শত শত কোটি ডলারের চুক্তি সই সৌদি আরব ও রাশিয়ার মধ্যে
১৫ অক্টোবর, পার্সটুডে : এক দশকের মধ্যে প্রথম সোমবার সৌদি আরব সফর শুরু করেছেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তাকে লাল গালিচা অভ্যর্থনা দেয়া হয়েছে। মস্কোর ঘনিষ্ঠ মিত্র ইরানকে কেন্দ্র করে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যে যখন উত্তেজনা তুঙ্গে, তখন এই সফরে এসেছেন পুতিন। এ সময়ে দুই দেশ কয়েক শত কোটি ডলার মূল্যের ২০টি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো বিশ্বে তেলের মূল্য স্থিতিশীল রাখা এবং উত্তেজনা নিরসন করা।
সৌদি আরবের দুটি তেলক্ষেত্রে ভয়াবহ ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর যখন ইরানের সঙ্গে তাদের দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে এবং এ জন্য সৌদি আরব ও যুক্তরাষ্ট্র ইরানকেই দায়ী করে, তখন এই সফর অনেক গুরুত্বপূর্ণ। সম্পাদিত চুক্তিগুলোর মধ্যে রয়েছে এরোস্পেস, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য, অত্যাধুনিক প্রযুক্তি ও কৃষি সংক্রান্ত। গুরুত্বপূর্ণ চুক্তির মধ্যে অন্যতম তথাকথিত ওপেক দেশগুলোর বিষয়ে সহযোগিতা বৃদ্ধি করা নিয়ে। অর্গানাইজেশন অব দ্য পেট্রোলিয়াম এক্সপোর্টিং কান্ট্রিজ ও এর সদস্য নয় এমন ১০টি সদস্য দেশকে মিলে বলা হয় ওপেক।
এর সদস্য নয় মস্কো। তবে ২০১৪ সালের পর থেকে তেলের সরবরাহ সীমিত করতে এবং মূল্য বৃদ্ধিতে এই গ্রুপের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়া।
গত সোমবারের চুক্তি স্বাক্ষর বিষয়ে সৌদি আরবের জ্বালানিমন্ত্রী প্রিন্স আবদুল আজিজ বিন সালমান বলেছেন, সোমবারের চুক্তির মধ্য দিয়ে তেলের বাজার স্থিতিশীল রাখতে সহযোগিতা ও সম্পর্ক শক্তিশালী করতে নতুন করে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ওদিকে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দমিত্রি পেসকভ সাংবাদিকদের বলেছেন, পুতিন ও সৌদি আরবের কর্মকর্তারা সামরিক ও প্রযুক্তিগত সহযোগিতা নিয়ে আলোচনা করেছেন। ২০১৭ সালের অক্টোবরে রাশিয়া ও সৌদি আরব একটি সমঝোতা স্বারক স্বাক্ষর করে। এর ফলে মস্কোর কাছ থেকে শক্তিশালী এস-৪০০ নামের বিমান বিধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনার পথ উন্মুক্ত হয় রিয়াদের জন্য। কিন্তু সৌদি আরব এখনও ওই ব্যবস্থা নেয়নি রাশিয়ার কাছ থেকে। এর পরিবর্তে তারা যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ওই ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থা কেনাকেই বেছে নেয়।
গত সোমবার পুতিন বলেছেন, সৌদি আরবের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও পারস্পরিক সুবিধা সম্বলিত সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বিশেষভাবে জোর দিয়েছে রাশিয়া। এ সময় পুতিনকে সৌদি আরবের বাদশা সালমান বলেছেন, প্রতিটি বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমরা কাজ করতে চাই। এর মাধ্যমে নিরাপত্তা, স্থিতিশীলতা ও শান্তি আসবে। সন্ত্রাসী ও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াই করা যাবে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গতি পাবে।
উল্লেখ্য, রাশিয়া এবং সৌদি আরব দুটি দেশই এখন যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র। তাদের মধ্যে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সম্পর্কের উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে ২০১৭ সালের অক্টোবরে প্রথমবার রাশিয়া সফর করেন সৌদি আরবের বাদশা সালমান। কিন্তু এক বছর আগে ভিন্ন মতাবলম্বী সাংবাদিক জামাল খাসোগিকে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে সৌদি আরবের কনসুলেটের ভিতর হত্যা করা হয়। এরপর সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স ওই হত্যাকা-কে ঘিরে কড়া সমালোচনার মুখে পড়েন। এরই এক পর্যায়ে জি-২০ শীর্ষ সম্মেলনে ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে হাত মেলানো থেকে বিরত থাকেন পুতিন।
তবে সেই সম্পর্ক আস্তে আস্তে জোড়া লেগেছে। সৌদি আরব সফরে যাওয়ার আগে একটি আরবি ভাষার টেলিভিশন চ্যানেলকে সাক্ষাতকার দিয়েছেন পুতিন। এ সময় তিনি সৌদি আরবের রাজপরিবারের সদস্যদের সঙ্গে তার সুসম্পর্কের প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, সৌদি আরব, আমাদের অংশীদার এবং আরব দুনিয়ায় আমাদের বন্ধুদের সঙ্গে আমরা কাজ করছি তেলের বাজার অস্থিতিশীলতা করার যেকোনো প্রষ্টাকে কমিয়ে শূন্যে নামিয়ে আনতে।
ভøাদিমির পুতিনের এমন উদ্যোগকে ইরান ও সৌদি আরবের মধ্যে চলমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষী বা পিসমেকারের ভূমিকা পালন করতে পারে বলে মন্তব্য করেছেন রাশিয়ার রাজনৈতিক বিশ্লেষক ফিওদর লুকিয়ানভ। ইরানের সঙ্গে আগে থেকেই রাশিয়ার সম্পর্ক ভাল। তার সঙ্গে সৌদি আরবের সঙ্গে নতুন করে সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে। এই দুই মিলে সৌদি আরব ও ইরানের মধ্যকার বিরোধ মেটানোর ক্ষেত্রে অনুঘটক হয়ে উঠতে পারেন পুতিন। গত মাসে সৌদি আরবের সবচেয়ে বড় তেলক্ষেত্রে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর উত্তেজনা বৃদ্ধি পায়। সৌদি আরব তার অশোধিত তেল উত্তোলন অর্ধেকে নামিয়ে আনে। এতে বিশ্বে তেলবাজারে দাম বৃদ্ধি পেতে থাকে। ওই হামলার দায় ইয়েমেনের বিদ্রোহী হুতিরা স্বীকার করলেও যুক্তরাষ্ট্র ও সৌদি আরব মনে করে এর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত ইরান। কিন্তু বার বার এমন অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে ইরান।
এদিকে সৌদি আরব সফররত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভলাদিমির পুতিন মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার যেকোনো সমস্যা কূটনৈতিক উপায়ে সমাধানের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি সোমাবার রিয়াদে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মাদ বিন সালমানের সঙ্গে সাক্ষাতে এ আহ্বান জানান।
প্রেসিডেন্ট পুতিন বলেন, সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলা করার পাশাপাশি কূটনৈতিক উপায়ে মধ্যপ্রাচ্যে ও উত্তর আফ্রিকার সমস্যাবলী সমাধানের প্রতি রাশিয়ার সমর্থন রয়েছে। তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা এবং বিশ্বের জ্বালানী সরবরাহ নির্বিঘ্ন রাখার জন্য রাশিয়া সব রকম সহযোগিতা করতে প্রস্তুত এবং এ সহযোগিতা ইতিবাচক ফল বয়ে আনবে।
সাক্ষাতে সৌদি যুবরাজ বলেন, জ্বালানী খাতে তেহরান ও মস্কোর মধ্যকার সহযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যে স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হবে।
রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন সোমবার রিয়াদে পৌঁছেই সৌদি বাদশা সালমান বিন আব্দুল আজিজের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ওই সাক্ষাতে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক ও সহযোগিতা শক্তিশালী করার আগ্রহ প্রকাশ করেন দুই নেতা। প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ১২ বছর পর সৌদি আরবে নিজের দ্বিতীয় সফরে সোমবার রিয়াদ পৌঁছান।