দূর হলো বাংলাদেশ দলের। তবে এখনও অনেক সময় বাকি। পাড়ি দিতে হবে অনেক দূর। সঠিক পরিচর্যা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যত নিয়েই এসেছেন নাইম, তা অন্তত বলা যাচ্ছে। ভারতে আলোকিত নাইমকে পাওয়া বিশাল উপহার তাই বাংলাদেশের ক্রিকেটে। এখন দেখার বিষয় তাকে কিভাবে পরিচর্যা করে বাংলাদেশের। হারিয়ে যেতে দিলে যে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে বাংলাদেশের।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ