শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে লাগামহীন পেঁয়াজের দাম

স্টাফ রিপোর্টার: বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দিয়েছে ভারত। ঘাটতির অজুহাতে বাংলাদেশকে পেঁয়াজ না দিলেও মালদ্বীপকে ঠিকই পেঁয়াজ দিচ্ছে ভারত। নিজের দেশে ঘাটতি থাকায় ‘আমদানি করে’ মালদ্বীপে পেঁয়াজ রফতানির সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত সরকার। পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ায় দেশের পেঁয়াজের বাজারে চলছে অস্থিরতা। একশ্রেণির ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিজেদের মতো করে নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যটির মূল্য দিনে দিনে বাড়িয়েই চলেছে। সরকারের নানামুখী নজরদারি কিংবা কঠোর হুঁশিয়ারি কোনো প্রচেষ্টাই দাম নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না। এই অস্থিরতার জন্য একে ওপরকে দায়ী করে চলেছে। এমতাবস্থায় ব্যবসায়ীদের পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানির অনুমোদন দিয়েছে সরকার। এদিকে মন্ত্রীর অসংলগ্ন কথা-বার্তা পেঁয়াজের দাম বাড়াচ্ছে বলে মনে করছেন সাধারণ ক্রেতারা। তবে মন্ত্রণালয় বলছে পেঁয়াজ আমদানির বড় চালান এখনো দেশে আসেনি। আসলে দাম কমবে। তাই এখনো পর্যন্ত নিয়ন্ত্রণহীন বাজারে লাগামহীন পেঁয়াজের দাম।
দেশের বাজারে প্রতিদিন বাড়ছে পেঁয়াজের মূল্য। উঠতে উঠতে এক কেজি দেশি পেঁয়াজ গত শুক্রবার বিক্রি হয়েছে ১৬০ টাকা দরে। কারও কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই। কারও কোনও নির্দেশনাও মানছেন না ব্যবসায়ীরা। এই নৈরাজ্যের জন্য ব্যবসায়ীরা একজন আরেকজনকে দায়ী করছেন। খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পাইকারি ব্যবসায়ীদের কারণে পেঁয়াজের মূল্য বেড়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন আমদানিকারকরা কারসাজি করে মূল্য বাড়িয়েছেন। আর আমদানিকারকরা বলছেন, পেঁয়াজের বাজারে সিন্ডিকেট কাজ করছে। এই সিন্ডিকেটের কারণেই পেঁয়াজের বাজারে নৈরাজ্য সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে পেঁয়াজের অস্বাভাবিক মূল্য বাড়ায় নাভিশ্বাস উঠেছে সাধারণ ক্রেতাদের। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বেসরকারি ২/৩টি ব্যবসায়িক গ্রুপকে দিয়ে পেঁয়াজের বড় চালান আনার উদ্যোগ নিলেও তা আজও দেশে পৌঁছায়নি। ওই পেঁয়াজ কবে নাগাদ আসবে, তা ঠিক করে বলতে পারছেন না কেউই। এ অবস্থার মধ্যে গত শুক্রবার রংপুরে এক অনুষ্ঠান শেষে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশী বলেছেন, পেঁয়াজের মূল্য ১০০ টাকার নিচে আসার সম্ভাবনা আপাতত নেই।
এ ব্যাপারে একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মচারী মারুফ হাসান বলেন, এমনিতেই বাজার অস্থির। তার ওপর মন্ত্রীদের নানা ধরনের মন্তব্য বাজারকে আরও অস্থির করে তুলেছে। মন্ত্রী যখন বলেন পেঁয়াজের কেজি ১০০ টাকার নিচে নামবে না, তখন কেন ব্যবসায়ীরা মূল্য কমাবেন? তাদের দায়িত্ব বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। তারা যখন সেই দায়িত্ব পালন করতে পারছেন না তখন উচিত চুপচাপ থাকা। তারা তা না করে বাজার অস্থির করার মসলা মেশাচ্ছেন ।
এদিকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়া এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, তাদের দেশে পেঁয়াজের সংকট থাকা সত্ত্বেও মালদ্বীপে পেঁয়াজ রফতানি করবে ভারত। এতে পরিমাণেরও কোনো হেরফের হবে না। আগে দেশটিতে যে পরিমাণ পেঁয়াজ রফতানি হতো সেই পরিমাণই রফতানি করা হবে। মালদ্বীপে নিযুক্ত ভারতীয় মিশন রোববার এক টুইট বার্তায় জানায়, ‘আমরা আমাদের বন্ধু মালদ্বীপকে আশ্বস্ত করতে চাই যে, টানা দাম বৃদ্ধি ও দেশে এক লাখ টন পেঁয়াজের ঘাটতি থাকা সত্ত্বেও মালদ্বীপে পেঁয়াজ রফতানি করতে চায় ভারত। চাহিদা মেটাতে এক লাখ টন পেঁয়াজ আমদানি অব্যাহত থাকবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন ভারতের খাদ্যমন্ত্রী রাম বিলাস পাসওয়ান।
গত ২৯ সেপ্টেম্বর ভারত পেঁয়াজ রফতানি পুরোপুরি বন্ধ করে দেয়ায় বাংলাদেশের বাজারে হু হু করে বেড়ে যায় পেঁয়াজের দাম। বর্তমানে কেজি প্রতি পেঁয়াজ বর্তমানে ১৩০ থেকে ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
ভারত বাংলাদেশে পেঁয়াজ রফতানি বন্ধ করে দেয়ার বেশ কিছুদিন থেকে পেঁয়াজের বাজারে অস্থিতিশীলতা বিরাজ করছে। এ অবস্থায় বিকল্প উৎস মিয়ানমার, মিসর, চীন ও তুরস্ক থেকে থেকে পেঁয়াজ আমদানির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এমনকি ব্যবসায়ীরা যদি চায় পাকিস্তান থেকেও পেঁয়াজ আমদানি করতে পারে বলে জানিয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। ইতোমধ্যে মিয়ানমার, মিসর, চীন ও তুরস্ক থেকে বেশ কিছু পেঁয়াজ আমদানিও করা হয়েছে।
এদিকে পাকিস্তানের একটি ইংরেজি দৈনিক খবর প্রকাশ করেছে যে, অন্তত ১৫ বছর পর পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করছে বাংলাদেশ। ট্রেড ডেভেলপমেন্ট অথরিটি অব পাকিস্তানের উদ্ধৃতি দিয়ে খবরে বলা হয়েছে বাংলাদেশের তাসো এন্টারপ্রাইজ করাচির রোশান এন্টারপ্রাইজের নিকট থেকে ৩০০ টন পেঁয়াজ আমদানি করছে।
এ বিষয়ে দায়িত্বরত সচিব মো. ওবায়দুল আজম জানান, পেঁয়াজ আমদানি যে কেউ যেকোনো দেশ থেকে করতে পারে। আমরা সুনির্দিষ্ট কোনো দেশের কথা বলে দেইনি। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে আমরা কোনো দেশের নাম সুনির্দিষ্ট করে দেইনি। তাহলে যদি ব্যাবসায়ীরা পাকিস্তান থেকে পেঁয়াজ আমদানি করতে চায় সেটা কি তারা পারবে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটাতে কোনো বাধা নেই। আমদানি নীতি অনুযায়ী যে দেশ থেকে আনতে চায় আনবে।
এদিকে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। ভারত রফতানি বন্ধের পর থেকে গতকাল সোমবার পর্যন্ত এই অনুমতি নেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে প্রায় পাঁচ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে। আমদানির অপেক্ষায় আছে ৬১ হাজার টন।
আমদানির অনুমতি নেওয়া হলেও এখনো পেঁয়াজের বড় চালান দেশে এসে পৌঁছায়নি। আবার ঘূর্ণিঝড়ের কারণে গত কয়েক দিন বন্দর থেকে পেঁয়াজ খালাস ব্যাহত হয়েছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় বাজারে দাম বেড়ে গেছে। কয়েক দিনের ব্যবধানে প্রতি কেজি পেঁয়াজের দাম খুচরায় ৩০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।
চট্টগ্রামের খুচরা বাজারে মিয়ানমার থেকে আমদানি হওয়া পেঁয়াজ ১৩০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। ঘূর্ণিঝড়ের আগে মিয়ানমারের পেঁয়াজের দাম খুচরায় ১০০ টাকায় নেমে এসেছিল। অন্যদিকে, মিসর ও চীন থেকে আমদানি হওয়া পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকায়। এই পেঁয়াজ কেজিপ্রতি ৮৫ টাকায় নেমে এসেছিল।
খাতুনগঞ্জের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ ইদ্রিস বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে পেঁয়াজ খালাস হয়নি। তাতে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে। ঝড় কেটে যাওয়ায় এখন পেঁয়াজের সরবরাহ বাড়লে দামও কমবে। দাম বাড়ার কারণ সাময়িক।
চট্টগ্রাম বন্দর সূত্রে জানা গেছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতে গত শনিবার সব জাহাজ জেটি থেকে সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। গতকাল রোববার দুপুরের পর থেকে জেটিতে জাহাজ ভেড়ানো শুরু হয়। আজ সোমবার পর্যন্ত ১০টি জাহাজ ভেড়ানো হয়। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মোট দুদিন জাহাজ থেকে পেঁয়াজ খালাস ব্যাহত হয়।
বন্দর সচিব ওমর ফারুক বলেন, ঝড়ের কারণে সাময়িক ব্যাহত হলেও জাহাজ থেকে কনটেইনার খালাস পুরোদমে চলছে। পেঁয়াজবাহী কনটেইনার খালাসে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে।
চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের উদ্ভিদ সংঘ নিরোধ কেন্দ্র জানায়, চট্টগ্রাম থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৬৬ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি (আইপি) নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে বন্দর থেকে খালাস হয়েছে ৪ হাজার ৮১৫ টন। আমদানির অপেক্ষায় আছে প্রায় ৬১ হাজার টন।
সবচেয়ে বেশি পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে মিসর থেকে। দেশটি থেকে ৫৮ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির অনুমতি নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এর মধ্যে এস আলম গ্রুপের ৫৫ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানির ঋণপত্র খোলা হয়েছে। এ ছাড়া বন্দর দিয়ে মিয়ানমার, তুরস্ক, চীন, পাকিস্তান থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হচ্ছে।
এদিকে গত শুক্রবার থেকে নিজেদের বেঁধে দেওয়া মূল্যে পেঁয়াজ বিক্রি করবে শ্যামবাজার বণিক সমিতি। পাইকারি ব্যবসায়ীরা মিয়ানমারের পেঁয়াজ প্রতিকেজি ৮০ থেকে ৮৫ টাকায় বিক্রি করবেন। এছাড়া মিশর, তুরস্ক ও চীনের পেঁয়াজের কেজিপ্রতি ৫৫ থেকে ৬০ টাকায় বিক্রি করা হবে। এ ঘোষণা দিলেও তা বিক্রি হচ্ছে না। বাড়তি দামেই ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে। রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে এখনো পেঁয়াজ চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে।
রাজধানীর শাজাহানপুর এলাকার খুচরা ব্যবসায়ী আলতাফ হোসেন বলেন, আমরা যে মূল্যে কিনি তার সঙ্গে সামান্য মুনাফা যুক্ত করে বিক্রি করি। সিন্ডিকেট বুঝি না। করিও না। এর সঙ্গে খুচরা ব্যবসায়ীরা জড়িত নন।
শ্যামবাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী আশরাফ হোসেন বলেন, আমরা কেজিতে ২ থেকে ৫ টাকা ব্যবসা করি, এর বেশি নয়। কোনও সিন্ডিকেটের সঙ্গে আমরা জড়িত নই। আমদানিকারকরা একটি নির্দিষ্ট দরে প্রতিমণ পেঁয়াজ বিক্রি করেন। আমরা সেই দরেই কিনি। এখানে হেরফের করার কোনও সুযোগ নেই।
আমদানিকারক হাজী মোহাম্মদ মাজেদ জানান, মিয়ানমার থেকে পেঁয়াজ কিনি। ওই দেশের ব্যবসায়ীরা যে দর ঠিক করে দেন, সেই দরেই আমাদের কিনতে হচ্ছে। পেঁয়াজের বাজার অস্থির করার পেছনে আমাদের দায়ী করাটা ঠিক হবে না।
এ বিষয়ে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) বলছে, একদিকে সরকারের ব্যর্থতা, অন্যদিকে ব্যবসায়ীদের অতি মুনাফার লোভ। এসব কারণে পেঁয়াজের বাজারে নৈরাজ্য নেমে এসেছে। সরকার আগে থেকে ব্যবস্থা নিলে এমন পরিস্থিতি হতো না।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানায়, আগামী কয়েক দিনের মধ্যে মেঘনা, সিটি ও এস আলম গ্রুপের আমদানি করা পেঁয়াজ দেশে পৌঁছাবে। নবেম্বরের শেষ সপ্তাহে দেশও নতুন পেঁয়াজ উঠতে শুরু করবে। ভারতের নিষেধাজ্ঞা উঠে গেলে দেশের বাজারে পেঁয়াজের মূল্য কমবে।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ