শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

অর্থ-বিত্ত এবং বিজ্ঞান-প্রযুক্তিই সব নয়

‘সবজির চারায় দিনবদল’ আমাদের আশাবাদের কথা শোনায়। প্রতিবেদনটির দৃশ্যপট শুধু প্রাণবন্ত নয়, কাব্যিকও বটে। আকাশ কালো করে বৃষ্টি নামি নামি করছে। কৃষকরা মাঠ থেকে বাড়ির দিকে দৌড়াচ্ছেন। আবার কিছু কৃষক বাড়ি থেকে জমির দিকে ছুটছেন। রোপণকরা চারার ওপর পলিথিনের ছাউনি টেনে দিলেন। জমির পাশে জমা হওয়া পানিও সরাতে ব্যস্ত হয়ে গেলেন কয়েকজন। ঘণ্টা কয়েক ধরে বৃষ্টি চলল। সবজির চারা রোপণকারী কৃষকরা মাঠ ছাড়লেন না। বৃষ্টি থামার পর সযত্নে সরিয়ে দিলেন পলিথিনের আচ্ছাদন।
যত্ন ও মমতার এই যে দৃশ্যকাব্য, তা একদিকে যেমন উৎপাদন-সম্পৃক্ত, অন্যদিকে তা আবার মানবিক অনুভূতিসঞ্জাতও বটে। ফলে এই দৃশ্যপট আমাদের একইসাথে উপহার দিয়েছে সমৃদ্ধির ও আনন্দের বার্তা। আমাদের এই জনপদের ঐতিহ্য তো এমনই। কিন্তু ডিজিটালের এই যুগে সেই ঐতিহ্যের খবর আমরা কয়জনা রাখি? অন্যসব ফসলের চাইতে সবজির চারাগুলোকে যত্নআত্তি একটু বেশিই করতে হয়। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিবারের সবাইকে লেগে থাকতে হয় এর পেছনে। কখন বৃষ্টি হলো, রোদ নামলো, পোকায় আক্রমণ করলো, তা খেয়াল রাখতে হয়। চারাগুলো রক্ষায় নিতে হয় বিশেষ ব্যবস্থা। বীজ থেকে চারা উৎপাদন ও এর সুরক্ষার কষ্টসহিষ্ণু কাজটি করে যাচ্ছে যশোর সদর উপজেলার আবদুলপুর গ্রামের ৬৫টি পরিবার। ওই গ্রামের ২৫ একর জমিতে শুধু সবজির চারাই করা হয়। চারা বেচাকেনার কাজে আবদুলপুরে গড়ে উঠেছে বাজার। এক সময়ের দরিদ্র পরিবারগুলো এখন সচ্ছলতার মুখ দেখেছে। বলা যায়, আবদুলপুরের অর্থনীতির চাকা ঘুরিয়ে দিয়েছেন এই চারাচাষিরা।
শুধু ব্যর্থতা নয়, সাফল্যও মানব মনে নতুন ভাবনা সৃষ্টি করে। সবজিচারার যত্নআত্তি ও সাফল্যের কাহিনী তো আমরা জানলাম, সুখও অনুভব করলাম; কিন্তু মানবচারার খবর কেমন? ১৯ অক্টোবর, এই একদিনের পত্রিকার পাতায় মানব শিশুদের যে চিত্র প্রকাশিত হয়েছে, তাতে উপলব্ধি করা যায় মানবচারারা ভালো নেই। কান্নার শব্দ শুনেই দরজা খুলে তানিয়া দেখতে পান মাটিতে পড়ে থাকা একটি শিশু চিৎকার করছে। তখন রাত আটটা। শিশুটির বয়স মাত্র ১ মাস। পুলিশ শিশুটিকে পঞ্চগড় আধুনিক হাসপাতালে ভর্তি করে। পুলিশ জানায়, শিশুটির মায়ের নাম রিমু আক্তার। তিনি শিশুটিকে ফেলে রেখে চলে যান। আরো নির্মম চিত্র লক্ষ্য করা যায় শিশু তুহিনের ঘটনায়। সুনামগঞ্জের কেজাউড়া গ্রামে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে শিশু তুহিনকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। আর পরিতাপের বিষয় হলো, এই হত্যাকা-ে জড়িত ছিল পিতা আবদুল বাছিরসহ আপনজনরা। এখানে শিশু যত্ন-আত্তিতো দূরের কথা, আপন পিতার কাছে জীবনের নিরাপত্তাও পেলো না। এ ছাড়া শিশু ধর্ষণ ও নির্যাতনের ঘটনা তো সারা দেশেই লক্ষ্য করা যায়। বিষয়টি যেন মহামারির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। এসব সমস্যা থেকে তো শিক্ষিত ও উচ্চবিত্ত পরিবারের শিশুরা অনেকটা মুক্ত আছে। কিন্তু তারাও কি মানবচারা হিসেবে পরিপূর্ণ বিকাশের মতো যথাযথ যত্ন পাচ্ছে? সবজিচারাকে তো রোদ, বৃষ্টি ও পোকার প্রকোপ থেকে রক্ষার জন্য সকাল থেকে রাত পর্যন্ত যত্ন নেয়ার কষ্টকর কাজটি করে যাচ্ছেন কৃষকরা। কিন্তু মানবচারা আপন পরিবারে ও সমাজে তেমন যত্ন তো পাচ্ছে না। শিশু তো শুধু শরীরের নাম নয়। তার মন আছে, আছে আত্মাও। শিশুর শরীর, মন ও আত্মার সুসমঞ্জস বিকাশের আয়োজন আমাদের পরিবার, সমাজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কতটা আছে? শুধু অর্থবিত্ত ও প্রযুক্তি সব কিছু করতে পারে না, এসবেরও আছে সীমাবদ্ধতা। সেই সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারে সঠিক জীবনদর্শন- যা মহান স্রষ্টা আমাদরে উপহার দিয়েছেন। কিন্তু সেই জীবনদর্শন সম্পর্কে আমরা কতটা অবগত?
আমরা দরদী সমাজ চাই, চাই মানবিক আচরণ। তবে এসবের জন্য প্রয়োজন ভালো মানুষ, যা বর্তমান সভ্যতায় বেশ দুর্লভ হয়ে উঠছে। এখন তো চারদিকে চতুর মানুষ, লেখাপড়া জানা মানুষ, বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষ; কিন্তু আস্থা রাখা যায়, নির্ভর করা যায় এমন মানুষের সংখ্যা কত? ভালো মানুষ, আস্থার মানুষ চাইলেই পাওয়া যায় না; ভালো মানুষ হতে হয়, গড়তে হয়। এর জন্য প্রয়োজন হয় সঠিক জীবনদর্শন। মানুষের জীবনবোধ, মূল্যবোধ শুদ্ধ হলে একজন সাধারণ মানুষও সমাজের জন্য হতে পারে বেশ কল্যাণকর। এমন উদাহরণ আমরা লক্ষ্য করলাম মুন্সীগঞ্জে।
মুন্সীগঞ্জ পৌরসভায় সুলতান মুন্সী নামের এক ব্যক্তি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য উদাহরণ। তিনি কাটাখালি থেকে সার্কিট হাউস পর্যন্ত সড়ক ও আশেপাশের এলাকা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে তুলেছেন। সড়কের যেখানে যে সমস্যা ছিল তাও মেরামত করে দিয়েছেন তিনি। দীর্ঘ এক মাস ধরে এ কাজ করছেন তিনি। একটি ভ্যানগাড়ি, বেলচা ও কাস্তে নিয়ে প্রতিদিন পরিচ্ছন্নতা অভিযানে নামেন তিনি। একমাস ধরে কঠোর পরিশ্রম করে কাটাখালি থেকে সার্কিট হাউস পর্যন্ত পুরো সড়কটির দুইপাশের ময়লা-আবর্জনা ও ঘাস পরিষ্কার করেছেন তিনি। এখন এ সড়কে চলার সময় সবার মন জুড়িয়ে যায়। স্থানীয়রা বলছেন, সুলতান মুন্সী রাস্তাঘাট এত সুন্দর করে পরিষ্কার করেছেন যে, হাজার হাজার টাকায় শ্রমিক নিয়োগ করেও এত সুন্দর করে পরিষ্কার করা সম্ভব হতো না। তাঁর এই স্বেচ্ছাসেবার রহস্য কী?
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে সুলতান মুন্সী জানান, গুনাহ মাফের জন্য তিনি এই পরিচ্ছন্নতা অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। তিনি আরো জানান, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকা এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার কাজ করা গুনাহ মাফের একটি মাধ্যম। ইবাদতের নিয়তে কাজ করায় তাঁর কাজে কোনো প্রচার-প্রপাগান্ডা ছিল না। তাই মানুষ জানতো না তাঁর নাম। তবে যারাই জেনেছে তারাই আন্তরিকভাবে দোয়া করেছেন তাঁর জন্য। কেউ কেউ বলেছেন, নিঃস্বার্থভাবে এমন মহৎ উদ্দেশ্যে সবাই কাজ করলে দেশ সহজেই সোনার দেশে রূপান্তরিত হতে পারতো। এমন উদাহরণ থেকে উপলব্ধি করা যায়, ধর্ম-দর্শন মানবসমাজের জন্য কতটা কল্যাণকর হয়ে উঠতে পারে। শুধু গুণাহ মাফের লক্ষ্যে একজন মানুষের পরিচ্ছন্নতা অভিযান এতটা আন্তরিক ও ফলপ্রসূ হতে পারলে, সেই চেতনায় সবাই উদ্বুদ্ধ হলে তো কাক্সিক্ষত সমাজবিপ্লবও হয়ে যেতে পারে।
বর্তমান বিশ্বসভ্যতার একটি সংকট হলো আমরা সমস্যামুক্ত হতে পারছি না। মানুষ তো সমস্যা থেকে মুক্তি চায়, কিছু তৎপরতাও চালায় কিন্তু লক্ষ্য অর্জিত হচ্ছে না। তাহলে কি সমস্যা সমাধানের মতো জ্ঞান আমাদের নেই কিংবা সঠিক পথের সন্ধান নেই? কখনও কখনও তো দেখা যায়, সমাধান করতে গিয়ে আমরা সংকটের মাত্রা আরও বাড়িয়ে ফেলি। আমরা জানি জীবনে সফল হতে হলে সঠিকভাবে কাজ করতে হলে জ্ঞানের প্রয়োজন। কিন্তু জ্ঞানতো নিজে এসে ধারা দেয় না, জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এ জন্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যেতে হয়, পরিশ্রম করতে হয় এবং উত্তীর্ণ হতে হয় পরীক্ষায়। এই যে ব্যবস্থা, তা মানুষ স্বীকার করে নিয়েছে এবং দেশে দেশে গড়ে উঠেছে নানারকম শিক্ষাব্যবস্থা। কিন্তু এই শিক্ষাব্যবস্থা মানব সমাজের সমস্যা সমাধানে কতটা সফল হচ্ছে সেই প্রশ্নও বড় হয়ে উঠছে।
নানা প্রশ্নের মধ্যেও দেশে দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংখ্যা বাড়ছে, বাড়ছে ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যাও। বছর শেষে তারা পরীক্ষার মুখোমুখি হয়। এই পরীক্ষার সময় একটি শব্দ উঠে আসে, যার নাম ‘নকল’। নকলকে তো কেউ সমর্থন করেন না, কিন্তু অনেকেই আবার তা ধারণ করে ফেলেন। এটি স্পষ্ট যে, দুটি কারণে ছাত্র-ছাত্রীরা নকল করে থাকে। একটি কারণ লেখাপড়া না করা এবং অপর কারণ  নৈতিকবোধ লালন না করা। এখন নকলের সমস্যা থেকে মুক্ত হতে প্রয়োজন হবে দু’টি না’কে হ্যাঁ’তে পরিণত করা। লক্ষ্যণীয় বিষয় হলো, বিভিন্ন দেশে নকলবিরোধী তৎপরতা আছে কিন্তু তা কতটা সঙ্গত ও কার্যকর সে বিষয়ে প্রশ্ন আছে। নকল বিষয়ে নয়াদিল্লী থেকে বিবিসি একটি খবর পরিবেশন করেছে। ২১ অক্টোবর তারিখে পরিবেশিত খবরটিতে বলা হয়, পরীক্ষার হলে নকলের কারণে একাধিকবার বিশ^গণমাধ্যমের শিরোনাম হয়েছে ভারত। তবে এবার নকল ঠেকাতে অদ্ভুত এক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে ভারতে। কর্ণাটক রাজ্যে একটি কলেজের পরীক্ষায় সব শিক্ষার্থীর মাথায় পরিয়ে দেয়া হয়েছে কার্ডবোর্ডের  বাক্স, যাতে কেউ পাশের কারও খাতা দেখার সুযোগ না পায়। পরীক্ষার্থীদের বাক্সবন্দী মাথা দেখতে বেশ অদ্ভুত লাগছিল। এই ঘটনার ছবি ছড়িয়ে পড়ে অনলাইনে। এরপর শুরু হয় তীব্র সমালোচনা। শেষে এ কাজের জন্য ক্ষমা চেয়েছে কলেজ কর্তৃপক্ষ।
কর্ণাটকের হাভেরি শহরের ভগত প্রি-ইউনিভার্সিটি কলেজে গত ১৬ অক্টোবর বুধবার ওই ঘটনাটি ঘটে। ওই দিন কলেজটিতে ছিল রসায়ন পরীক্ষা। কেউ যাতে পাশের জনের খাতা দেখে লিখতে না পারে সে জন্য পরীক্ষা শুরুর আগেই শিক্ষার্থীদের মাথায় পরিয়ে দেয়া হয় কার্ডবোর্ডের বাক্স। এই ধরনের কাজ অমানবিক বলে মন্তব্য করেছেন কর্ণাটক শিক্ষাবোর্ডের উপ-পরিচালক এসসি পীরজাদা। তিনি বলেন, ‘বিষয়টি জানার পরপরই আমি নিজে ওই কলেজে গিয়েছিলাম। এরপর এটা বন্ধ করতে বলি। এ জন্য দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ তাহলে ব্যাপারটা কি দাঁড়ালো? নকল বন্ধের ব্যাপারে ভুল পদক্ষেপ নেয়ায় এখন খেসারত দিতে হচ্ছে কলেজ কর্তৃপক্ষকে।
তাহলে কি নকল বন্ধ হবে না? নকল বন্ধ না হলে তো শিক্ষার লক্ষ্য অর্জিত হবে না। নকল বন্ধের জন্য আসলে প্রয়োজন হবে শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষার স্বাভাবিক পরিবেশ, পরিবারে শিক্ষার সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা এবং শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক জাগরণ। আমরা মনে করি এটাই নকল বন্ধের সঙ্গত পথ। এ পথে সংশ্লিষ্টরা অগ্রসর হয় কিনা সেটাই এখন দেখার বিষয়।

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ