শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪
Online Edition

বাংলাদেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান

ড. দেওয়ান রাশীদুল হাসান : দেশপ্রেমের জোয়ারে বাংলাদেশের মানুষ শুধু ভাসতে শিখছে, মানুষের জীবনের দাম দিতে  শেখেনি। আমাদের ‘পারিবারিক বন্ধন’ হাজার বছরের লালিত ঐতিহ্য। শিথিল হয়ে যাচ্ছে পারিবারিক বন্ধন। বাঙালি সংস্কৃতির হাজার বছরের ঐতিহ্য যেন হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের বিবর্তনে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে অনেক কিছু নিয়ে গবেষণা হয় কিন্তু প্রবীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক অবস্থান নিয়ে তথ্য-উপাত্তভিত্তিক কোনো গবেষণার উদ্যোগ নেই। আজ নবীনরা যে রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করছে তার ৯৯ শতাংশই অবহেলিত প্রবীণদের শ্রম ও ঘামের ফসল। সামাজিক এই পরিবর্তন ও অবক্ষয়ের কারণে সবচেয়ে বেশি অবহেলার শিকার হচ্ছে প্রবীণরা। উন্নত বিশ্বে প্রবীণদের ‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসেবে বিশেষ মর্যাদা প্রদান করা হয়ে থাকে। সে সব দেশে প্রবীণরা আমৃত্যু রাষ্ট্রীয় আনুকূল্য পেয়ে থাকেন। আর আমাদের দেশে বার্ধক্য মানেই পরমুখাপেক্ষিতা আর পরনির্ভরশীলতা। এ দেশে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কোথাও প্রবীণবান্ধব পরিবেশ নেই।
বাংলাদেশে আগামী ২০৫০ সালে শিশুর চেয়ে প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা এক শতাংশ বেশি হবে। ওই সময়ে শিশুর সংখ্যা হবে ১৯ শতাংশ এবং প্রবীণ নাগরিকের সংখ্যা হবে ২০ শতাংশ। হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনালের এইজওয়াচ ইনডেক্স ইনসাইট রিপোর্ট ২০১৫ অনুসারে বিশ্বে প্রায় ৯০১ মিলিয়ন প্রবীণ মানুষ আছেন। প্রবীণ নিয়ে যদি আমরা কাজ করতে চাই বা চিন্তা করি, তাহলে আমার ছেলে বা মেয়েকেও জানানো উচিত যে, আমারও একজন বাবা ছিলেন বা মা ছিলেন বা আছেন। আগামী ২০২৫ সাল নাগাদ দেশে প্রবীণদের সংখ্যা হবে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ। ২০৫০ সালে এই সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪ কোটি এবং ২০৬১ সালে প্রায় সাড়ে ৫ কোটি প্রবীণ জনগোষ্ঠী হবে। বাংলাদেশে বর্তমানে প্রবীণদের জন্য সরকারিভাবে বিশেষায়িত হাসপাতাল রয়েছে মাত্র একটি। এর বাইরে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে গড়ে ওঠা কিছু বৃদ্ধাশ্রম মিলিয়ে খুব অল্প কিছু প্রবীণের থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। বাংলাদেশে সরকারি চাকরিতে পেনশনের আর্থিক নিরাপত্তা থাকলেও অধিকাংশ বেসরকারি চাকুরিতে সেটি নেই। এসব মিলিয়ে বার্ধক্যের জন্য যে দীর্ঘমেয়াদী প্রস্তুতি নেয়া প্রয়োজন, সেটা অনেকেই আমলে নেন না।
বিবিসি বাংলা বলছে প্রবীণ জনগোষ্ঠির জন্য সরকারের কিছু কার্যক্রম রয়েছে। সবচেয়ে বড় কার্যক্রমটি হচ্ছে বয়স্ক ভাতা, যার আওতায় সাড়ে ৩১ লাখ প্রবীণকে মাসে ৫০০ টাকা করে ভাতা দেয়া হচ্ছে। বাংলাদেশে প্রবীণদের জন্য শুধু সরকারি সাহায্যই সীমিত নয়, বেসরকারিভাবেও প্রবীণদের নিয়ে খুব বেশি কাজ হয় না। অন্ততঃ যতটা হওয়া উচিত ততটা যে হচ্ছে না, সেবিষয়ে বিশেষজ্ঞদের প্রায় সবাই একমত। বাংলাদেশে বর্তমান অবস্থার উন্নতি না হলে ভবিষ্যৎ প্রবীণ জনগোষ্ঠির জন্য যে কঠিন সময় অপেক্ষা করছে, তা বেশ নিশ্চিতভাবেই বলা যায়। তবে বিশেষজ্ঞদের কথায় এটাও স্পষ্ট যে এ অবস্থা মোকাবেলা করাও সম্ভব। আর এজন্যে সচেতনতা তৈরি, সামাজিক এবং পারিবারিক মূল্যবোধ, বিনিয়োগ ও পেশাদারিত্ব- কোন ক্ষেত্রেই ছাড় দেয়ার সুযোগ নেই।
বাংলাদেশে সরকারি চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৫৯ বছর। তবে বিচারপতিদের জন্য ৬৭ বছর এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ৬৫ বছর ও কোনো কোনো পেশাজীবিদের জন্য ৫৯ বছর। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতেও ৬০ বা ৬৫ বয়সের পর একজন মানুষকে প্রবীণ বা‘সিনিয়র সিটিজেন’ হিসাবে গণ্য করা হয়। সমাজে তাঁদেরকে বিশেষ সম্মান ও সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। জাতিসংঘ প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় কতিপয় নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। এছাড়াও জাতিসংঘ প্রবীণদের অধিকার ও তাঁদের প্রতি কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি করতে একটি বিশেষ দিনকে‘প্রবীণ দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। এছাড়াও ২০১৩ সালে ষাটোর্ধ্বদের সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণা করা হয়েছে, যার মাধ্যমে চিকিৎসাসহ নানা ক্ষেত্রে প্রবীণদের অগ্রাধিকারমূলক সুবিধা পাবার কথা। যদিও এখনো এটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে দেশে প্রায় ১ কোটি ৩০ লাখ প্রবীণ বা সিনিয়র সিটিজেন রয়েছেন। আমাদের দেশে সাধারণত ষাটোর্ধ্ব বয়সের মানুষকে প্রবীণ বলে গণ্য করা হয়। কারণ এ বয়সের পর মানুষ দৈনন্দিন জীবিকা উপার্জনের কাজ থেকে অবসর নেয়। অধিকার ব্যতীত মানুষ তার ব্যক্তিত্বকে উপলব্ধি করতে পারে না। অধিকারের মূল লক্ষ্য ব্যক্তির সর্বজনীন কল্যাণ সাধন। নাগরিকদের শারীরিক, মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিকাশের জন্য অধিকার ভোগ করার নিশ্চয়তা দান আধুনিক রাষ্ট্রের দায়িত্ব। অধিকার বলতে প্রথমত মানবাধিকারকেই বোঝানো হয়ে থাকে। মানুষের সব ধরনের অধিকার মানবাধিকার সনদে লেখা থাকে। জাতিসংঘ ১৯৪৮ সালে মানবাধিকার সনদ প্রকাশ করে। অধিকার হলো সমাজ ও রাষ্ট্র কর্তৃক স্বীকৃত কতোগুলো সুযোগ সুবিধা যা’  ভোগের  মাধ্যমে নাগরিক ব্যক্তিত্বে বিকাশ ঘটে।
বিগত ০৮ জুলাই ২০১৯, প্রথম আলোর আয়োজনে ও হেল্পএইজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের সহযোগিতায় ‘বাংলাদেশে প্রবীণ অধিকার সুরক্ষা: চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে অনুষ্ঠিত আলোচনায় সুপারিশ ছিল। ■ বাসস্থানের পরিকল্পনা অনুমোদনের ক্ষেত্রে মা–-বাবার থাকার ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা ও জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা–২০১৩ দ্রুত বাস্তবায়ন জরুরি, ■ প্রবীণ ফাউন্ডেশন গঠন করতে হবে, ■ প্রবীণদের জন্য সরকারি বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা দরকার, ■ অর্থনৈতিক মুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে প্রবীণদের ক্ষমতায়ন প্রয়োজন, ■প্রবীণদের ২৪ ঘণ্টা থাকা-খাওয়ার নিশ্চয়তা, চিকিৎসার ব্যবস্থা, সমবয়সী বন্ধুবান্ধবের সাহচর্য ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতা নিশিত করা জরুরি, ■ হাসপাতাল, বিমানবন্দর ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রবীণদের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সুযোগ দেওয়া দরকার সামাজিক সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু হওয়া প্রয়োজন।
অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নই প্রবীণদের অবস্থার উন্নতি করতে পারে। কেননা, হাতে টাকা থাকলেই একজন প্রবীণ সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হন। প্রবীণদের গুরুত্ব দিয়ে নির্বাচনী ইশতেহারে বর্তমান সরকার প্রবীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের  কথা উল্লেখ্ করেছিলেন। গোলটেবিল বৈঠকে প্রবীণদের আয় ও কর্মক্ষম করে তোলার বিষয়টা এসেছে। বয়স্ক ভাতা সম্প্রসারণের কথাও বলা হয়েছে। হাসপাতাল, বিমানবন্দর ও স্বাস্থ্যসেবায় তাঁদের সুযোগ দেওয়ার কথা এসেছে। রাষ্ট্রের পাশাপাশি প্রবীণদের জন্য সকল নাগরিকের ভূমিকা পালন করতে হবে। স্বাস্থ্য সমস্যাসহ চলাফেরায় নানা রকম সমস্যা দেখা দেয়। সরকার প্রবীণদের এরকম নানা ধরনের সমস্যার কথা বিবেচনায় এনে তাদেরকে সিনিয়র সিটিজেন হিসেবে ঘোষণা করে । প্রবীণদের পরিবারে মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য পিতা মাতার ভরণপোষণ আইন পাশ করা হয়েছে। এর জন্য আলাদা নীতিমালাও করা হয়েছে। বর্তমান ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে প্রবীণদের জন্য মাসিক সম্মানী ভাতা ৫০০ টাকা করা হয়েছে। এই খাতে মোট বাজেট ২৪০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।
জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবনের প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর ১ অক্টোবর বিশ্বব্যাপী আন্তর্জাতিক প্রবীণ দিবস পালন করে আসছে। এ বছরের বিশ্ব প্রবীণ দিবসটির (২০১৯) প্রতিপাদ্য হচ্ছে- ‘বয়সের সমতার পথে যাত্রা’। জাতিসংঘ এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জন্য ৬০ বছর ও তদূর্ধ্ব এবং উন্নত অঞ্চলের জন্য ৬৫ বছর ও তদূর্ধ্ব বয়সীদের প্রবীণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। বিংশ শতাব্দীতে চিকিৎসা বিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতি, সচেতনতা, পুষ্টি ও স্বাস্থ্য সেবার উন্নয়ন মৃত্যুহার যেমন হ্রাস করেছে তেমনি মানুষের গড় আয়ু বেড়েছে । ফলে, বিশ্ব সমাজে বয়স্কদের সংখ্যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অধিকার রক্ষায় সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি জনহিতৈষী সংগঠনের এগিয়ে আসা অত্যন্ত জরুরি। একই সঙ্গে পারিবারিক ও সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয় রোধে সবাইকে সচেষ্ট থাকতে হবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার বাণীতে বলেন, প্রবীণরা সমাজের বোঝা নন, সম্পদ। প্রবীণদের জন্য সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগামীতে প্রবীণদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ‘জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা বাস্তবায়ন’ এবং ‘প্রবীণ উন্নয়ন ফাউন্ডেশন’ গড়ে তোলার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। সংখ্যায় বাংলাদেশের প্রবীণরা কেবল দ্রুত বাড়ছেন, তাই নয়; এঁদের মৌলিক প্রয়োজন মেটানোর মতো পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রিক সক্ষমতা ক্রমেই জটিল আকার ধারণ করছে।  বার্ধক্য আমাদের জাতীয় জীবনের জন্য আজ একটি মারাত্মক চ্যালেঞ্জ। পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, প্রবীণ পুরুষের তুলানায় প্রবীণ নারীরা বেশিদিন বাঁচেন। অধিকাংশই আবার বিধবা হয়ে! আমাদের সমাজে তাঁরা বেশি মাত্রায় অবহেলা, দুর্ব্যবহার এবং বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন। এমনকি নিজের ভাই, স্বামী, সন্তানদের কাছ থেকেই! অসহায় প্রবীণার হৃদয়ে এমন অবস্থায় নীরবে ভেসে আসে, ‘‘যখন তোমার কেউ ছিল না তখন ছিলাম আমি, আর এখন তোমার সব হয়েছে পর হয়েছি আমি!’’
বাংলাদেশের সংবিধানে প্রবীণদের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচীর কথা বলা হয়েছে। বিশ্বের ৫০টির ও বেশি দেশ রয়েছে সেগুলোর মোট জনসংখ্যা এর চেয়ে কম। আমাদের দেশে প্রবীণদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কল্যাণমূলক কার্যক্রম রয়েছে যা অপ্রতুল বলে মনে করেন আমাদের প্রবীণ জনগোষ্ঠী । তাই, বাংলাদেশের প্রবীণদের উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ এবং সে অনুযায়ী কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকের প্রতি বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরাম সনির্বন্ধ আহ্বান জানাচ্ছে । প্রবীণরা কখনো বৃদ্ধ নয়, মানসিক দিক দিয়ে অনেক সক্ষম, দেশ গঠনে তাদের সহযোগিতা প্রয়োজন। দেশের সমাজ পরিবর্তনে এবং উন্নয়নে প্রবীণদের যথেষ্ট ভূমিকা রয়েছে। প্রবীণরা আমাদের শ্রদ্ধার পাত্র, সমাজের পথ প্রদর্শক। প্রবীণদের সম্মান ও যত্ন নেয়া আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। কাউকে ফেলে রেখে নয়, বরঞ্চ সকলকে নিয়ে বিশ্বসমাজের প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন এবং সমৃদ্ধির অভিযাত্রা চলমান রাখতে হবে।  জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা দলিলের মাহাত্ম্যই এখানে।  পারিবারিক, সামাজিক ও জাতীয় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রবীণদের অবদান অপরিসীম। পরিবারের গঠন, উন্নয়ন ও সমাজের কল্যাণে কর্মময় জীবন ব্যয় করে এক সময়ে তারা বার্ধক্যে উপনীত হন। তখন প্রবীণদের সার্বিক কল্যাণ ও সুরক্ষা করা সমাজের আবশ্যিক কর্তব্য। প্রবীণদের সমস্যা সমাধানে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সবার সম্মিলিত প্রয়াস প্রয়োজন। গণমাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের মাধ্যমে প্রবীণ সমস্যার ব্যাপকতা কমিয়ে আনা অনেকাংশেই সম্ভব। এখন থেকে গণমাধ্যম কর্মীরা প্রবীণ কল্যাণে জোরালো ভূমিকা পালন করবেন এবং সেই সঙ্গে আমরা সবাই নিজেদের বার্ধক্য সময়ের প্রস্তুতি নিতে শুরু করব এ প্রত্যাশাই করি।
আধুনিক সমাজে অনেক ক্ষেত্রে প্রবীণরা শুধুই অবহেলিত এবং বঞ্চিত। ইসলাম ধর্মে প্রবীণদের সেবা করা মানুষের অন্যতম ফরজ কাজ করে দেয়া হয়েছে। ফ্রান্সিস বেকেন এর মতে, ‘নৈতিক জগতে নবীনদের প্রাধান্য আর প্রজ্ঞার ক্ষেত্রে প্রবীণদের। পল রবসন এর মতে, ‘সবাইকে একদিন বৃদ্ধ হতে হবে। যুবক, যুবতী তাদের এ কথাটি মনে রাখা উচিত। বৃদ্ধদের সম্মান করতে না পারো, অসম্মান করো না। ১৬১৮ খ্রীষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন মোগল সম্রাট হাফেজ আবু জাফর মোহাম্মদ মহিউদ্দীন  আওরঙ্গজেব। ১৭০৭ খৃস্টাব্দে ৮৯ বছর বয়সে মৃত্যুকালে আওরঙ্গজেব তাঁর পুত্র কামবকসকে এই বলে চিঠি লিখেছিলেন,- ‘আজ আমি বৃদ্ধ, জরাজীর্ণ, শরীর একান্ত দুর্বল। যখন জন্মেছিলাম তখন কত লোক ও ঐশ্বর্য-প্রাচুর্যই না ছিল। জীবনের উজ্জ্বল দিনগুলি চলে গিয়েছে। আছে শুধু অস্থি, চর্ম, আর কংকাল। আজ আমি একা, অসহায়, অস্থির ও বিমূঢ়। তাঁর এই চিঠিতেও বোঝা যায় যে, সম্রাট আওরঙ্গজেব প্রবীণ বয়সে কত অসহায় এবং একাকিত্বের মধ্যে ছিলেন।
প্রাসঙ্গিক ভাবে উল্লেখ্য, ১৪ বছর আগে ২০০২ সালে ১৫৯টি দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক সম্মেলনে একবিংশ শতাব্দীতে নিম্নলিখিত তিনটি অগ্রাধিকারমূলক নির্দেশক অনুসরণ করে কাজ করতে সম্মত হয়। এগুলো হলো ১. প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন ২. প্রবীণ বয়সে স্বাস্থ্য ও সচ্ছলতা বৃদ্ধি ৩. প্রবীণদের জন্য সক্ষমতা ও সহায়তামূলক পরিবেশ নিশ্চিত করা। সম্মেলনে রাষ্ট্রগুলো ১৮টি ক্ষেত্র এবং ২৩৯টি সুপারিশমালা বাস্তবায়ন করতে সম্মত হয়। প্রবীণ জনগোষ্ঠী ও উন্নয়ন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, জীবনব্যাপী শিক্ষা, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে অংশগ্রহণ বা অংশগ্রহণ অব্যাহত রাখতে প্রবীণদের উৎসাহিত করতে বিভিন্ন সুযোগ, কর্মসূচি বা সহায়তা প্রদান করা। সব ধরনের বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রামের জন্য মানবাধিকার সনদগুলো বাস্তবায়নে সহযোগিতা করে সব মৌলিক স্বাধীনতা ও মানবাধিকার ভোগ নিশ্চিত করা। কর্মক্ষম বয়সী জনগোষ্ঠীর শ্রমবাজারে সক্রিয় থাকার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে শেষ জীবনে নির্ভরশীলতা বা কাজ থেকে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। কোনো ধরনের বৈষম্য বিশেষ করে জেন্ডার বৈষম্য ছাড়া ঋণের সুযোগ নিশ্চিত করে ছোট ও ক্ষুদ্র উদ্যোগে উন্নয়নের মাধ্যমে প্রবীণদের আত্মকর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। আর্থিক ও অবকাঠামোগত সেবা খাত এবং খামার কৌশল ও প্রযুক্তি বিষয়ে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণের সুযোগ অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রবীণ কৃষকদের সক্ষমতা আরও জোরদার করা। অর্থনৈতিক সম্পর্কে অংশীদার ও নিয়ন্ত্রণের সমান অধিকারের বিষয়টি বিবেচনায় রেখে গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলের প্রবীণ নারীদের অধিকার নিশ্চিত করা। অভিবাসিত দেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক জীবনে প্রবীণ অভিবাসীদের অঙ্গীভূত করা এবং তাদের মর্যাদা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা ও কর্মসূচি প্রণয়ন করা। তবে প্রবীণ বিষয়ক দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কর্মপরিকল্পনার সুপারিশমালা বাস্তবায়নের প্রাথমিক দায়িত্ব হলো সরকারগুলোর। উন্নত দেশগুলোর কার্যকর অঙ্গীকার ও আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর  দৃঢ়  সহযোগিতার  মাধ্যমে এ কর্মপরিকল্পপনা বাস্তবায়ন সম্ভব।
আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় প্রবীণদের অভিজ্ঞতা সর্বত্র কাজে লাগাতে হবে। পরিবার থেকে শুরু করে দেশ পরিচালনা পর্যন্ত প্রবীণ জনগোষ্ঠীর অভিজ্ঞতার মূল্যায়ন করতে হবে। পাশাপাশি সিনিয়র সিটিজেন ঘোষণার বাস্তবায়ন, বিকল্প আনন্দদায়ক কর্মসংস্থান, সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি, চিকিৎসা সেবাসহ প্রবীণদের পারিবারিক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এই লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সিনিয়র সিটিজেন ফোরামের সদস্যরা যার যার অবস্থান থেকে  সতস্ফুর্তভাবে প্রবীণ জনগোষ্ঠীর উন্নয়নে অঙ্গীকারবদ্ধ।
লেখক: সার্ক স্কলার, গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ, খ্যাতিমান সাংবাদিক এবং সাবেক ডাইরেক্টর (জনসংযোগ), বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ

অনলাইন আপডেট

আর্কাইভ