বৃহস্পতিবার ০২ মে ২০২৪
Online Edition

ঘটকালী

আমাতে জুলজালাল : মুনিরা সবে মাত্র আলেম পরীক্ষায় ‘এ’ পাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ফাজেল ক্লাসে পদার্পণ করেছে। যখন কবির সাহেবের এ মেয়েটি জন্মেছিল তখন খাঁ বংশের সৌভাগ্য শশী কৃষ্ণ পক্ষের শেষ কানায় এসে পৌঁছেছে। কৃষ্ণ পক্ষের ঘন তমসকে দূরীভূত  করে বংশকে আলোকজ্জ্বল করার জন্যই হয়ত মেয়েটির জন্ম। তাইতো কবির খাঁ আদর করে মেয়েটির নাম রেখেছিল মুনিরা। উজ্জ্বল চন্দ্রের মতোই ওর রূপ, নামের অর্থের সাথে অপূর্ব মিল। বড়ই সুন্দরী মেয়ে মুনিরা।
এত কম বয়সে মেয়েটিকে বিবাহ দেবে এমন আশা করেনি কবির সাহেব। কিন্তু স্ত্রী ফরিদার বড়ই ইচ্ছা একটা উচুঁ ঘরে বনেদী পরিবারে তাড়াতাড়ি মেয়েকে বিবাহ দেবার। কারণ অনেকদিন ধরে কবির সাহেবের শরীরটা ভাল যাচ্ছে না, ব্যবসাটাও যেন ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে পড়ছে। তাই সময় থাকতে নিজের যা কিছু সহায় সম্পত্তি বাবা চান মিঞার কাছ থেকে পেয়েছে তার উপর নির্ভর করে মুনিরাকে বিবাহ দেবে স্থির করেছে ফরিদা। এছাড়া চান মিঞার বড়ই ইচ্ছা একটি সুশিক্ষিত নাতি জামাই পাবার। মনের মতো জামাই পেলে মুনিরাকে পাত্রস্থ করতে যে টাকা পয়সা লাগুক সবই যোগাড় করবেন চান মিঞা। টাকা পয়সার প্রাচুর্য রয়েছে চান মিঞার। তিনটি ছেলের দুটি বিদেশে পাড়ি জমিয়ে সেখানেই সেটেলড্ হয়েছে। বড় ছেলে বৌর মাত্র একটি শিশু সন্তান। নিজেরা স্বামী -স্ত্রী দুজনে প্রায়ই হাসপাতালে দিন কাটায়। একমাত্র মুনিরাই নানা-নানীর অতৃপ্ত হৃদয়ে কিছুটা সুখ-আনন্দ জোগায়। নানার বিরাট বাড়িটি বলতে গেলে মুনিরাই পাহাড়া দিয়ে বেড়ায়। মাদ্রাসা থেকে ফিরে এসে নানা’র ড্রইং রূম সাজান, সাধের বাগানের যতœ নেয়া ইত্যাদি সব কাজই করে মুনিরা। যে কাজের ঝিরা আছে সেগুলি পান চিবিয়েই সময় কাটায়। মুনিরার হাতের ছোয়ায়ই যেন চান মিঞার স্বপ্নপূরীটা জীবন নিয়ে টিকে আছে। নানা-নানীর প্রাণের ধন মুনিরা। তাই চান মিঞা বড় সোহাগ করে, ঘটা করে নাতীকে বিবাহ দিতে চায়। ঠাট্টা করে মুনিরাকে বলে, নানু, তোমাকে জামাই বাড়ী পাঠাম ুনা, তোর জামাইকে আমার বাড়িতেই রাখুম, কেমন হবে?
ধ্যাৎ, কী যে বলে নানু, বলে দূরে পালায় মুনিরা। ফরিদা বড়ই উদ্বিগ্ন মুনিরার বিবাহ নিয়ে। ও পাড়ার পেশাদার ঘটক ইয়াসীন খাঁ। ছয় ফুটের বেশী লম্বা পাতলা গড়নের ইয়াসীন খাঁ পরে আধা ছেঁড়া স্যান্ডেল, মাথায় তেল চিটচিটে টুপি আর বগলে তালি দিয়ে চলনসই করা ছাতাটা নিয়ে এ গ্রাম ও গ্রাম ঘুরে বেড়ায়, বর কনে খুঁজে। তার ব্যাগে জমা আছে প্রায় অর্ধেক শতক বিভিন্ন বয়সের পাত্র-পাত্রীর জীবনবৃত্তান্ত ও ছবি। তাকে খবর দিয়েছিল ফরিদা। ইয়াসীন খাঁ হাজার খানেক টাকা নিয়ে পাত্রের খোঁজ দেবে বলে চলে গেছে বেশ কিছুদিন হল। অবশেষে খবর এসেছে ঘটক ইয়াসীন খাঁ প্রতারণার দায়ে জেল হাজতে গেছে। ফরিদা বড়ই কষ্ট পেয়েছে ইয়াসীন খাঁর দুঃসংবাদ শুনে। আহা বেচারা গরীব মানুষ! সারা গ্রাম ঘুরে কত আইবুড়ো মেয়ের বিবাহ দিল, কত পাত্রের দ্বিতীয় বিবাহ না করার প্রতিজ্ঞাকে তুড়ি মেরে ভেঙ্গে দিয়ে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ করল এই ঝানু ঘটক। ঘটকদের প্রতারণাই আসল সম্বল। তাই বলে তাকে হাজতে পাঠাতে হবে? মনে অনেক দুঃখ পেল ফরিদা। কিন্তু যারা প্রতারণার স্বীকার হয়েছে তারা যে কত কষ্ট পেয়েছে তা এখনো অনুমান করতে পারেনি ফরিদা।
ঘটক ইয়াসীন খাঁর উপর যে নির্ভরতার আশা ছিল তা শেষ। এখন ফরিদা মনের মতো কাউকে পেলেই আব্দার জানায়, দাওনা ভাই, আমার মুনিরার জন্য একটা ভাল পাত্র যোগাড় করে। সবাই মাথা নেড়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিয়ে ফরিদার উষ্ণ হৃদয়কে কিছু সময়ের জন্য হলেও শীতল করে দেয়। যেন শরতের সাদা মেঘের বৃষ্টি, এই আছে, এই নেই।
মুনিরা দিন দিন বড় হতে চলছে চোখ এড়ায় না মুনিরার ফুফু কুসুমের। কুসুমের যখন বিবাহ হয় তখন সতেরো উত্তীর্ণ হয়ে সে আঠারোয় পা দিয়েছিল, তখন সে কলেজে ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে এবং তখন তার চিত্তক্ষেত্রে যৌবনের প্রথম দক্ষিণ বাতাস বইতে আরম্ভ করে কত অলক্ষ্য দিক হতে কত অনির্বচনীয় গীতে এবং গন্ধে, কম্পনে এবং মর্মরে তার তরুণ জীবনকে উৎসুক করে তুলেছিল, তা এখনো মনে হলে বুকের ভিতর দীর্ঘ নিঃশাস ভরে ওঠে। কুসুম চায়না তার ভাইজিটির জীবনও এমন দীর্ঘ নিঃশাসে ভরে উঠুক। কুসুমও চিন্তা ভাবনা করছে মুনিরার বিবাহ নিয়ে।
সেদিন ফরিদা এসেছিল কুসুমের বাসায় বেড়াতে। ননদ ভাবী অনেক কথা হল, কাজের কথা, অকাজের কথা, নানা কথা। এক সময় ফরিদা কুসুমকে বললো আপা, আপনিতো আল্লাহর ইচ্ছায় তিনটি মেয়েই ভাল পাত্রস্থ করলেন, দুই জামাই ইঞ্জিনিয়ার এক জামাই ডাক্তার। বাকি যে দুটি আছে সে দুটির কপালে আশা করি এমন জামাইর আল্লাহ ব্যবস্থা করবেন।আমার মুনিরার জন্য ওদের মত একটি ভাল ছেলে যোগাড় করে দেন না, বড়ই আব্দারের সুরে বলল ফরিদা।
হ্যাঁ, কুসুম তার তিনটি মেয়েকেই বিনা ঝামেলায় বিনা খরচায় পাত্রস্থ করতে পেরেছে। এজন্য সে সব সময় আলাহর শুকরিয়া জ্ঞাপন করে। দেখতে মেয়েগুলো যেমন বাগানে প্রষ্ফুটিত কুসুমের মত, তেমনি সবগুলোই মেধাবী। ওরা তিন বোনই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনার্সসহ মাষ্টার্স শেষ করেছে। চাল চলনে বেশ মার্জিত, মুখে নেকাব পরেই বিশ্ববিদ্যালয় শেষ করেছে। কিন্তু মুনিরা লেখাপড়া করছে মাদ্রাসায়, দেখতে চাল চলনে ভাল মেয়েটি। ওর জন্য কি এমন ইঞ্জিনিয়ার ডাক্তার পাত্র মিলবে মনে মনে ভাবে কুসুম।
কুসুম তার চিন্তার শেষ কিনারায় মনে হয় এসে দাঁড়িয়েছে। সেদিন তার পুরাতন বান্ধবী টেলিফোনে তার চতুর্থ মেয়েটির জন্য একটি পাত্রের খবর দিয়েছে। কুসুম পাত্রের পরিচয় জানতে চাইলে যার কথা বলেছে তার সবাইকে কুসুম আগে থেকেই চেনে। ওরা সব ভাইগুলো মাদ্রাসা থেকে উচ্চ শিক্ষা নিয়ে ইউনিভার্সিটি শেষ করেছে।
 সব ভাইগুলো প্রতিষ্ঠিত। মেজ ভাই মোস্তাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। সবচেয়ে ছোট রুহুল ইসলামী ব্যাঙ্কের সিনিয়র অফিসার। তার জন্য রুহুলের মা ও বোনেরা পছন্দ করেছে সাবিনাকে।
করতের আকাশে চতুর্দশীর চাঁদটা বেশ উপরে উঠেছে। সাদা সাদা মেঘগুলো ধরণীর বুকে আলো -ছায়ার খেলা খেলছে। খোলা উঠানে বসে কুসুম ও কাদির সাহেব বেশ প্রিয় আলাপে মগ্ন। এরই মধ্যে কুসুম কাদির সাহেবের কাছে বেশ আগ্রহ নিয়ে মেয়ের বিবাহের প্রস্তাবটার খবর দিল।
কাদির সাহেব নিজে পি.এইচ.ডি করতে না পারায় সারাটি জীবন আক্ষেপ করেছে। তার বড় ইচ্ছা একটি ডক্টরেট ধারী জামাইয়ের হাতে সাবিনাকে তুলে দেবে। স্ত্রী কুসুম তার স্বামীর ইচ্ছা জানে। এ অবস্থায় যখন স্ত্রী কুসুম তার কাছে এ প্রস্তাব দিল তখন সে কি বলবে ভেবে পাচ্ছিল না।
কাদির সাহেবের বড় সংসারটি চালাবার ভার কুসুমের উপর। দিনরাত্রি নানা কৌশলে ও পরিশ্রমে এই পরিবারের সমস্ত অভাব তাকে গোপন মিটিয়ে চলতে হয়। মাসের শেষে বেতনের টাকা ক’টি এনে কুসুমের হাতে তুলে দিয়ে কাদির সাহেব খালাশ। দিনরাত নানা কৌশল ও পরিশ্রম করে টানাটানি করে চলতে থাকলে মানুষকে বড় কঠিন করে তুলে- তার কমনীয়তা লোপ পায়। কুসুমের মেজাজটা তাই বয়স বাড়ার সাথে সাথে অনেকটা কঠিন হযে পড়েছে। সে কারণে কাদির  সাহেব স্ত্রী কুসুমের ইচ্ছার বিপক্ষে কখনো কোন কথা বলে সংসারে অশান্তি সৃষ্টি করতে রাজি নয়। তাই কাদির সাহেব মনের কথা গোপন রেখে কুসুমকে বললো, ছেলেটাতো মন্দ নয়, দেখ জিজ্ঞেস করে সাবিনার কি ইচ্ছা।
কুসুমের মেয়ে সাবিনার কাছে কথাটা পৌঁছাল সেদিন। কিন্ত তার একই কথা, এত তাড়াতাড়ি বিবাহ কেন? কমপক্ষে অনার্সটাতো শেষ করি।
এমন ছেলেতো আর সবসময় জুটে না মা, তুই রাজী হয়ে যা।
মা, তুমি যে কি বল, ভবিষ্যতের কথা যা তোমার আমার কারোই জানা নেই, তা নিয়ে বৃথা চিন্তাভাবনা করা কি ভাল কাজ? সে সময় আল্লাহ যা ফয়সালা দেবেন তাই আমরা মেনে নেব।
 সাবিনা যখন কোন প্রকারে রাজি নয় তখন আর কী করা। তবে এমন ছেলে হাত ছাড়া করা ঠিক নয়। হঠাৎ তার মাথায় খেয়াল এল, তাহলে মুনিরার জন্য প্রস্তাবটা দিলে মনে হয় ভাল হবে, ভাবছে কুসুম।
কুসুম স্বামী কাদির সাহেবকে বলল, দেখ সাবিনা রাজি নয়। আমার মনে হয় আমাদের মুনিরার জন্য প্রস্তাব পাঠালে ভাল হয়। ওরা নিশ্চয়ই রাজি হবে। তাছাড়া ওদের উপর তোমার যেমন বিশ্বাস  ও শ্রদ্ধাবোধ রয়েছে তাতে ওরা তোমার কথা ফেলবে না।
তাতো ঠিকই কিন্তু ... ... ... ...।
কিন্তু আবার কি? তুমি মোস্তাকের সাথে আলাপ করো, বলে কুসুম।
কাদির সাহেব ভাবতে পারছে না কী করবে সে। সে তো আর পাকা ঘটক নয় যে অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। যদি বিয়ে হয়ে যায়তো ভাল, নয়তো তার জন্য বেইজ্জতীর কাজ হবে। এখন কাদির সাহেবকে কুসুমের ঘরকন্নার অধীনে চব্বিশ ঘন্টা বাস করতে হয়। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কথা বলবার সাহস এখন আর কাদির সাহেবের নেই। কুসুমের ইচ্ছার একেবারে উল্টা মুখে চলবার চেষ্টা করলে কিছুটা হলেও বিপদে পড়তে হবে। তার চেয়ে পাশ কাটিয়ে একটু ঘুরে গেলে  বরং সুবিধা মতো ফল পাওয়া যাবে। বাতাস যেদিকে বইছে সেদিকেই জাহাজের পাল আড় করে রাখাইতো বুদ্ধিমানের কাজ।
স্ত্রীর কথায় সায় দিয়ে সেদিনই পাত্রের বড় ভাই মোস্তাকের সাথে আলাপ করল কাদির সাহেব। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজীতে অধ্যাপনা করেন মোস্তাক। কাদির সাহেবকে  সে ছোটবেলা থেকেই চিনে। কাদিরের প্রতি তার প্রচুর ভক্তি, বিশ্বাস জন্মেছে। কেন সে প্রসঙ্গ এখানে না বলাই ভাল। কাদির সাহেবের ফোন পেয়ে মোস্তাক বড়ই আনন্দিত। তার বিশ্বাস কাদির সাহেব যে মেয়ের প্রস্তাব দিয়েছেন সে অবশ্যই সৎ ও যোগ্য পাত্রী হবে।
কাদির সাহেব বলেছিলেন, পাত্রীর জীবনবৃত্তান্ত ও ছবি পাঠিয়ে দেই।
না, তার দরকার হবে না। আপনি যে বর্ণনা দিয়েছেন, তাছাড়া আপনার আত্মীয় অবশ্যই ভাল হবে আমার বিশ্বাস। তাছাড়া আপনি স্নেহ করেই আমাদেরকে আরো কাছে নিতে চান। আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন, আমি সবাইকে ম্যানেজ করবো। উত্তর দিয়েছিল মোস্তাক।
কিন্তু ছেলে মেয়ে দু’জনারই তো একটু দেখাশুনা দরকার। হাদিসেও এ বিষয়ে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কী বল তুমি? জিজ্ঞেস করে কাদির।
হ্যাঁ ঠিক আছে, আঙ্কেল, আগামী মাসে আমিও ছয় মাসের জন্য বিদেশ যাব। যা করতে হয় এ মাসেই করব, উত্তর দেয় মোস্তাক। আমরা আগামী বুধবার আসি। আপনার কি কোন সমস্যা আছে? না, কি সমস্যা, যারা যারা ইচ্ছা কর এস, তবে অবশ্যই রুহুলকে নিয়ে আসবে। কাদির সাহেব টেলিফোনে জানিয়ে দেয় মোস্তাক কে।
মোস্তাক বিবাহ করেছে  মালয়শিয়া বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যয়নকালে মালয়েশিয়ার এক মেয়েকে। সে লেখাপড়া শিখেছে মিশরে, ডাক্তার মেয়েটি এদেশে এসে নিজেকে খাপ খাইয়ে নেয়ার জন্য ভীষণ চেষ্টা করছে। মোস্তাকের অন্য ভাইদের স্ত্রীরাও কেউই বাড়ি থাকে না। মোস্তাকের বাবা মার ইচ্ছা, ছোট ছেলে রুহুলকে বিবাহ করিয়ে বৌকে বাড়িতে রাখবে। বাড়িতে চাকর ঝির অভাব নেই তাদের। রুহুলের বৌটা ঘরে থাকলে তাদের শেষ জীবনটা কাটবে ভাল, এটাই তাদের চিন্তা।
এতদিনে রুহুল তাদের পারিবারিক জীবন সম্পর্কে বেশ জ্ঞান অর্জন করেছে। “বর্তমানকালে আমাদের দেশের সংসারটা চারদিকেই সঙ্কুচিত; মনন সাধনের বেলায় মনকে জ্ঞান ও ভাবের উদার ক্ষেত্রে ব্যপ্ত করে রাখা আর ব্যবহারের ক্ষেত্রে তাকে সেই সংসারে অতি ছোট মাপে কৃশ করে আনা” সহ্য করতে রুহুল নারাজ। যে স্ত্রীকে আইডলের পথে সঙ্গিনী করবে সেই স্ত্রী ঘরকন্নার গারদে পায়ের বেড়ী হয়ে থাকবে এবং প্রত্যেক চলাফেরায় ঝংকার দিয়ে পিছনে টেনে রাখবে, এমন দুর্গতি রুহুল স্বীকার করতে নারাজ ছিল। কিন্তু তার মনের এ ভাব সংসারের কেউই বুঝতে চেষ্টা করেনি।
পূর্ব কথামতো মোস্তাক তার বিদেশিনী স্ত্রী ও বোনদের থেকে দ’ুজনকে নিয়ে এসে হাজির হল চান মিঞা হাজির বাসায়। পাত্র নিয়ে আসেনি দেখে চান মিঞা হাজির বাসায় সবার মুখ মলিন। তাহলে কি ছেলের এখানে বিবাহের ইচ্ছা নেই? সবচেয়ে বেশি মন খারাপ কুসুমের। কুসুম মোস্তাকের কথাবার্তায় সুনিশ্চিত ছিল যে তারা মেয়ে দেখে এনগেজমেন্ট করবে। মেয়েকে না পছন্দ করার কিছু নেই। এমন মেয়ে পছন্দ করবে না এ বিশ্বাস করতে পাওে না কুসুম। তাহলে পাত্র এল না এখন কী হবে? ভাবছে কুসুম।
মোস্তাক কাদির সাহেবকে বলল, আপনারা মোটেই চিন্তা করবেন না। ও আমাদের দায়িত্ব দিয়েছে, আমরা আজকে রিং পরায়ে যাব। দিন তারিখ ঠিক করে আমরা সবাই আসব। সেদিন পাত্র-পাত্রীকে দেখবে, আক্দ হবে। আমার বিশ্বাস, আমার উপর ছোট ভাই নির্ভর করে চলবে।
মোস্তাকের কথা শুনে সবাই খুশি। কিন্তু কুসুমের হৃদয়তলে একটি গোপন ঘন্টা সঙ্কেত দিতে লাগল। বর না আসায় মুখ গোমরা করে কাদিরকে আড়ালে নিয়ে বলল, কী করবা এখন? বর এল না, তার ভাইকে কনে দেখান ঠিক হবে?
তাতো ঠিক নয়। যে বিবাহ করবে সেই মেয়ে দেখবে। এটাইতো শরিয়তী বিধান- উত্তর দেয় কাদির সাহেব।
কুসুম বড় বিপদে পড়ে গেল। এত ঘটা করে মেহমানদারীর ব্যবস্থা করা হল। এখন শুধুমাত্র মহিলারা কনে দেখে চলে যাবে এটা কী ঠিক হবে? বড় ভাইতো দায়িত্ব নিয়েছে, ওকে দেখালে খুব একটা অন্যায় হবে না, মনে মনে ভাবে কুসুম। বর স্বয়ং কনে না দেখলে যে কত বিবাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়ে তা কুসুমের অজানা নয়। আল্লাহ যাদেরকে জোড়া মিলাবেন তাদের চোখে যে ধরনের করুণা ও মহব্বতের ছোঁয়া তিনি দিয়েছেন  তা অন্যদের চোখে নেই। কুসুম তো নিজেই সাক্ষী, তাকে দেখে তার ননদিনীরা তো অপছন্দ করে ফিরে যাচ্ছিল, কাদির সাহেবই তার পছন্দের কথা জানালে সবাই রাজী হয়।
অবশেষে স্বামী স্ত্রী দুজনেই রাজী হল মুনিরাকে বড় ভাই মোস্তাকের সামনে হাজির করতে।
মুনিরা বড়ই চিন্তিত। ভাবী বরকে দেখার সুযোগ হল না, এখন ইন্টারভিউ দিতে হবে বড় ভাইয়ের বোর্ডে। কোরবানীর গরুর মতো খুটিয়ে খুটিয়ে দেখবে বোনেরা। অধ্যাপক সাহেব কী সব প্রশ্ন করেন কে জানে। এসব ভাবনায় মুনিরা বড়ই বিমর্ষ। হাস্যোজ্জল চেহারায় যেন একটা ক্লান্তির ছাপ। জল নিমগ্ন মরণাপন্ন ব্যক্তির যেমন মুহূর্তের মধ্যে জীবনের সমস্ত ঘটনাবলী স্পষ্ট মনে পড়ে, তেমনি নানা বাড়ির দ্বাররুদ্ধ কক্ষে তার মনে পড়তে লাগল, সকালে নানার ডাকে ঘুম ভাঙবার কথা, ছুটির দিনে মধ্যাহ্ন নিদ্রার সময় নানীর পাকা চুল তুল দেয়ার কথা, মাদ্রাসায় বান্ধবীদের সাথে হৈচৈ করে বেড়ান । আরও কত কী। এসব হয়ত অল্পদিনে শেষ হয়ে যাবে।
মুনিরার চোখ দুটি যেন ধীরে ধীরে অশ্রুসিক্ত হয়ে উঠতে লাগল। তার দুটি করুণ চোখের অশ্রুজলের দোহাই না মেনে ফুফু কুসুম তাকে হাজির করল মোস্তাকের নেতৃত্বে মেয়ে দেখা কমিটির সামনে। কম্পিত হৃদয়ের মেয়েটিকে ঝেড়ে মুছে একখানা কালো বোরকা মুরিয়ে বসিয়ে দেয়া হল চেয়ারে। কুসুম ওকে সাহস দেয়ার জন্য পশ্চাতে উপস্থিত রইল। মোস্তাক অত্যন্ত শালীন ও নম্রভাবে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী পড়?”
বসনভূষণাচ্ছন্ন লজ্জস্তুপের নিকট থেকে বেশ কিছুক্ষণ কোনো উত্তর পাওয়া গেল না। দুই তিনবার প্রশ্ন এবং ফুফু কুসুমের নিকট থেকে পৃষ্ঠদেশে উৎসাহজনক কর তাড়নের পর মৃদুস্বরে বলল, “ফাজেল ক্লাসে পড়ি।” মোস্তাক আরও দু চারটি হালকা প্রশ্ন করল। প্রশ্ন উত্তরের ফাঁকে ফাঁকে আগত মহিলা মেহমানদের দু একজনে অতি নিবিড়ভাবে হাতের নখ, পায়ের গোছা, চুলের গোছা ইত্যাদি পর্যবেক্ষণ করে চলছিল। রৌদ্রজ্জ্বল নির্মল চঞ্চল নির্ঝরিণীর দিকে অবনত হয়ে কৌতুহলী পথিক যেমন নিবিষ্ট দৃষ্টিতে  তার তলদেশ দেখতে থাকে, মোস্তাক ও তার অন্যান্য সাথীরা তেমনি করে গভীর নেত্রে মুনিরার লাজুক অবয়ব দেখতে ছিল। পর্দার আড়ালে কিছু কচি উৎসুক ছেলে মেয়েদের অস্ফুট হাস্যধ্বনি অনুষ্ঠানটিকে কিছুটা হালকা করে তুলেছিল।
অতঃপর এই নীরব পরীক্ষা সভাটা আর অধিক্ষণ স্থায়ী হল না। পিন্ডাকার মুনিরা কোনমতে পুনশ্চ দীর্ঘাকায় হয়ে পরীক্ষা সভা ত্যাগ করে পুনরায় অন্তপুরে চলে গেল।
মোস্তাক অত্যন্ত আগ্রহ ভরে প্রকাশ্য ভাবে কুসুম ও কাদির সাহেবকে জানাল যে, কন্যাকে তাদের অত্যন্ত পছন্দ হয়েছে। তবে একটি ছবি ও লিখিত জীবনবৃত্তান্ত দিলে খুবই ভাল হয়, মা বাবা দেখবে, ছোট ভাই রুহুল একটু আগাম দেখে নিক। আপনাদের কি কোন আপত্তি আছে?
কাদির সাহেব একটি জীবনবৃত্তান্ত ও ছবি তার প্রিয় ও বিশ্বস্ত অনুজতুল্য মোস্তাকের হাতে তুলে দিল। প্রিয় ভাজন মোস্তাক অত্যন্ত বিনয়ের সাথে বলল, আঙ্কেল আমি দিন তিনেক পর বিস্তারিত জানাব।
সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময়ান্তে মেহমান বিদায় নিল। ওদেরকে বিদায় দিয়ে যখন কাদির সাহেব অন্তপুরে কুসুমের কাছে পৌঁছাল তখন এই কোলাহল পূর্ণ বাড়িটার উপর যেন একটা গভীর নিস্তব্ধতা চেপে বসেছে।
তিনদিন পরে মোস্তাক কাদির সাহেবকে অতি লজ্জিত কন্ঠে জানাল, চাচাজান, আমাকে ক্ষমা করবেন। আমার এতদিন বিশ্বাস ছিল যে আমার সিদ্ধান্তের উপর কেউ ভেটো দেবে না। আমি ছোট ভাইয়ের কাছে হেরে গেছি। আমি আগামী পরশু জার্মানী যাচ্ছি ছয় মাসের জন্য। আমাকে আমার অনিচ্ছাকৃত ত্রুটির জন্য ক্ষমা করবেন।
কাাদির সাহেব উত্তরে বললেন, তবে ওর বিবাহে আমাকে দাওয়াত দিও। সে মনে মনে ভাবল, ইয়াসীন খাঁ প্রতারণার দায়ে হাজতে, তবে প্রতারণা না করেই আমিও কারারুদ্ধ।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ