বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাজারের আগুনে পুড়ছে মানুষ

* চালের দাম কেজিতে বেড়েছে ৬ টাকা
* মুরগী, ভোজ্য তেলসহ অন্যান্য পণ্যের দামও বাড়ছে
মিয়া হোসেন : নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির আগুনে পুড়ছে মানুষ। একের পর এক জিনিসপত্রের দাম বেড়েই চলছে। বিশেষ করে সম্প্রতি পেঁয়াজের মূল্যবৃদ্ধির ঝাঁজ মানুষ আর সইতে পারছে না। কোনক্রমেই পেঁয়াজের দাম কমছে না। উল্টো ঘন্টায় ঘন্টায় বাড়ছে। যেন অপ্রতিরোধ্য পেঁয়াজ। বর্তমানে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকা কেজি। এক কেজি পেয়াঁজেই চলে যাচ্ছে ৫ থেকে ৬ কেজি চালের দাম। যা  অল্প আয়ের মানুষের এক সপ্তাহের দু’মুঠো ভাতের খরচ। এদিকে পেঁয়াজের সাথে পাল্লা দিয়ে নতুন বেড়েছে চাল, ভোজ্য তেল, ব্রয়লার মুরগি ও আদা-রসুনের দাম। হঠাৎ করেই কোন ধরনের কারণ ছাড়াই চালের দাম কেজিতে ৬ টাকা বেড়ে গেছে। আটা-ময়দার দামও বাড়তে শুরু করেছে। সাধারণ মানুষের অভিযোগ সরকার যথাসময়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ না নেয়ায় লাগামহীনভাবে বেড়েই যাচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়ে দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানানো হয়েছে।
টিসিবি সূত্র জানায়, গোটা বছরই পেঁয়াজের দাম দফায় দফায় বেড়েছে। গত এক বছরে পেঁয়াজের দাম বৃদ্ধিতে রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। পেঁয়াজের মূল্য গত এক বছরে শতকরা ৫৩৩ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর রসুনের দাম বেড়েছে ১৭৫ ভাগ, আদা ৫২ ভাগ এবং এলাচের দাম বেড়েছে শতকরা ৫২ ভাগ। এ ছাড়াও অন্যান্য নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর বাজারগুলোতে দেখা গেছে, প্রতি কেজি পেঁয়াজ অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৬০ টাকায়। যা গত পরশুও ছিলো ২১০ থেকে ২২০ টাকা। প্রতি ঘণ্টায় দাম বাড়ছে দুই টাকা করে। একদিনের ব্যাবধানে বেড়েছে আরও ৪০ থেকে ৫০ টাকা। গত চার দিনে পেঁয়াজের দাম বাড়লো ৮০-১০০ টাকা। এর আগে কখনো দেশের বাজারে এত দামে পেঁয়াজ বিক্রি হয়নি। দাম আরও বাড়ার আশঙ্কা করছেন ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা।
কারওয়ান বাজারের পাইকারী প্রতি কেজি পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। যা খুচরা বাজারে গিয়ে বিক্রি হচ্ছে ২৫০টাকা থেকে ২৬০ টাকায়। ব্যবসায়ীরা জানান, দেশি পেঁয়াজ গত পরশু ২০০ থেকে ২১০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। গতকাল শুক্রবার তা বিক্রি হয় ২৫০-২৬০ টাকা দরে। দাম আরও বাড়তে পারে বলেও জানান তারা।
এদিকে, ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) ট্রাকসেলে খোলা বাজারে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। সরকারি বন্ধের দিন ছাড়া ট্রাকসেলে প্রতিদিন ৪৫ টাকা কেজি দরে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত রয়েছে। বাজার পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত ট্রাকসেলে পেঁয়াজ বিক্রি অব্যাহত থাকবে বলে জানা গেছে। তবে মানুষের চাহিদা অনুযায়ী প্রতিদিন দীর্ঘ সময় লাইন ধরেও পেঁয়াজ পাওয়া যাচ্ছে না।
এদিকে দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে আগামীকাল রোববার থেকে জরুরিভিত্তিতে কার্গো বিমানে করে পেঁয়াজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সরকারিভাবে টিসিবি তুরস্ক এবং বেসরকারি খাতের এস আলম গ্রুপ মিশর থেকে পেঁয়াজ আনবে।
বাণিজ্য সচিব ড. জাফর উদ্দিন গতকাল শুক্রবার বিকেলে এই সিদ্ধান্তের কথা জানান। তিনি বলেন, যতদিন পর্যন্ত বাজার স্বাভাবিক না হবে, ততদিন এয়ার কার্গোতে পেঁয়াজ আমদানি করা হবে। সরকারিভাবে পেঁয়াজ আমদানির জন্য একজন উপসচিবকে তুরস্কে পাঠানো হচ্ছে। এছাড়া একজন উপসচিব মিশরে রয়েছেন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দেশে পেঁয়াজের সরবরাহ ও মূল্য স্বাভাবিক রাখতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে টিসিবির মাধ্যমে সরাসরি তুরস্ক থেকে, এস আলম গ্রুপ মিশর থেকে, বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান আফগানিস্থান ও সংযুক্ত আরব আমিরাত থেকে জরুরিভিত্তিতে কার্গো উড়োজাহাজ যোগে পেঁয়াজ আমদানি করবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় আনুষ্ঠানিকতা ইতোমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অতি অল্প সময়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পেঁয়াজ বাজারে সরবরাহ করা সম্ভব হবে। এছাড়া সমুদ্র পথে আমদানিকৃত পেঁয়াজ বাংলাদেশের পথে রয়েছে, পেঁয়াজের সবচেয়ে বড় এই চালান খুব শিগগিরই বাংলাদেশে পৌঁছাবে।
এদিকে গত দুই দিনের ব্যবধানে রাজধানীতে চালের দাম বেড়েছে অস্বাভাবিকভাবে। প্রতি কেজি মিনিকেট চালের দাম বেড়েছে পাঁচ থেকে ছয় টাকা। এছাড়া বিরি-২৮ চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে দুই টাকা। তবে খুচরা দোকানগুলোতে বিরি-২৮ চাল বিক্রি হচ্ছে চার থেকে পাঁচ টাকা বেশি দরে।
রাজধানীর কৃষি মার্কেটের রাজশাহী ট্রেডার্সের মালিক মো. মোক্তার হোসেন বলেন, গত বুধবার (১৩ নভেম্বর) মিনিকেটে ৫০ কেজির বস্তা বিক্রি হয়েছে দুই হাজার টাকায়। শুক্রবার সেটি বিক্রি হচ্ছে দুই হাজার ৩০০ থেকে দুই হাজার ৩৫০ টাকায়।
একই মার্কেটের ‘আলী রাইস’-এর মালিক মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, বুধবার মিনিকেট বিক্রি করেছি ৪২ থেকে ৪৫ টাকা কেজি। আজ বিক্রি করছি ৪৮ থেকে ৫০ টাকা।
মেসার্স সিমন অ্যান্ড সিফাত রাইস এজেন্সির বিক্রয়কর্মী রাসেল বলেন, গত বুধবারের চেয়ে মিনিকেট আজ প্রতি কেজিতে ছয় টাকা বেশি দামে বিক্রি করছি। বিরি-২৮ চাল ৩০ থেকে ৩২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করেছি দুই দিন আগে। তা বিক্রি করছি ৩৬ থেকে ৩৮ টাকায়। প্রতি কেজি স্বর্ণা বিক্রি করেছি ৩২ টাকায়, এখন বিক্রি করছি ৩৫ টাকায়। বুধবার নাজিরশাল ৪৮ টাকায় বিক্রি করেছি, এখন বিক্রি করছি ৫৪ টাকায়। প্রতি কেজি চিনিগুঁড়া ৮০ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৯০ টাকা।’
ব্যবসায়ীরা বলছেন, উত্তরাঞ্চলের ধান-চালের সবচেয়ে বড় মোকাম নওগাঁয় এক সপ্তাহের ব্যবধানে চিকন চালের দাম বেড়েছে প্রতি কেজিতে চার থেকে পাঁচ টাকা। আর বস্তাপ্রতি (৫০ কেজি) বেড়েছে প্রায় ২০০ টাকা। বিরি-২৮ জাতের ধানের সরবরাহ কমায় চালের দাম বেড়েছে। মোকাম থেকে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে।
দাম বেড়েছে আটা-ময়দারও। রাজশাহী ট্রেডার্সের মালিক মো. মোক্তার হোসেন জানান, ময়দার দাম বেড়েছে বস্তা প্রতি ১৫০ টাকা ২০০ টাকা।
এদিকে রাজধানীর কাচাঁ বাজারে বেশকিছু পণ্যের দাম কমেছে এবং দু’একটি পণ্যের দাম বাড়তে দেখো গেছে। বর্তমানে প্রতিকেজি মানভেদে টমেটো ৯০-১০০ টাকা, গাজর (আমদানি) ৬০-৭০ টাকা, গাজর (দেশি) বিক্রি হয়েছে ৪০-৫০ টাকা, কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এসব বাজারে প্রতিকেজি শিম বিক্রি হচ্ছে ৫০-৬০ টাকা, করলা ৪০-৫০ টাকা, মূলা ৪০-৫০ টাকা, বেগুন আকারভেদে ৫০-৬০ টাকা, কচুরলতি ৪০-৫০ টাকা, পটল ৪০-৫০ টাকা, ঝিঙা ৪০-৫০ টাকা, কাকরোল ৪০-৫০ টাকা, ঢেড়স ৪০-৫০ টাকা, কাঁচা মরিচ ৮০-৯০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। তবে কেজিপ্রতি ১০-২০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে শসার দাম। বর্তমানে কেজিপ্রতি শসা ৯০-১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা গেছে, ক্ষিরা (শসা) বিক্রি হচ্ছে ৪০-৫০ টাকা কেজি দরে।
এছাড়া আকারভেদে প্রতিপিস বাঁধাকপি ৩০-৩৫ টাকা, ফুলকপি ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। প্রতিপিস লাউ ৩০-৪০ টাকা, জালি কুমড়া ২০-৩০ টাকায় বিক্রি করতে দেখা গেছে।
তবে সবজির দাম কিছুটা কমলেও অপরিবর্তিত শাকের বাজার। প্রতি আটি (মোড়া) লাল শাক ৭-১০ টাকা, মুলা শাক ৮-১২ টাকা, পালং শাক ১৫-২০ টাকা, কুমড়া শাক ২০-২৫ টাকা, লাউ শাক ২৫-৩০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে এসব বাজারে।
মাছের বাজারে অপরিবর্তিত রয়েছে মাছের দাম। বাজারে প্রতিকেজি (এক কেজি সাইজ) ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৮০০-৮৫০ টাকায়, ৮০০-৯০০ গ্রাম ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ৬৫০-৭০০ টাকা কেজি দরে। এছাড়া কাচকি বিক্রি হচ্ছে ২৫০-৩০০ টাকা, মলা ৩০০-৩৫০ টাকা, ছোট পুঁটি (তাজা) ৪০০-৫০০ টাকা, শিং ৩০০-৫৫০ টাকা, পাবদা ৩০০-৪০০ টাকা, চিংড়ি (গলদা) ৪০০-৬৫০ টাকা, বাগদা ৪৫০-৭০০ টাকা, হরিনা ৩০০-৪৫০ টাকা, রুই (আকারভেদে) ২৫০-৩৫০ টাকা, মৃগেল ২০০-২৮০ টাকা, পাঙাস ১২০-১৩০ টাকা, তেলাপিয়া ১৩০-১৫০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সপ্তাহের ব্যবধানে দাম বেড়েছে ব্রয়লার মুরগীর। এসব বাজারে প্রতিকেজি বয়লার ১২৫-১৩৫ টাকা, লেয়ার ১৮০-১৯০ টাকা, সাদা লেয়ার ১৬০-১৭০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। দেশী মুরগী ৩৮০ থেকে ৫৫০ টাকা। লাল ডিম প্রতিডজন ১০০ টাকা, সাদা ৯৫ টাকা, হাঁসের ডিম ১৩০-১৪০ টাকা, দেশি মুরগির ডিম ১৪০-১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। তবে অপরিবর্তিত আছে গরু ও মহিষের গোশত, খাসি ও বকরির গোশত।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ