শেয়ারবাজারের পতন রোধের সকল উদ্যোগ ব্যর্থ
মুহাম্মাদ আখতারুজ্জামান: কোনো দাওয়ায়ই শেয়ারবাজারের পতন রোগ ভালো করতে পারছে না। শেয়ারবাজারের দুরবস্থায় গতি ফেরাতে বেশ তৎপরতা চালাচ্ছে সরকার। দেয়া হচ্ছে একের পর এক সুবিধা। কিন্তু পতন ঠেকাতে নেয়া সব পদক্ষেপই ব্যর্থ হচ্ছে। অব্যাহত দরপতনের কবলে পড়ে তিন বছর আগের অবস্থানে ফিরে গেছে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান মূল্য সূচক। শেয়ারবাজারের দুরবস্থার গতি ফেরাতে সরকারের সকল তৎপরতা যেন বিফলে গেছে। বিনিয়োগ করা পুঁজি হারিয়ে নিঃস্ব হচ্ছেন লাখ লাখ বিনিয়োগকারী। আন্দোলন থেকে দূরে রাখতে বিনিয়োগকারীদের নামে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়েছে। মামলার ভয়ও বিনিয়োগকারীদের আন্দোলন থামাতে পারেনি। পুঁজি হারানোর প্রতিবাদে আবারও ডিএসইর সামনে মানববন্ধন করেছে বিনিয়োগকারীরা।
গত ৯ কার্যদিবসের মধ্যে ৮ কার্যদিবসেই পতনের ঘটনা ঘটছে। বাজারের এমন দৈন্যদশার কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ খুঁজে পাচ্ছে না শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। তবে আর্থিক খাতের অনিয়ম, তারল্য ও বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকটের কারণে শেয়ারবাজারে অব্যাহত দরপতন হচ্ছে বলে মনে করছেন কেউ কেউ।
অব্যাহত দরপতনের প্রতিবাদে প্রায় দুই মাস পর গত মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেন বিনিয়োগকারীরা। পতনের ধারা অব্যাহত থাকায় গতকাল বৃহস্পতিবারও বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ডিএসইর সামনে বিক্ষোভ করেন তারা।
বিক্ষোভ কর্মসূচি থেকে আগের মতোই বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) চেয়ারম্যান পদ থেকে খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ দাবি করা হয়। একই সঙ্গে ইব্রাহীম খালেদের তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী দোষীদের শাস্তির দাবি জানান বিনিয়োগকারীরা। পাশাপাশি ‘জেড’ ক্যাটাগরি এবং ওটিসি মার্কেটের বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণসহ বেশকিছু দাবি জানানো হয়।
এর আগে দরপতনের প্রতিবাদে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বিনিয়োগকারীরা বিক্ষোভ করলে গত ২৭ আগস্ট ডিএসইর পক্ষ থেকে মতিঝিল থানায় সাধারণ ডায়েরি করা হয়।
ডায়েরিতে বলা হয়, ২৭ আগস্ট আনুমানিক দুপুর ২টা থেকে ৩টা পর্যন্ত বাংলাদেশ পুঁজিবাজার ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে ৯-১০ জন ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ লিমিটেডের সামনে ব্যানার ও মাইকসহ বিক্ষোভ করে। এতে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সদস্য, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের যাতায়াত এবং অফিসের স্বাভাবিক কার্যক্রম সম্পাদনে বিঘ্ন ঘটে। এতে আরও উল্লেখ করা হয়, ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে বেশ কিছুদিন ধরে তারা এ ধরনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আসছে এবং পুঁজিবাজারের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা ও পুঁজিবাজার সংশ্লিষ্ট সব প্রতিষ্ঠানের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সম্পর্কে সম্মান হানিকর মন্তব্য করছে। ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ মনে করে এ ধরনের কার্যকলাপ দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে এবং বহির্বিশ্বে দেশের পুঁজিবাজারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে। ফলে দেশের পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত হচ্ছে।
ডিএসইর পক্ষ থেকে সাধারণ ডায়েরি করা হলে বন্ধ হয়ে যায় বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের বিক্ষোভ। তবে শেয়ারবাজারে চলতে থাকে দরপতন। দরপতনের ধারা সম্প্রতি আরও ভয়াবহ রূপ ধারণ করে। এ পরিস্থিতিতেই মঙ্গলবার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সামনে আবারও বিক্ষোভ করে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদ। মঙ্গলবারের ধারাহিকতায় বৃহস্পতিবারও বিনিয়োগকারীদের বিক্ষোভ হয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী ঐক্য পরিষদের সভাপতি মিজান উর রশিদ চৌধুরী বলেন, আমরা বিনিয়োগ করা পুঁজি প্রতিনিয়ত হারাচ্ছি। আমাদের পিঠ দেয়ালে ঠেকে গেছে। কোনো মামলার ভয় দেখিয়ে আমাদের আটকে রাখা যাবে না। আমরা আগামী মঙ্গলবার পর্যন্ত দেখবো। এরপরও যদি বাজার ভালো না হয় তাহলে মঙ্গলবার বিক্ষোভ করে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, দীর্ঘদিন ধরেই এ দাবি জানিয়ে আসছি। আমাদের প্রধান দাবি বিএসইসির চেয়ারম্যান পদ থেকে খায়রুল হোসেনের পদত্যাগ। কারণ খায়রুল হোসেনকে বিএসইসির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রেখে শেয়ারবাজার ভালো করা যাবে না। পাশাপাশি আমরা আরও কিছু দাবি জানিয়েছি। এসব দাবি বাস্তবায়ন হলে শেয়ারবাজার অবশ্যই ভালো হবে।
এদিকে শেয়ারবাজারের তারল্য সংকট কাটাতে সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে একাধিক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে বাণিজ্যিক ব্যাংকের ঋণ আমানত অনুপাত (এডিআর)। রেপোর (পুনঃক্রয় চুক্তি) মাধ্যমে অর্থ সরবরাহের সুযোগও দেয়া হয়েছে। ইতিমধ্যে একটি ব্যাংক এ সুবিধাও গ্রহণ করেছে। পাশাপাশি শেয়ারবাজারে তারল্য বাড়াতে রাষ্ট্রায়ত্ত বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি) বিনিয়োগ বাড়িয়েছে। বন্ড বিক্রি করে সোনালী ব্যাংক থেকে পাওয়া ২০০ কোটি টাকা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করছে প্রতিষ্ঠানটি। এছাড়াও শেয়ারবাজারে বিনিয়োগের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক এবং সরকারি পাঁচ প্রতিষ্ঠানের কাছে দুই হাজার কোটি টাকা চেয়েছে আইসিবি। এ টাকার পুরোটা শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা হবে। এছাড়া ইউনিট ফান্ডের মাধ্যমে আইসিবিকে তহবিল সংগ্রহের সুযোগ দিতে চাচ্ছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)।
গতি ফেরাতে এ ধরনের একের পর এক পদক্ষেপ নেয়া হলেও শেয়ারবাজার তলানীতেই রয়ে গেছে। অব্যাহত পতনের কবলে পড়ে গত ১৩ অক্টোবর ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স তিন বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন অবস্থানে চলে আসে। এরপর আইসিবির বিনিয়োগ বাড়ানোর ফলে ১৫ অক্টোবর শেয়ারবাজারে বড় উত্থান হয়। এতে পুঁজি হারা বিনয়োগকারীরা আশার আলো খুঁজতে থাকেন। কিন্তু পরের কার্যদিবসেই তাদের সেই আশার আলো নিভে যায়। বড় উত্থানের পর দেখতে হয় বড় দরপতন। সেই পতনের ধারা সপ্তাহের শেষ কার্যদিবস বৃহস্পতিবারেও ছিল। ফলে শেষ ৯ কার্যদিবসের মধ্যে ৮ কার্যদিবসেই পতনের ঘটনা ঘটলো।
পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পতনের কারণ অনেক কিছুই থাকতে পারে। তবে এ মুহূর্তে শেয়ারবাজারের সব থেকে বড় সমস্যা বিনিয়োগকারীদের আস্থা সংকট। বাজারে বিনিয়োগকারীদের কোনো আস্থা নেই। বিনিয়োগকারীরা শেয়ারবাজার বিমুখ হয়ে গেছেন। ফলে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও বাজারে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না।
বিনিয়োগকারী রুহুল আমিন বলেন, প্রতিনিয়ত দরপতনের কবলে পড়ে পুঁজি হারাচ্ছি। রাতে ঠিক মতো ঘুমাতে পারছি না। প্রতি রাতেই ভাবি সকালে গিয়ে বাজার ভালো দেখতে পাব। কিন্তু লেনদেন শুরুর পর বাজারের চিত্র আর পরিবর্তন হয় না। আমার পোর্টফোলিতে যে কয়টি কোম্পানির শেয়ার আছে, গত এক মাসে সবকটির দাম কমেছে। এভাবে প্রতিনিয়ত শেয়ারের মূল্য কমে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছি। কিভাবে হারানো পুঁজি ফিরে পাবো তার কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছি না।
বাজার পর্যালোচনায় দেখা যায়, বৃহস্পতিবার ডিএসইর প্রধান মূল্য সূচক ডিএসইএক্স ১০ পয়েন্ট কমে চার হাজার ৭৭০ পয়েন্টে নেমে গেছে। অপর দুই সূচকের মধ্যে ডিএসই শরিয়াহ্ ৫ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৯৪ পয়েন্টে দাঁড়িয়েছে। আর ডিএসই-৩০ সূচক ৬ পয়েন্ট কমে এক হাজার ৬৭৯ পয়েন্টে অবস্থান করছে। মূল্য সূচকের এই পতনের পাশাপাশি ডিএসইতে লেনদেনে অংশ নেয়া প্রায় অর্ধেক প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম কমেছে। বাজারে লেনদেনে অংশ নেয়া মাত্র ১৪৫ প্রতিষ্ঠানের শেয়ার ও ইউনিটের দাম বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ১৬২টির। আর ৪৩টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।
মূল্য সূচকের পতনের পাশাপাশি দেখা দিয়েছে লেনদেন খরা। গত কয়েক দিনের মতো ডিএসইর লেনদেন তিনশ কোটি টাকার ঘরে আটকে রযেছে। দিনভর ডিএসইতে লেনদেন হয়েছে ৩১৩ কোটি ১৪ লাখ টাকা। আগের কার্যদিবসে লেনদেন হয় ৩২৪ কোটি ৫৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ বাজারটিতে লেনদেন কমেছে ১১ কোটি ৪৩ লাখ টাকা।
অপর শেয়ারবাজার চট্টগ্রাম স্টক এক্সচেঞ্জের প্রধান মূল্য সূচক সিএএসপিআই ৪৭ পয়েন্ট কমে ১৪ হাজার ৫০৭ পয়েন্টে অবস্থান করছে। বাজারে লেনদেন হয়েছে ১৮ কোটি ৫৫ লাখ টাকা। লেনদেনে অংশ নেয়া ২৫৫টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১০২টির দাম বেড়েছে। বিপরীতে কমেছে ১২৪টির। আর ২৯টির দাম অপরিবর্তিত রয়েছে।