শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
Online Edition

শিক্ষার মান কি এমনিতেই তলানিতে?

ইসমাঈল হোসেন দিনাজী : সমাজের অনেক কিছুতেই ভেজাল ও নকলের দৌরাত্ম্য বেড়েছে। খাদ্যে ভেজাল। ওষুধে ভেজাল। ব্যবসা-বাণিজ্যে ভেজাল। প্রসাধনীতে ভেজাল। এমনকি প্রেম-ভালোবাসাতেও আজকাল ভেজাল জেঁকে বসেছে। বাজারে নাকি ভেজাল বা নকল বউ পর্যন্ত পাওয়া যায়। কেউ কেউ অবশ্য বিদেশ যাবার জন্য অন্যের নকল বউ সাজেন। কেউ আবার সাজেন কারুর স্বামীও। ঝামেলা বাধিয়ে বসেন কেবল ইমিগ্রেশনের বেরসিক কোনও কোনও কর্মকর্তা-কর্মচারী। অন্যথায় অনেক নকল বউ আর ভেজাল স্বামী দিব্যি বিদেশ পাড়ি দিয়ে আয়-রোজগার করছেন। অসুবিধে তেমন নাকি হয় না।
একবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক মোটামুটি নামকরা প্রফেসরের বই হাতে পড়লো। বইটিতে লেখকের নামের ডক্টরেট ডিগ্রিটা লেখা পি. এইচ. ডি. এভাবে। অবাক হলাম। ডিগ্রিটা লেখতে হবে পিএইচ.ডি. (Ph.D.) এভাবে। কিন্তু তিনি লেখেছেন ভুলভাবে। একজন প্রফেসর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিনি নিজের লেখা বইয়ে নিজের পিতৃপ্রদত্ত নামের সঙ্গে শিক্ষাগত সর্বোচ্চ ডিগ্রি ভুলভাবে লেখবেন তা কি বিশ্বাসযোগ্য ঘটনা? তবে ঘটনা একেবারেই বাস্তব।
ঘটনাক্রমে একদিন প্রফেসর সাহেব আমাদের অফিসে হাজির। ধরলাম শক্ত করে। বললাম, স্যার এটা কোন ডিগ্রি? প্রথমে টেরই পেলেন না আমি কী জিজ্ঞেস করছি। পরে যখন ‘ডোজ’ প্রয়োগ করে বোঝালাম। তখন যথারীতি প্রেসের ওপর দোষ চাপালেন। নিজের ভুলটা স্বীকার করতে চাইলেন না প্রফেসর। যেটা সাধারণত অন্যরাও করেন। কিন্তু আমিতো সহজে ছেড়ে দেবার পাত্র নই। শেষ অবধি ভুল স্বীকার করে অর্থাৎ ক্ষমা চেয়ে বিদায় নিলেন। ভদ্রলোক পরে একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরের দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
ভুয়া পিএইচ. ডি. ডিগ্রি সনদ দিয়ে নিজের নামের আগে ‘ডক্টর’ উপাধি ব্যবহার করবার অভিযোগ উঠেছে অনেকের বিরুদ্ধে। এমন অভিযোগ উঠেছিল বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান ড. মোস্তাফিজুর রহমানের বিরুদ্ধে। এ অভিযোগ অবশ্য আড়াই-তিন বছর আগের। এছাড়াও বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি পরিচালক ড. সৈয়দ আহমদও পিএইচ. ডি. ডিগ্রি কিনেছেন। এ নিয়ে বিস্তারিত রিপোর্ট হয়েছিল সেসময়।
জানা যায়, কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি কিনেছেন। ইন্ডিপেন্ডেন্ট টিভি চ্যানেলের অনুসন্ধানে এমন তথ্য বেরিয়ে আসে।
জানতে চাইলে মোস্তাফিজুর রহমান ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘আমি আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি থেকে অনলাইনে পিএইচ.ডি.করেছি। যার ক্যাম্পাস ছিল কাকরাইলে।’ কাকরাইলের সেই ক্যাম্পাস আছে কিনা জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এখন সেই ক্যাম্পাস আর নেই।’
এখান থেকে যারা তথাকথিত পিএইচ. ডি. সনদ নিয়েছেন তাঁদের ডিগ্রি তো ভুয়া বা অবৈধ। তাহলে আপনার ডিগ্রিও কি ভুয়া? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, ‘এখন কিছু বলা যাবে না। পরে বিস্তারিত লিখিত দেবো।’
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আব্দুল মান্নান এ বিষয়ে বলেন, আমেরিকায় এ ধরণের অসংখ্য ইনস্টিটিউট রয়েছে যেগুলোকে সেখানে ব্রিফকেস বা এ্যাপার্টমেন্ট ইউনিভার্সিটি বলে। এগুলো অনলাইনে ডিগ্রি বিক্রি করে। বাংলাদেশেও এ ধরণের ইউনিভার্সিটির শাখা বা এজেন্ট রয়েছে। তিনি বলেন, এসব শাখা বা এজেন্টদের কাছে যদি কোনও ধরনের ডিগ্রি চাওয়া হয় তাহলে তারা দেবে। ডিগ্রির দাম নির্ধারণ করবে। কি বিষয়ে ডিগ্রি দরকার এবং কতদিনের মধ্যে ডিগ্রি লাগবে তাও একজনের চাহিদা অনুযায়ী এসব প্রতিষ্ঠান ডিগ্রি দেয়। এমনকি যদি কারও বাড়িতে এসে ডিগ্রি দিয়ে যেতে হয় সেক্ষেত্রে বাড়তি ফি দিলে এসব প্রতিষ্ঠান ডিগ্রি দিয়ে যাবে।
টাকার বিনিময়ে এসব প্রতিষ্ঠান থেকে নেয়া সনদ কখনই ব্যবহার করা যাবে না এবং এটা অবৈধ বলে তিনি উল্লেখ করেন।
এভাবে টাকা দিয়ে ডিগ্রি কিনে নিজের নামের ওজন ভারি করবার লোকের তালিকা কিন্তু ছোট নয়। এ তালিকায় সরকারি উচ্চ পর্যায়ের বিভিন্ন লোকের নাম রয়েছে যারা এসব প্রতিষ্ঠান থেকে টাকার বিনিময়ে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি কিনে নিজের নামের আগে ডক্টরেট উপাধি ব্যবহার করছেন এবং সুযোগ সুবিধাও বাগাচ্ছেন।
আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির বাংলাদেশ স্টাডি সেন্টার থেকে পিএইচ. ডি. ডিগ্রি নিয়েছেন জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের ডাক্তার রেজোয়ানুর রহমান। তাঁর সনদ ঘেঁটে জানা যায়, তিনি ওই প্রতিষ্ঠান থেকে ২০০৮-২০০৯ শিক্ষাবর্ষে পিএইচ. ডি. সম্পন্ন করেছেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমি একটা কাজ করছি। ওই কাজ করবার পর যদি কেউ আমাকে ডিগ্রি দেয় তাহলে আমি নেবো না কেন? আমি তো বলবো না যে, এটা আমাকে দেবেন না।’
ডিগ্রি বিক্রি করে এমন প্রতিষ্ঠানের কোনও হিসেব নেই। এ তালিকায় রয়েছে প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যারা টাকার বিনিময়ে সনদ বিক্রি করে। এ প্রতিষ্ঠান থেকেই সনদ কিনেছেন অসংখ্য ব্যক্তি।
প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির উত্তরার ক্যাম্পাসে গেলে সেখানে কেয়ারটেকার ছাড়া আর কাউকে পাওয়া যায় না সাধারণত। তবে ব্যাংক একাউন্টসহ ছাত্রভর্তির অনেক তথ্যই পাওয়া যায় সেখানে। প্রিমিয়ার ইউনিভার্সিটির আরেক ক্যাম্পাস বিজয়নগরে গেলে তাঁরা এসব বিষয় অস্বীকার করেন। কোনও পিএইচ. ডি. ডিগ্রি দেয়া হয় না বলে তাঁরা জানান।
এমন প্রতিষ্ঠানগুলো একবার ধরা পড়লে অন্য নাম ধারণ করে আবার রমরমা ব্যবসা শুরু করে।
অনুসন্ধানের বিষয়ে খবর পেয়ে আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি তাদের ওয়েবসাইট বন্ধ করে দেয়। তবে বন্ধ করবার আগে সেখান থেকে সব ধরনের তথ্য অনুসন্ধান টিম জব্দ করে। এসব তথ্য ঘেঁটে বেরিয়ে পড়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তাই এখান থেকে ডিগ্রি নিয়েছেন যা দেখলে চোখ ছানাবড়া হবার অবস্থা হবে অনেকের।
এ তালিকায় ছিলেন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রকল্প পরিচালক ড. ওয়াজেদ আলী, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আরেক প্রকল্পের প্রশিক্ষণ বিশেষজ্ঞ ড. মনোয়ার হোসেন, সাবেক সংসদ সদস্য ড. নিলুফার চৌধুরী, স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের অধ্যাপক ড. হুমায়ুন কবির চৌধুরী, ভূমি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ড. শ্যামাপদ দে, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের উপসচিব ড. রবিউর রেজা সিদ্দিকী, মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের আরেক উপসচিব ড. তাজুল ইসলাম।
তালিকায় আরও ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ড. জনেন্দ্রনাথ বিশ্বাস, পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সহকারি সচিব ড. আবুল কালাম আজাদ, বিনিয়োগ বোর্ডের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. কামালউদ্দিন আহমদ, ঢাকা ওয়াসার নির্বাহী প্রকৌশলী ড. দেওয়ান মতিনুর রহমান।
দৈনিক শিক্ষা (৬ নভেম্বর, ২০১৭) এর অনুসন্ধানী রিপোর্টে জানা যায়, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সাবেক পিএস এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ এস মাহমুদ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব থাকাকালে অননুমোদিত  আমেরিকান ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষক ছিলেন। এ বিষয়ে দৈনিক সমকালে কয়েকবছর আগে প্রকাশিত রিপোর্টের শিরোনাম ছিল ‘এম.ফিল-পিএইচ. ডি. এর কারখানা’। রিপোর্টে এ এস মাহমুদের বিরুদ্ধে অবৈধ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার খবর উল্লেখ করা হয়। মাহমুদ সাহেব কয়েক বছর আগে অবসরে গেছেন। খোঁজ-খবর নিলে আরও অনেক ভুয়া পিএইচ. ডি. ডিগ্রিহোল্ডার পাওয়া যাবে আমাদের দেশে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের আশপাশেও প্রায় প্রতিদিনই এমন পিএইচ. ডি হোল্ডার দেখা যায়। এদের অনেকেই কেনা থিসিসের কপি জমা দিয়ে মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে ডক্টরেট ডিগ্রি পেয়েছেন। তাঁদেরই কেউ কেউ ডক্টরেট ডিগ্রি লেখতে যদি ভুল করেন তাহলে বিস্মিত হবার কিছু নেই। প্রকৃত পিএইচ.ডি. হোল্ডাররাই নিজেদের অর্জিত ডিগ্রিটা ভুল লেখেন। নকল বা জাল পিএইচ.ডি. হোল্ডারদের তো ভুল হতেই পারে। কী বলেন?
আজকাল প্রায়শ ভুয়া ডাক্তার বা চিকিৎসক ধরা পড়ছেন। এসএসসি পাসও করেননি। কিন্তু এমবিবিএস, এফআরসিএস এমন ডিগ্রি নামের শেষে জুড়ে দিয়ে দিব্যি ডাক্তারি করছেন। হাসপাতাল খুলে বসেছেন। এমন অবাক করা কা- আমাদের দেশে ঘটে যাচ্ছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান চালিয়ে প্রায়শ ভুয়া ডাক্তার পাকড়াও করছে। সীলগালা করছে তাঁদের ক্লিনিক ও হাসপাতাল। ভুয়া পিএইচ. ডি. ডিগ্রিহোল্ডারদের গ্রেফতার করে তাঁদের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয় না কেন?
অনেকেই পিএইচ. ডি. কিংবা বি.এসসি. এম.এসসি. ডিগ্রিসমূহের কোথায় ফুলস্টপ বসাতে হবে এনিয়ে বিভ্রান্তিতে ভোগেন, তাই তাঁরা ফুলস্টপ বাদ দিয়ে কৌশলে প্লেইনলি লেখেন। এছাড়া তাঁদের আর কী করবার থাকতে পারে! কিছুদিন আগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন রসায়নে ও অন্যজন সাহিত্যে মাস্টার্স পাস করা ছাত্র রাজধানী ঢাকা এসে গৃহশিক্ষক হবার জন্য লিফলেট ছাড়েন। তাঁরা উভয়ই শিক্ষাগত ডিগ্রি ভুলভাবে উপস্থাপন করেন। তাঁরা নিজেদের ডিগ্রি লেখেন বি,এস,সি, এম,এস,সি, এবং এম, এ, এভাবে। অথচ লেখতে হবে বি.এসসি. এম.এসসি. এবং এম.এ. এভাবে। যারা শুদ্ধ করে নিজের শিক্ষাগত ডিগ্রি লেখতে পারেন না বা জানেন না, তাঁরা ছাত্রছাত্রীদের কী পড়াবেন জানি না। তাইতো বলি, আমাদের শিক্ষার মান কি এমনিতেই তলানিতে ঠেকছে?

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ